কুষ্টিয়ার মরিচ ঝালের মতো ঝাঁকুনি দেওয়া রোদের ঝলকানিতে ঈশানের চোখ ঝলসে গেল। ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়ির উঠোনে শিল্পকলার মেলা জমেছে। চারপাশে তাঁতের শাড়ি, মৃৎশিল্পের মূর্তি, আর স্বচ্ছন্দে আঁকা জলরং, সবকিছুই মুগ্ধ করে দিচ্ছে। কিন্তু, ঈশানের নজর আটকে গেল এক কোণে।
এক তরুণ শিল্পী, আনন্দিতা, গাঢ় লাল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর সামনে রয়েছে ‘অবলম্বন’ নামের এক বিমূর্ত চিত্র। ক্যানভাস জুড়ে নীল আর সবুজ রঙের খেলা। কিন্তু, ঈশানের মনে হলো এই রঙের খেলায় লুকিয়ে আছে আরো কিছু। চোখ সরিয়ে না নিয়ে সে খুঁজতে লাগলো সেই লুকানো রহস্য।
ঈশান, পেশায় লেখক, রহস্য উপন্যাসের জনপ্রিয় লেখক। বয়স হয়েছে ষাট ঊর্ধ্ব, কিন্তু কৌতূহল এখনো অম্লান। আনন্দিতার চিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে একটু পরেই তার মনে হলো নীল রঙের ঢেউয়ের মাঝে যেন এক জোড়া চোখের ইশারা দেখছেন। সবুজের ছোঁট ছোঁট আঁচড়ে যেন লুকিয়ে আছে কোনো এক মুখের রেখা।
চিন্তাভাবনা করতে করতে ঈশান আনন্দিতার কাছে গেলেন। “অসাধারণ চিত্র,” ঈশান বললেন, “কিন্তু, এই নীল আর সবুজের মাঝে কিছু লুকিয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে, ঠিক কি?”
আনন্দিতা হাসলেন, “আপনি ঠিক ধরেছেন। এই চিত্রটি আমার দাদুর স্মৃতি। ছোটবেলায় আমার দাদু আমাকে নিয়ে নীল আকাশের নিচে, সবুজ গাছের তলায় খেলা করতেন। এই চিত্রে আমি সেই স্মৃতিকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি।”
ঈশান অবাক হয়ে গেলেন। তিনি দেখছিলেন রহস্য, আর শিল্পী দেখিয়েছিলেন স্মৃতি। দুইয়ের মধ্যে এই বিরাট ফারাকটা তাকে চমকে দিল। কিন্তু, এবার তার মন কেমন জানি অস্থির হয়ে উঠলো। তিনি আবারো চিত্রের দিকে তাকালেন। এবারেও মনে হলো নীলের ঢেউয়ে চোখের ইশারা, সবুজের আঁচড়ে মুখের রেখা। কিন্তু, এবার কিছুটা পরিষ্কার লাগলো। যেন চোখ দুটো চিন্তিত, মুখের রেখায় যেন শোকের ছায়া।
ঈশান আনন্দিতাকে আর জিজ্ঞাসা করলেন না। তিনি জানতেন, শিল্পের ব্যাখ্যা শিল্পীর নিজেরই হওয়া উচিত। কিন্তু, তার মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। সেই চিন্তিত চোখ, সেই
রাতে লেখার টেবিলে বসে ঈশানের মন অস্থির। আনন্দিতার চিত্রের সেই লুকানো চেহারাটা তাকে কামড়ে ধরেছে। কে সেই ব্যক্তি, যার ছায়া এই অবলম্বনের নীল সবুজ রঙের মাঝে লুকিয়ে আছে? ঈশান কলম হাতে নিলেন, কিন্তু কাগজে কোনো শব্দ আঁকা পড়ল না। লেখকের মনের মধ্যে যখন গল্পের আঁধি উঠে না, তখন লেখা আসে না।
হঠাৎ, ঈশানের মনে পড়ল কুষ্টিয়ার রাজবাড়ির পাশেই আছে জমিদারদের পুরোনো বাড়িগুলো। সেখানে থাকেন আনন্দিতার দাদু, ঈশান তো তাঁর সঙ্গে দেখা করতেই পারেন।
পরের দিন সকালে ঈশান ঐ বাড়িগুলোর দিকে রওনা হলেন। পুরোনো, জীर्णশীর্ণ বাড়িগুলোর মাঝে একটা বাড়ির উঠোনে বসেছিলেন এক বৃদ্ধ। সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি পরনে, চোখে মোটা মোটা চশমা। ঈশান তাঁর কাছে গিয়ে সমস্ত কিছু জানালেন – আনন্দিতার চিত্র, নীল সবুজের মাঝে লুকানো চেহারা, আর তার নিজের কৌতূহল।
বৃদ্ধটি মলিন হাসলেন। “আপনি ঠিকই দেখেছেন,” তিনি বললেন, “ওই চিত্রে আমার ছেলের, আনন্দিতার দাদুর, ছায়া লুকিয়ে আছে।”
ঈশানের চোখ কপালে উঠল। “কিন্তু আনন্দিতা তো বললেন, এই চিত্রটি তাঁর দাদুর স্মৃতি…”
বৃদ্ধটির চোখ দুটি ভিজে উঠল। “আমার ছেলে বহু বছর আগে নিখোঁজ হয়ে গেছে। পুলিশ, সব খুঁজেছে, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। আনন্দিতা খুব ছোট ছিল তখন। আমি তাকে বোঝাতে পারিনি যে তার দাদু আর ফিরবেন না। তাই, এই বাড়ির পাশেই যে গাছতলায় আমরা খেলা করতাম, সেই স্মৃতির ছায়া ফুটিয়েছে সেই চিত্রে।”
ঈশানের বুকটা এমন করে উঠল যেন কেউ একটা পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। একটা নিখোঁজ হওয়া ছেলের স্মৃতি লুকিয়ে ছিল মেয়ের শিল্পে। রহস্যের খোঁজে লেখক ঈশান এসে পড়েছিলেন আরো বড় রহস্যের সামনে।
“আপনি কিছু স্মৃতিচিহ্ন, কোনো ছবি…?” ঈশান কথাটা শেষ করতে পারলেন না।
বৃদ্ধটি একটা পুরোনো আলমারি খুললেন। ভিতর থেকে বের করলেন একটি কাঠের বাক্স। খুলে দেখালেন একটা মলিন হয়ে যাওয়া ছবি। ছবিতে দুই কিশোর ছেলে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। একজনের হাতে ক্রিকেটের ব্যাট, আরেকজনের হাতে বল।
ঈশান ছবিটা হাতে নিলেন। চমকে উঠলেন। নীল সবুজের অবলম্বনে যে চিন্তিত চোখের ইশারা দেখেছিলেন, ঠিক সেই চোখ দুটো এই ছেলের চোখের মতো। ছবিতে হাসিমুখ ছেলেটির চোখ, এখন চিত্রে চিন্তিত চোখে পরিণত হয়েছে। ঈশানের মনে জাগলো প্রশ্নের ঝড়। কেন এই পরিবर्तন? নিখোঁজ হওয়ার আগে কিছু একটা ঘটেছিল?
ঈশান বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই ছেলেটি কে?”
বৃদ্ধটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “আমার ছোট ছেলে, সোম।”
“কিন্তু… আনন্দিতার দাদু তো…”
“আমার দুই ছেলে ছিল।” বৃদ্ধের গলা কাঁপতে লাগলো, “বড় ছেলে, অভিষেক, সেই নিখোঁজ হওয়া ছেলে। আর ছোট ছেলে সোম।”
এই কথায় ঈশান আরো একবার চমকে উঠলেন। দুই ভাই! তাহলে আনন্দিতা তার কোন দাদুর স্মৃতি ফুটিয়েছিলেন চিত্রে?
বৃদ্ধটি আরো কিছু বলার আগে ঈশান তাঁর কাছে থাকা ছবিটি দেখালেন, “এই ছবিতে যে ছেলেটি হাসছে, সে কি অভিষেক?”
বৃদ্ধ চোখেমুখ ফুঁলে উঠলেন, “হ্যাঁ, সেই আমার অভিষেক।”
ঈশানের মাথার মধ্যে চিন্তার জট পাকিয়ে গেল। আনন্দিতা যদি নিজের দাদুর স্মৃতি ফুটাতে চেয়েছিলেন, তাহলে এ চিত্রে কেন সোমের ছায়া লুকিয়ে আছে? আর নিখোঁজ হওয়া অভিষেকের ছবিতে কেন এমন হাসি? কোন রহস্য লুকিয়ে আছে এই দুই ভাইয়ের জীবনে?
ঈশান বৃদ্ধকে জানালেন, কীভাবে আনন্দিতার চিত্র তাঁকে এই রহস্যের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। বৃদ্ধ মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন। তারপর বললেন, “আপনি লেখক, সত্যিই। হয়তো আপনিই এই রহস্যের সমাধান করতে পারবেন। আমি সব জানি, কিন্তু বলতে পারি না। কারণ, সেই রাতের ঘটনাটা এখনো আমার বুকে জ্বলে।”
ঈশান বুঝতে পারলেন, বৃদ্ধের মনের মধ্যে গোপন কষ্ট আছে। হয়তো সেই রাতের ঘটনাই ছেলের নিখোঁজ হওয়ার কারণ। কিন্তু, ঈশান জানেন, জোর করে জিজ্ঞাসা করা ঠিক নয়। তিনি বৃদ্ধকে বিশ্রাম নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলেন।
মনে মনে ঈশান নিজের পরিকল্পনা চালাতে লাগলেন। আনন্দিতার চিত্র, নিখোঁজ অভিষেকের হাসিমুখ, আর বৃদ্ধের গোপন কষ্ট – এই সব কিছু যেন একটা জটিল গল্পের টুকরো টুকরো অধ্যায়। ঈশান লেখক, তিনি জানেন গল্পের সূত্র ধরতে হবে। আর সেই সূত্র খুঁজতে তিনি ফিরে গেলেন কুষ্টিয়ার রাজবাড়ির শিল্পকলার মেলায়।
কুষ্টিয়ার রাজবাড়ির মেলায় ফিরে ঈশান আনন্দিতার কাছে গেলেন। এবার তাঁর দৃষ্টি আগের চেয়ে অনেক দৃঢ়। “আপনার চিত্র ‘অবলম্বন’ অসাধারণ,” ঈশান বললেন, “কিন্তু, আমার মনে হয় এটি শুধু আপনার দাদুর স্মৃতি নয়, আরো কিছু লুকিয়ে আছে।”
আনন্দিতা চমকে গেলেন। “কী বলছেন আপনি?”
ঈশান তাঁকে নির্জন এক কোণায় নিয়ে গেলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, “আপনার দুই দাদু ছিলেন, ঠিক কি না?”
আনন্দিতা চোখ বড় বড় করে তাকালেন। “কীভাবে জানলেন?”
ঈশান তাঁকে সব খুলে বললেন – কীভাবে চিত্রের নীল সবুজের মাঝে লুকানো চেহারা তাঁকে খোঁজে বেরিয়েছিল জমিদার বাড়িতে, কীভাবে সেখানে আনন্দিতার কাকাকে দেখা করেছেন, আর তিনি কীভাবে জানিয়েছেন দুই ভাইয়ের কথা।
আনন্দিতা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর কাঁ声ে বললেন, “কাকা কখনো আমাকে বলেননি যে আমার আরেকজন দাদু ছিলেন।”
ঈশান মৃদু গলায় বললেন, “কিছু কথা হয়তো বলা যায় না। কিন্তু, আপনার চিত্রে যে চোখের ইশারা দেখেছি, আর আপনার কাকার ছবিতে যে হাসি দেখেছি, সে দুটোর মধ্যে একটা বিরাট ফারাক আছে।”
আনন্দিতা চিন্তাভাবনা করতে লাগলেন। একটু পরে বললেন, “আমার ছেলেবেলায় কাকা আমাকে একটা গল্প বলতেন। বলতেন, এক ঝড়ের রাতে দাদু অভিষেক হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। কেউ জানে না কোথায় গেলেন।”
ঈশান জিজ্ঞাসা করলেন, “আর কিছু বলতেন না?”
আনন্দিতা মাথা নাড়লেন, “না, আর কিছু বলতেন না। কিন্তু, একবার কাকার চোখে এক অদ্ভুত দুঃখ দেখেছিলাম। যেন কিছু লুকিয়ে রাখছেন।”
ঈশানের মনে হলো, এই হলো সেই সূত্র। অভিষেকের নিখোঁজ হওয়ার রাতের ঘটনাই হয়তো সেই রহস্যের মূল। তিনি আনন্দিতাকে অনুরোধ জানালেন, কাকার সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করতে। আনন্দিতা রাজি হলেন।
পরের দিন আবার ঈশান জমিদার বাড়িতে গেলেন। এবার বৃদ্ধকে দেখে মনে হলো একটু স্বস্তি পেয়েছেন। ঈশান তাঁকে জানালেন, কীভাবে আনন্দিতার চিত্র তাঁকে এই রহস্যের দিকে নিয়ে এসেছে, আর কীভাবে আনন্দিতা জানলেন তাঁর দুই দাদুর কথা।
বৃদ্ধ চোখ মুছলেন। “আমার বড় ছেলে অভিষেক, খুব সাহসী ছেলে ছিল। সেদিন ঝড়ের রাতে বাইরে বেরিয়েছিল। আর ফিরলো না। পুলিশ, সব খুঁজেছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।”
ঈশান জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু, আপনি কিছু লুকিয়ে রাখছেন, ঠিক কি না? আনন্দিতা বলেছে, সেদিন আপনার চোখে এক অদ্ভুত দুঃখ দেখেছিল।”
বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “হ্যাঁ, ছেলেকে হারানোর দুঃখের চেয়েও বড় দুঃখ লুকিয়ে আছে।” একটু থেমে তিনি বলতে লাগলেন, “সেদিন ঝড়ের রাতে গ্রামে চুরি হয়েছিল। জমিদার বাড়ির কিছু দামী জিনিসপত্র নিয়ে গেছে চোরেরা। অভিষেক সেই রাতেই চোরদের ধাওয়া করতে বেরিয়েছিল। কিন্তু, ফিরলো না।”
ঈশানের কপালে ভাঁজ পড়ল। “কিন্তু, চুরির কথা কেউ জানে না কেন?”
“পুলিশকে জানানো হয়নি।” বৃদ্ধের গলা কাঁপতে লাগলো, “কারণ, চোরেরা জমিদার বাড়িরই একজন লোক ছিল। আমার ভয় ছিল, যদি জানানো হয়, তাহলে ঐ লোকের পরিবারের মর্যাদা নষ্ট হয়ে যাবে।”
এই কথায় ঈশান চমকে উঠলেন। জমিদার বাড়িরই লোক চুরি করেছে? আর সেই রহস্য লুকিয়ে রাখতেই কি অভিষেকের নিখোঁজ হওয়ার কথা সবার জানানো হয়নি? কিন্তু, তাহলে অভিষেকের হাসিমুখ চবিটা কী বলে? সে কি চুরির কথা জানতো? আর যদি জেনে থাকে, তাহলে কি চোরেরা…?
ঈশানের মনের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর সন্দে জাগল। তিনি বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার মনে আছে, সেই চোর কে ছিল?”
বৃদ্ধ চোখ নীচু করে বললেন, “হ্যাঁ, মনে আছে।”
ঈশান জোর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “কে সেই ব্যক্তি?”
বৃদ্ধ একটা নাম মুখ ফুঁপিয়ে বললেন। ঈশান চমকে উঠলেন। সেই নামটা ছিল সোমের, অর্থাৎ আনন্দিতার কাকার নাম।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ঈশান জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি সোমকে সন্দেহ করেছিলেন?”
বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। “না, পারিনি। সোম আমার ছোট ছেলে। আমি তাকে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, এখন…” বৃদ্ধের গলা ভেঙে গেল।
ঈশান বুঝতে পারলেন, বৃদ্ধের মনে একটা দ্বন্দ্ব চলছে। ছেলের প্রতি মায়া আর সত্যের মধ্যে। ঈশান তাঁকে আর জিজ্ঞাসা করলেন না। তিনি বুঝলেন, এখন তাঁকে নিজের মতো করে তদন্ত চালাতে হবে।
পরের কয়েকদিন ঈশান গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বললেন। তিনি জানার চেষ্টা করলেন, সেই ঝড়ের রাতের ঘটনা সম্পর্কে কারো কিছু জানা আছে কিনা। কিন্তু, সবাই অজ্ঞতা প্রকাশ করল। শুধু একজন বৃদ্ধ জানালেন, সেদিন রাতে জমিদার বাড়ির কাছে চিৎকার শুনেছিলেন। কিন্তু, ঝড়ের গোঙানোর মধ্যে তিনি ঠিক বুঝতে পারেননি।
এই নতুন তথ্যে ঈশানের সন্দে আরো দৃঢ় হলো। তিনি আনন্দিতার কাছে গিয়ে জানালেন, তাঁর তদন্তের ফলাফল। অভিষেকের নিখোঁজ হওয়ার রাতের চুরির কথা, এবং তাঁর কাকা সোমের সম্পর্কিত সন্দে। আনন্দিতা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। নিজের কাকাকে চোর সন্দেহ করা তাঁর পক্ষে কঠিন ছিল। কিন্তু, ঈশানের কাছে প্রাপ্ত তথ্যগুলোও উপেক্ষা করা যায় না।
অবশেষে, ঈশান সিদ্ধান্ত নিলেন পুলিশের সাহায্য নেওয়ার। তিনি স্থানীয় থানায় গিয়ে গোটা ঘটনা জানালেন। পুলিশ অফিসার, অতীত ঘটনা নিয়ে তদন্ত শুরু করতে কিছুটা দ্বিধা করলেও, ঈশানের জোরাজোরিতে রাজি হলেন।
পুলিশ জমিদার বাড়িতে এসে তল্লাশি চালালো। বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা জিনিসপত্রের ভিড়ের মধ্যে, গোপন কক্ষের এক কোণায় পুরনো কাপড়ে ঢাকা কিছু মূর্তি পাওয়া গেল। সেগুলোই ছিল সেই চুরি হয়ে যাওয়া জমিদার বাড়ির দামি জিনিস।
পুলিশ সোমকে জিজ্ঞাসাবাদ করল। সোম অস্বীকার করতে পারলেন না। চাপের মুখে তিনি সব স্বীকার করলেন। কিন্তু, অভিষেকের নিখোঁজ হওয়ার সাথে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানালেন।
সোমের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, অভিষেক চোরাকারবারের সময় তাকে চিনতে পেরেছিল। সোম লাঞ্ছনার ভয়ে অভিষেককে চुप করিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, অভিষেক সত্যিটা প্রকাশ করতে দৃঢ় ছিলেন। এই জেদ ধস্তাধস্তির মধ্যে দুর্ঘটনাক্রমে অভিষেক ঠেলে পড়ে জমিদার বাড়ির পুরনো, জল ভরা কূপে। সোম, ভয় পেয়ে সেই রাতে লাশ গোপন করে পালিয়ে যান।
সত্য উদঘাটনের পর, ঈশানের মনে এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এলো। অবশেষে, ষাট বছরের পুরনো রহস্যের সমাধান হলো। আনন্দিতার চোখের নীল সবুজ রঙের অবলম্বনে লুকিয়ে থাকা চিন্তিত চোখ দুটির কাহিনী সবার সামনে এলো।
কয়েকদিন পর, জমিদার বাড়ির পুরনো কূপ থেকে অভিষেকের কঙ্কাল উদ্ধার করা হলো। পুলিশ তদন্তের পর, সোমকে গ্রেফতার করা হলো।
ঈশান ঠিক করেছিলেন, এই গল্পটি লেখার। তিনি টাইটেল দেবেন – “অবলম্বনের চোখ”। এই গল্পটি হবে শুধু রহস্য
নয়, এটি হবে শিল্পের গভীরতা, সত্যের সন্ধান, এবং নিঃশব্দ চিৎকারের কাহিনী। এ গল্পে ঈশান দেখিয়ে দেবেন, কীভাবে একজন শিল্পী অজান্তেই তার চেতনায় গেঁথে থাকা স্মৃতি ও অস্বীকারকে তুলির স্পর্শে ফুটিয়ে তোলে। আনন্দিতার ‘অবলম্বন’ ক্যানভাসে অজান্তেই দুই ভাইয়ের সম্পর্কের জটিলতা, নিঃশব্দ চিৎকার, আর অসমাপ্ত কথা ফুটে উঠেছিল।
লেখা শেষ করার পর ঈশান মনে মনে ভাবলেন, এই গল্পটি হয়তো আনন্দিতাকে আরো বেশি নিজের শিল্পের গভীরতা উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে। এটি তাকে দেখাবে, কীভাবে তার অবচেতন মন ক্যানভাসে এমন সত্য ফুটিয়ে তুলতে পারে, যা সে নিজে, হয়তো, জানতেনই না।
কুষ্টিয়ার শিল্পকলার মেলা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু, ঈশানের মনের মধ্যে ‘অবলম্বনের রহস্য’ এখনো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। এটি তাঁকে শিখিয়েছে, শিল্প কেবল সৌন্দর্য নয়, সত্যের অন্য এক স্তর খুঁজে বের করার এক অসাধারণ মাধ্যম।