কলকাতার উত্তর দিকের এক ছোট্ট শহরে, বর্ধমানের কোণে অবস্থিত হুগলি নদীর ধারে গড়ে উঠেছে রায়পুর গ্রাম। নদীর বুকে ধোঁয়াটে জলের স্রোত আর দু’পাড়ের ধানক্ষেতের সবুজের মধ্যে গ্রামটা যেন একটা ছোট্ট স্বর্গ। কিন্তু এই স্বর্গেরই কোনো কোনো অন্ধকার কাহিনী আছে, যা গ্রামবাসীদের কানে কানে রয়েছে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
রূপকান্তি বাবু রায়পুরেরই বাসিন্দা। বয়স সত্তর পেরিয়েছে। তার বাড়ি নদীর ধারেই। বসন্তের দিনগুলোতে নদীর বুকে পদ্ম ফোটে, তার সেই সৌন্দর্য দেখতে আসতেন অনেকে। কিন্তু রূপকান্তি বাবু সে সব দেখতেন না। তার চোখে শুধুই অন্ধকার।
একদিন সন্ধ্যায়, বৃদ্ধ রূপকান্তি বাবু তার ছোট্ট কুঁড়েঘরে বসে ছিলেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃদ্ধের শরীরে কাঁপুনি ধরেছিল। হঠাৎ, ঘরের এক কোণ থেকে একটা আওয়াজ এলো, যেন কেউ হাঁপাচ্ছে। রূপকান্তি বাবু ভয় পেলেন। কিন্তু বয়সের ভারে তার পা কাঁপছিল, উঠে যেতে পারছিলেন না। আওয়াজটা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। এবার সেটা ছিল একটা কান্নার শব্দ, একটা মেয়ের কান্নার।
অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প - জীবনের পথিক: আশা হারিয়ে ফেললে কী করবেন? জানতে চাইলে পড়ুন এই মোটিভেশনাল বাংলা ছোট গল্প। বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে এক লেখকের জীবন পাল্টে যাওয়ার গল্প। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
রূপকান্তি বাবু চোখ বুঁজে নিলেন। ভাবলেন, বৃদ্ধ বয়সে কানে ভ্রম হচ্ছে। কিন্তু আওয়াজটা থামছিল না। বরং বাড়ছিল। এবার সেটা ছিল একটা চিৎকার। একটা ভয়াবহ চিৎকার। রূপকান্তি বাবু চোখ খুলে দেখলেন, ঘরের এক কোণে, অন্ধকারের মধ্যে, দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। সে মেয়েটা কালো কাপড় পরেছিল, তার চেহারা দেখা যাচ্ছিল না। শুধুই দু’টা লাল চোখ জ্বলজ্বল করছিল।
মেয়েটি ধীরে ধীরে রূপকান্তি বাবুর দিকে এগোতে লাগলো। তার পায়ে জোর আসছিল না। বৃদ্ধ ভয়ের সাগরে ডুবে যাচ্ছিলেন। মেয়েটি তার কাছে এসে দাঁড়ালো। তার মুখ এখনও দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু মেয়েটির হাত ছুঁয়ে গেল রূপকান্তি বাবুর গাল। হাতটা হিমশীতল ছিল।
হঠাৎ, বাইরে একটা বিজলী চমকালো। ঘরটা আলোকিত হলো। রূপকান্তি বাবু চোখ তুলে দেখলেন, তার সামনে আর কেউ নেই। শুধুই নিজের কাঁপা হাত আর ঘরের চার দেওয়াল।
রূপকান্তি বাবু নিশ্বাস ফেললেন। ভাবলেন, স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু তার গালে এখনও সেই হিমশীতল স্পর্শের অনুভূতি ছিল।
সেই রাত থেকে রূপকান্তি বাবুর জীবন বদলে গেল। রাত হলেই তার ভয় হতো। সেই মেয়েটিকে দেখার ভয়। কিন্তু সেই মেয়েটি আবারও ফিরে এলো। এক রাতে, সেই একই ভাবে। শুধু এবার সে একটু কাছে এসেছিল।
রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প - মুখোশের খেলা: এক রহস্যময় উপন্যাস, বিশ্বাসঘাতকতা, এবং ভালোবাসার জালে জড়িয়ে যান শিপ্রা, যখন তিনি তার মায়ের অতীতের সাথে পরিচিত হন। "শেষের আলোকিত মুখ" - এক উত্তেজনাপূর্ণ গল্প যা আপনাকে শেষ পর্যন্ত মুগ্ধ করে রাখবে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
গ্রামবাসীরা রূপকান্তি বাবুর অবস্থা দেখে ভয় পেতে শুরু করলো। কেউ কেউ বলল, নদীর গভীরে কোনো পুরানো অভিশাপ আছে, সেই অভিশাপই রূপকান্তি বাবুকে ধরেছে।
দিনের বেলায় রূপকান্তি বাবু স্বাভাবিক মানুষের মতোই আচরণ করতেন। কিন্তু রাতের অন্ধকার নামলেই তার মনে ভয়ের ছায়া পড়তো। গ্রামের লোকেরা তাঁকে একা থাকতে নিষেধ করলো, কিন্তু রূপকান্তি বাবু কারো কথা শুনলেন না। তাঁর মনে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ কাজ করছিল। সেই আকর্ষণ তাঁকে রাতের অন্ধকারের দিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।
এক রাত, বৃষ্টির রাত। রূপকান্তি বাবুর ঘরের জানালায় বৃষ্টিপাতের ধুন্দুবির শব্দ। ঘরের ভিতর অন্ধকার। হঠাৎ, একটা আঁধারের পর্দা ঘরের ভিতর ঢুকলো। সেই আঁধারের পর্দার মধ্য থেকে ধীরে ধীরে একটা আকৃতি বের হলো। সেই আকৃতিটি ছিল সেই মেয়েটিরই। কিন্তু এবার সে একটু পরিবর্তিত। তার চোখগুলো আগের চেয়ে বড় হয়েছিল, আর তার হাতগুলো লম্বা হয়েছিল।
মেয়েটি ধীরে ধীরে রূপকান্তি বাবুর কাছে এগোতে লাগলো। রূপকান্তি বাবু ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন, কিন্তু তার শরীর যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটি তার কাছে এসে দাঁড়ালো। তার মুখ এখনও দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু তার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ রূপকান্তি বাবুর কানে বাজছিল।
হঠাৎ, একটা ভয়াবহ চিৎকার। রূপকান্তি বাবু চোখ খুলে দেখলেন, তার সামনে কেউ নেই। শুধুই ঘরের চার দেওয়াল। কিন্তু তার গায়ে একটা অদ্ভুত ঠান্ডা অনুভূতি ছিল।
সেই রাত থেকে রূপকান্তি বাবু আর স্বাভাবিক হয়ে ওঠেননি। তিনি আর কথা বলতেন না, খেতেন না। শুধুই এক কোণে বসে থাকতেন। গ্রামবাসীরা ভীত হয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ বলতে শুরু করলো, রূপকান্তি বাবুকে ভূত ধরেছে।
একদিন, রাতের অন্ধকারে, রূপকান্তি বাবুর বাড়ি থেকে একটা ভয়াবহ চিৎকার শোনা গেল। গ্রামবাসীরা দৌড়ে বাড়ির দিকে গেল। বাড়ির দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকলো তারা। দেখল, রূপকান্তি বাবু মারা গিয়েছেন। তার পাশে পড়ে আছে একটা ছবি। সেই ছবিটিতে একজন যুবক আর একজন মেয়েকে দেখা যাচ্ছিল। মেয়েটি সেই মেয়েটাই, যাকে রূপকান্তি বাবু দেখেছিল।
ছবির নিচে লেখা ছিল, “তুমি আমাকে ভুলে যেতে পারবে, কিন্তু আমি তোমাকে কখনো ভুলবো না।”
গ্রামবাসীরা ভয় আর আতঙ্কে ছটফট করতে লাগলো। কেউ জানতো না, এই গল্পের শেষ কোথায়। শুধু জানতো, রাতের অন্ধকারে এখনও সেই মেয়েটির হাসি শোনা যায়।
রূপকান্তি বাবুর মৃত্যুর পর রায়পুর গ্রামের পরিবেশ ভয়াবহ হয়ে উঠলো। রাতের অন্ধকারে অদ্ভুত আওয়াজ, অস্বাভাবিক ঘটনা, সব কিছুই যেন গ্রামবাসীদের জীবনকে অচেনা করে তুললো।
অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প - অপ্রতিরোধ্য: এক পা নিয়েও হাঁটতে শেখা, দৌড়ানো, এবং জয়ী হওয়ার গল্প। বাধাকে জয় করে স্বপ্ন পূরণের মোটিভেশনাল বাংলা ছোট গল্প। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
শুরু হলো অদ্ভুত মৃত্যুর ধারা। একের পর এক করে গ্রামবাসী মারা যেতে লাগলো। সবাই বলতে লাগলো, এটা সেই মেয়েটিরই কামড়। কিন্তু কেউই তার সত্যিটা জানতে পারছিল না।
গ্রামের এক যুবক, অভিষেক, এই রহস্যের জট খোলার চেষ্টা করতে লাগলো। সে রাতের পর রাত জেগে থাকতো, গ্রামের প্রতিটি কোণে ঘুরে বেড়াতো। সে জানতে চাইল, এই মেয়েটি কে? কেন এতো মানুষের প্রাণ নিচ্ছে সে?
এক রাত, অভিষেক নদীর ধারে গেল। সে ভাবল, হয়তো এই রহস্যের কোনো কূল পাওয়া যাবে নদী থেকে। সে নদীতে নামল, জলের গভীরে তাকালো। হঠাৎ, তার চোখে পড়ল একটা জিনিস। নদীর তলদেশে, একটা পুরনো বাক্স।
অভিষেক বাক্সটি তুলে আনলো। বাক্সটি খুলে দেখল, ভিতরে একটা পুরনো ডায়েরি। ডায়েরিটিতে লেখা ছিল একজন মেয়ের কাহিনী। মেয়েটির নাম ছিল রাধা। সে রায়পুরেরই বাসিন্দা ছিল। এক সময় সে রূপকান্তি বাবুকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু রূপকান্তি বাবু তাকে ঠকিয়ে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে। সেই আঘাতে রাধা পাগল হয়ে যায়। একদিন সে নদীতে ডুবে মারা যায়। কিন্তু তার আত্মা নদীর তলায় বন্দি হয়ে যায়।
ডায়েরিতে আরও লেখা ছিল, রাধা প্রতিশোধ নিতে চায়। সে চায়, যারা তাকে কষ্ট দিয়েছে, তাদের সবাইকে শাস্তি দিতে। আর সেই কাজটাই সে এখন করছে।
অভিষেক বুঝতে পারল, রাধার আত্মাকে শান্তি দিতে হবে। সে নদীতে নেমে গেল। সে ডুবতে শুরু করল, ডুবতে থাকল। নদীর গভীরতম স্থানে পৌঁছে সে রাধার আত্মাকে ডাকল।
রাধার আত্মা তার ডাকে সাড়া দিল। সে অভিষেকের কাছে এলো। অভিষেক তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। সে বলল, রাধা তোমার প্রতিশোধ হয়ে গেছে, এবার তুমি শান্তিতে যাও।
রাধার আত্মা ধীরে ধীরে শান্ত হতে লাগলো। তারপর সে হাসল, একটা মৃদু হাসি। তারপর সে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সেই রাত থেকে রায়পুর গ্রামে শান্তি ফিরে আসলো। আর কখনোই সেই মেয়েটির ভয় দেখা গেল না। অভিষেকের সাহস আর মানবিকতার জয় হলো।