সত্য ঘটনার অবলম্বনে!
৩০’ মার্চ, আমার আজ অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়েছে। ইয়ার এন্ডিং এর সময় অফিস-এ প্রচুর কাজের চাপ। প্রায় ০৮ তা ৪৫ এর নাগাদ বাসায় এসে পৌছালাম। আজ আসার সময় মেট্রো তে সিট্ পাইনি তাই পুরো রাস্তা দাঁড়িয়ে আসতে হয়েছে; বাসায় পৌঁছে জামা কাপড় ছেড়ে মেঝেতে শুয়ে আছি। মেট্রো তে আসার সময় ভাবছিলাম বাসায় পৌঁছে একবার গ্রামে ফোন করবো ; গত ৪-৫ দিন ফোন করা হয়নি। মেঝেতে শুয়ে মোবাইল তা হাতে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া গুলো নাড়াচাড়া করছিলাম। এমন সময় আমার জামাইবাবুর ফোন এলো,
– তুমি কি রুম -এ ?
– হ্যাঁ ! এই মিনিট দশেক আগে পৌঁছেছি ,
– ঠিক আছে, আমি রুটি তরকারি নিয়ে যাচ্ছি। আর কিছু নিয়ে যেতে হবে ?
– না !
এই বলে আমি ফোন টা কাটলাম , ফোন টা চার্জ এ বসিয়ে আমি স্নান করতে চলে গেলাম।
আমার বাড়ি, পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় কাঁথি শহরে, বয়স ৩৩ , বাড়িতে বাবা, মা, বোন, স্ত্রী ও এক পুত্র সন্তান নিয়ে আমার সংসার। কর্মসূত্রে আমি দিল্লী তে গত ৫ বছর ধরে থাকি। এখানে একটা বহুজাতিক সংস্থা তে আমি “গ্লোবাল ট্রেড এনালিস্ট ” হিসেবে কাজ করি। নয়ডা সেক্টর ৬২ তে আমার অফিস , আমি থাকি দিল্লি লক্সমী-নগর এ তাই আমাকে রোজ দিল্লী – নয়ডা যাতায়াত করতে হয়। আমার মর্নিং শিফট থাকলে আমি অটো করে অফিস যাই আর আসার সময় মেট্রো করে ফিরি। পরের দিন ৩১’ মার্চ ; আর্থিক বছরের শেষ দিন তাই আমাকে একটু আগে থেকে অফিস এ যেতে হবে বলে রাতের ডিনার করে রাত ১১ টা ৩০ এর দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম। মোবাইল এ ভোর ৪ টার অ্যালার্ম সেট করে দিয়েছিলাম।
ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য বাংলা ছোট গল্প - শেষ জমিদারের মেয়ে: ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য গল্প: এক জমিদার কন্যার গল্প, যে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির পর নিজের পায়ে দাঁড়ায় এবং গ্রামের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
এতকিছুর মধ্যে সেদিন আর বাড়িতে ফোন করা হলনা।
যখন আমাদের জীবনের দৈনিক চাহিদাপূর্ণ করার জন্য একটা সঠিক ক্যারিয়ার এবং একটি পরিবার থাকে, তখন ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্যের অভাব আমাদের মানসিক চিন্তাভাবনা কে অস্থির করে তোলে এবং পেশাগত জীবনে অসন্তোষের সৃষ্টি করে।
পূর্ব নির্ধারিত পরের দিন; ৩১’ মার্চ ভোর ৪ টা ১৫ – ২০ এর দিকে মোবাইলের অ্যালার্ম এ ঘুম ভাঙে। সকাল ৭ টায় আমার শিফট শুরু হয়; কিন্তু আমি ২০-২৫ মিনিট আগেই অফিস পৌঁছে যাই। এটাই আমার দীর্ঘ কর্ম জীবনের অভ্যেস। আমার এই স্বভাবের জন্য আমার অবচেতন মনে আমি নিজের প্রতি নিজে একটা আত্ম-অহংকার অনুভব করতাম।
আত্ম-অহংকার একটি ভাল জিনিস। কিন্তু প্রশ্ন হল আপনি কিভাবে এটা ফ্রেম করবেন. গর্ব প্রেমময়, আত্মবিশ্বাসী বা আক্রমণাত্মক হতে পারে। কখনও কখনও এটি বোকা বা অহংকারীও হতে পারে। এটা সব সময় একটা সংজ্ঞায়িত প্রেক্ষাপট উপর নির্ভর করে।
আমি যখন স্নান করে বেরোলাম তখন জামাইবাবু ঘুম ভাঙলো। জামাইবাবু ঘুম জড়ানো স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
– আজ এতো সকালে?
– আজ একটু অফিস এ বেশি কাজ আছে, তাই তাড়াতাড়ি অফিস যাচ্ছি।
– কিন্তু তুমি, এতো সকালে অফিস যাবে কিভাবে ?
– উবের আপ এ মোটর-সাইকেল বুক করে নেব,
অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প - স্বপ্নের রূপে ঝঙ্কার: শিউলি, এক গ্রামের মেয়ে, তার অসাধারণ গানের প্রতিভা দিয়ে সকলকে মুগ্ধ করে। কিন্তু খ্যাতির পথে তাকে অতিক্রম করতে হয় অনেক বাধা। এই অনুপ্রেরণামূলক গল্পে দেখুন কীভাবে সে তার স্বপ্ন পূরণ করে এবং সকলের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
আমি একটা টি-শার্ট ও জিন্স পরে অফিস এর ব্যাগ টা গুছিয়ে নিলাম। অফিসের ব্যাগ গোছানো বলতে, একটা ল্যাপটপ , তার চার্জার , আই-ডি কার্ড। ইয়ারফোন টা মোবাইল এর সাথে কানেক্ট করে উবের আপ টা ওপেন করে bike বুক করতে লাগলাম। মিনিট খানিকের এর মধ্যে বুকিং কনফারমেশন নোটিফিকেশন এলো, ড্রাইভার এর নাম অজয়। আমি বাসা থেকে বেরিয়ে নিচে রাস্তায় বাইকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। মোবাইল এ নোটিফিকেশন এ ১০ মিনিট পিকআপঃ টাইম ওয়েটিং দেখাচ্ছিল। আমি মোবাইল এ একটা বাংলা লোকগীতি প্লেলিস্ট চালিয়ে গান শুনতে লাগলাম।
সকালে তখন ৫:৩০। রাস্তায় এক – দুজন চলা ফেরা করছে , ভোরের সূর্য তখন ওঠেনি ।
আমি বাইক এর অপেক্ষায় গলির মুখে দাঁড়িয়ে দূরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি। এমন সময় দূরে লাল রঙের টি শার্ট এ একজনকে বাইক নিয়ে আমার দিকে আসতে দেখলাম। বাইক টা আমার কাছে এসে থামলো, আমি বাইক এর নাম্বার টা মেলাতে লাগলাম , বাইক নাম্বার তো মিলছে কিন্তু ড্রাইভার যে টি শার্ট টা পরে আছে ওটা জোমাটো এর ইউনিফর্ম। আমি একটু খানিক অবাক-ই হলাম আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-অজয়! উবের ?
– হ্যা স্যার ! কোথায় যাবেন ?
– সেক্টর ৬২।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম যে,
– তুমি জোমাটো এর ইউনিফর্ম , আগে জোমাটো তে কাজ করতে নাকি ?
– স্যার ! আমি জোমাটো এবং উবের দুটো জায়গায় কাজ করি। রাত ১১ টা থেকে ভোর ৪ টা পর্যন্ত জোমাটো এবং সকাল ৬ টা থেকে দুপুর ২ টো পর্যন্ত উবের এ।
আমি আর কোনো কথা না বলে হেলমেট টা পরে বাইক এ উঠে পাড়লাম। মোবাইল এ তখন ঋষি পাণ্ডার স্বরে গান চলছে, “আমার হাত বাঁন্ধিবি , পা বাঁন্ধিবি, মন বাঁন্ধিবি কেমনে ” কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আমাদের গালি ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম।
কল্পবিজ্ঞান-এর বাংলা ছোট গল্প - সবুজ স্বপ্ন: কল্পবিজ্ঞান গল্প: পারমাণবিক যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে রিয়া নামক এক যুবতী পৃথিবীকে পুনরুদ্ধারের আশা খুঁজে পায়। বাংকারে লুকিয়ে থাকা জ্ঞানের সাহায্যে সে লড়াই শুরু করে নতুন সবুজের জন্য। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
আজ ২০২১ – ২২ আর্থিক বছরের শেষ দিন। গত ২ বছরের করোনা মহামারীতে ভারতের তথা পৃথিবীর অর্থনীতি তালমাতাল, অধিকাংশ মধ্যবিত্ত আজ মধ্যবিত্ত নেই , ওরা আজ দারিদ্র সীমার নিচে চলে গিয়েছে। বেশির ভাগ মানুষের হাতে আজ অর্থ উপার্জন কিছু নেই। কোনোভাবে যাতে সংসার চলে যায় সেই যুদ্ধের যোদ্ধা আজ এরা সবাই। আজ এক যোদ্ধার সাথে আমি আমার পরিবার থেকে প্রায় ১৫০০ – ১৬০০ কিলোমিটার দূরে একটা মোটরসাইকেল এ একসাথে পথ চলছি। আমি একটা বিষয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে, সংসার চালানোর জন্য আমার মতো কেউ পরিশ্রম করতে পারবে না, আজ এই উবের ড্রাইভার এবং জোমাটো ফুড ডেলিভারি বয়, অজয় কুমার আমার আত্মবিশ্বাস কে ভেঙে চুরমার করে দিল। মানুষ তার সংসার প্রতিপালনের জন্য এতটা মরিয়া হয়ে উঠতে পারে সেটা আগে কোনোদিন বুঝে উঠতে পারিনি।
আমরা এখন দিল্লি – মীরট এক্সপ্রেস ওয়ে এর কাছে আমি অজয় কে জিজ্ঞেস করলাম,
– তোমার বাড়ি কোথায় ?
– লখনৌ
– এখানে কোথায় থাকা হয় ?
– গাজীপুর এর কাছে ?
– ফ্যামিলি ?
– আমি এখানে মা , স্ত্রী ও দুজন কন্যা সন্তানের সাথে থাকি ?
দিল্লি তে পরিবারের সাথে থাকা একটা বড় খরচের ব্যাপার। ওর কথা শুনে আমার মনে একটা ঈর্ষা বোধ কাজ করল, স্বাভাবিক ভাবে আমার মাসিক আর্থিক উপার্জন ওর থেকে বেশি, তার পরেও আমি আমার পরিবার কে এখানে নিয়ে আসার সাহস করে উঠতে পারছিনা, কিন্তু ও কি করে পারে ?
অনেক নিরাপত্তাহীনতা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত হয়। মানুষ যখন নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করে তখন তারা নিকৃষ্ট এবং নিরাপত্তাহীন বোধ করে, বিশেষ করে যখন তারা আর্থিকভাবে সংগ্রাম করে। এই অনুভূতির মূলকে চিনতে পারলে, আপনি তাদের পরিবর্তনের দিকে কাজ করতে পারেন। এটি কিছু সময় নিতে পারে, তবে এটি মূল্যবান। একবার আপনি বুঝতে পারবেন কেন আপনি অনিরাপদ বোধ করেন, এটি পরিবর্তন করা অনেক সহজ। আপনি নিখুঁত নন এবং আপনি ভালবাসা এবং সম্মানের যোগ্য তা স্বীকার করতে শুরু করলে আপনি আরও আত্মবিশ্বাসী হবেন। ঈর্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল এমন লোকেদের সাথে আরও বেশি সময় কাটানো যারা আপনাকে ভাল বোধ করে।
অজয় এখন আর আমার উবের ড্রাইভার নয়, আমার মনের যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা এখন একে ওপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। মনে এক অদৃশ্য লড়াই চলছে আমাদের মধ্যে। আমাদের এই লড়াই এ আমি প্রতি পদক্ষেপ -এ পরাজিত। জীবন যুদ্ধের এই যোদ্ধা প্রতিটি পদক্ষেপ-এ আমাকে হারিয়ে প্রতিটি স্তর পেরিয়ে যাচ্ছে। আমার আত্ম-অহংকার এখন ক্ষীণ আরও ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।
দিল্লি-মীরট এক্সপ্রেস ওয়ে-এর ওপর দিয়ে আমাদের জোমাটো ছুটে চলেছে , অদূরের প্রযুক্তির শহর, নয়ডা দূষণের চাদরে আবছা। এখানে জীবন ছুটে চলে এক অদৃশ্য মিথ্যে ভালো থাকার আশায়। ঝাঁ চকচকে বড়-বড় বিল্ডিং এর আড়ালে আকাশ ঢেকে যায়।
৬-১৫ এর দিকে আমরা অফিস এ পৌছালাম। বাইক থেকে নেমে আমি অজয় কে বললাম,
– চলো, একটা চা খাও।
ও মাথা নেড়ে হ্যা জানালো, আমার এই সৌজন্যবোধ অজয় ওর মরিয়া-পরিশ্রম দিয়ে জিতে নিয়েছে। আমার কাছে ২০২১ – ২২ আর্থিক বছরের “এমপ্লয়ী অফ দা ইয়ার” এর বিজয়ী অজয় কুমার। আমি ওকে ওর ভাড়া টা দিয়ে, চা খাওয়া শেষ করে অফিসের বিল্ডিং এর দিকে এগিয়ে গেলাম। বিল্ডিং এর দিকে যাওয়ার আগে ওকে হাসি মুখে বিদায় জানালাম।
অফিসের ঢুকে আমি আমার ডেস্ক এ বসতেই একজন সহকর্মী বলে উঠল, “স্যার ! আপনার মতো পরিশ্রমী খুব কম জন-ই হয়।” অজয় কুমার এর কাছে সদ্য পরাজিত আমি মুখে একটা হালকা হাসি দিয়ে ল্যাপটপ অন করলাম।
বহুজাতিক কোম্পানির কর্মচারীরা আজ হাঁসি মুখে মনে কষ্ট নিয়ে প্রতিদিন নিজের সাথে লড়াই করে যায়। এদের কাছে অফিস-র সহকর্মী এবং উচ্চ পদস্থ কর্মচারীরা এদের প্রতিদ্বন্দ্বী, কখনো কখনো সমাজ এদের প্রতিদ্বন্দ্বী, কখনো-বা সরকার এদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। কিন্তু আমরা যদি কখনো আমাদের স্ব-বিশ্লেষণ করি তখনই আমরা জানতে পারবো যে আমাদের আসল প্রতিদ্বন্দ্বী হল আমাদের অসীম চাহিদা এবং দেখনদারি আচরণ। যখন এই প্রতিদ্বন্দ্বী দের কাছে পরাজিত হতে হতে আমরা যখন বিষণ্ণ হয়ে উঠি, তখন সেই বিষন্নতাকে আড়াল করার জন্য সিগারেটের আগুনে নিজেদের শরীরকে ধীরে ধীরে পোড়াতে থাকি, অথবা মদের গ্লাস এ নিজের চেতনা কে ডুবিয়ে দেই, কখনো বা কোন এক অবৈধ সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে কোনো এক ফ্ল্যাট-এর অন্ধকার কোনে নিজের শরীরকে লুকিয়ে ফেলি।