প্রথম অধ্যায়: রহস্যের জাল
চাঁদের আলো তখন মেঘের আড়ালে লুকিয়েছে। রাত যেন এক কালো চাদরে নিজেকে ঢেকে রেখেছে। হিমেল হাওয়ায় শিউলির শাড়ি উড়ে যাচ্ছে, আর তার চুলগুলো মুখের চারপাশে জট পাকাচ্ছে। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এক পুরোনো, জীর্ণ সেতুর উপর। সেতুটি যেন কোনো প্রাচীন ভুতুড়ে গল্পের অংশ, যেখানে প্রতিটি ইট আর কাঠের উপর ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাস জমে আছে। সেতুর নীচে নদীর কালো জল একেবারে স্থির, যেন এক গভীর শোকের চিহ্ন বহন করছে। জায়গাটি নীরব, অথচ সেই নীরবতায় অদ্ভুত এক শব্দ লুকিয়ে আছে, যা শিউলির মনে ভয় জাগায়।
সোনা, তার প্রিয় বন্ধু, কয়েক সপ্তাহ আগেই এই সেতু থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল। পুলিশ বলেছে, এটা আত্মহত্যা। কিন্তু শিউলির মন বিশ্বাস করতে চাইছে না। সোনা ছিল এক শক্ত মনের মেয়ে, যে জীবনের সব ঝড় মোকাবিলা করেছিল। তার আচমকা আত্মহত্যা, তাও এই অন্ধকার সেতু থেকে, শিউলির মনে অনেক প্রশ্ন তুলেছে। কেন সে এই সেতুকে বেছে নিল? কেন সে নদীর গভীরে নিজেকে হারিয়ে ফেলল?
শিউলির মাথায় বারবার সেদিনের ঘটনাগুলো ভেসে উঠছে। সোনার হাসিখুশি মুখ, তার চোখে আনন্দের ঝিলিক—কোনোভাবেই এই চেহারার সঙ্গে আত্মহত্যার মিল পাওয়া যায় না। সেতুর বাতাস যেন আজ আরও ভারী, আর রাতের অন্ধকার তার মনকে আরো গভীর দুঃশ্চিন্তায় ডুবিয়ে দিচ্ছে।
শিউলি নিজেকে সেতুর রেলিং ধরে সামলানোর চেষ্টা করছিল। হঠাৎ, বাতাসে কেমন একটা শীতল স্পর্শ অনুভব করল সে। কেউ যেন তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল এক বৃদ্ধা মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। মহিলার মুখে এক অদ্ভুত ধরণের হাসি, যা শিউলির মনের ভেতর অজানা আতঙ্ক ঢেলে দিল।
“তুমি কি সোনার কথা ভাবছ?” মহিলার কণ্ঠে গভীরতা, যা রাতের নীরবতাকে ভেঙে দিল।
“আপনি কে?” শিউলির কণ্ঠে স্পষ্ট ভয়।
“আমার নাম রেখা। আমি সোনার শেষ সময়ের কথা জানি,” বৃদ্ধা বললেন। তার চোখের দৃষ্টি যেন শিউলির ভেতরে কোথাও গভীরভাবে তাকিয়ে আছে।
“আপনি কী বলতে চান?” শিউলি ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করল। তার মনে ভয় আর কৌতূহল মিশে গেছে।
“সোনা আমাকে বলেছিল, কেউ তাকে খুন করতে চেয়েছিল,” রেখা বললেন, তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত নিশ্চিততা।
এই কথা শুনে শিউলির মনে যেন বজ্রপাত হল। “কী বলছেন? পুলিশ বলেছে, এটা আত্মহত্যা!”
“সবকিছু কি পুলিশ জানে?” রেখা শীতল হেসে বললেন। “সোনা আমাকে বলেছিল, তার জীবন বিপদে। সে ভয় পেত। কিন্তু সে তোমাকে এসব বলেছিল কি?”
শিউলি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। সত্যিই, সোনা তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে বেশ উদভ্রান্তের মতো আচরণ করছিল। সে বলেছিল, “এক বৃদ্ধ লোক আমাকে তাড়া করছে। আমি জানি না কেন, কিন্তু সে আমাকে খুন করবে।”
“আমাকে সাহায্য করতে হবে,” রেখা বললেন। “সোনা আমাকে কিছু ইঙ্গিত দিয়েছিল। কিন্তু আমি একা এ রহস্যের সমাধান করতে পারব না। আমাদের সেই বৃদ্ধ লোকের সন্ধান করতে হবে, যার নাম ছিল হরিদাস। সোনা তার কথা বলেছিল।”
রেখার কথা শুনে শিউলির মন আবার অস্থির হয়ে উঠল। এই রহস্যের মধ্যে এক গভীর ছায়া লুকিয়ে আছে, যা তাকে আরও টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একই সঙ্গে তার মনের ভেতরে ভয়ও চেপে বসছে। রাতের নিঃসঙ্গতা, সেতুর জীর্ণ পরিবেশ আর রেখার এই অদ্ভুত কথা—সব মিলিয়ে শিউলির মনে যেন এক দমবন্ধ করা অনুভূতি তৈরি হচ্ছে।
“তোমার সাহস আছে কি, এই রহস্য উদঘাটন করার?” রেখা প্রশ্ন করলেন।
শিউলি চুপ করে রইল। তার মনে চলছিল এক দ্বন্দ্ব—সে কি সত্যিই প্রস্তুত এই গভীর রহস্যের মুখোমুখি হওয়ার জন্য? কিন্তু সোনা তার প্রিয় বন্ধু ছিল। তার জন্য সে সব কিছু করতে পারে। ওরা স্থানীয় হরিদাস মিস্ত্রির বাড়ি গেল আরো কিছু তথ্যের জন্য।
রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প - রাত্রির কান্না: "রাত্রির কান্না" একটি রহস্য রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প যেখানে ঠাকুরবাড়ির গোপন ষড়যন্ত্র, হত্যা ও ন্যায়ের লড়াই উন্মোচিত হয়। গোয়েন্দা অশ্বিনী সেনের নেতৃত্বে সত্যের সন্ধান উঠে আসে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
দ্বিতীয় অধ্যায়: রহস্যের পথচলা
রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছিল। হরিদাস মিস্ত্রির বাড়ি থেকে ফিরে আসার পরেও শিউলি এবং রেখার মন শান্ত হয়নি। তাদের মাথায় বারবার ঘুরছিল হরিদাসের বলা কথাগুলো—”সোনা ভয় পেয়েছিল। কেউ তাকে অভিশাপ দিয়েছে।” অভিশাপ? শিউলির মনে সন্দেহের বীজ আরও গভীরভাবে বপন হল। রেখা তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “আমাদের সঠিক পথ বেছে নিতে হবে। এত সহজে এই রহস্যের সমাধান হবে না।”
তারা ঠিক করল, প্রথমে সোনার জীবনের প্রতিটি ধাপ খুঁটিয়ে দেখা হবে। শিউলির কাছে সোনার বেশ কয়েকটি পুরোনো ছবি এবং ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ছিল। সেই রাতেই তারা শিউলির বাড়িতে বসে ছবি আর চিঠি ঘাঁটতে শুরু করল। ছবি দেখতে দেখতে শিউলির চোখ থমকে গেল একটি অচেনা মুখের উপর। সোনা একটি মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল, তার মুখে ছিল এক অদ্ভুত উদ্বেগ। ছবিটির পেছনে লেখা ছিল: “কুসুম – আমার বন্ধু, আমার ছায়া।”
“কুসুম? ও কে?” শিউলি প্রশ্ন করল। রেখা চুপ করে ছবিটা হাতে নিল। “তোমার মনে হয়, এই কুসুম সোনার জীবনের কোনও বড় রহস্য হতে পারে?” রেখার চোখে ছিল গভীর চিন্তার ছাপ।
এরপর তারা সিদ্ধান্ত নিল, কুসুম সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সোনার পুরোনো ডায়েরি খুলে তারা এমন কিছু নোট পেল, যা তাদের নতুন পথের দিশা দেখাল। সোনার ডায়েরির এক পাতায় লেখা ছিল: “কুসুম জানে সবকিছু। কিন্তু ও কিছু বলবে না। ভয় পায়।” এই লেখাগুলো শিউলির মনে আরও অশান্তি তৈরি করল। রেখা তার অভিজ্ঞতা থেকে বলল, “আমাদের আগে কুসুমকে খুঁজতে হবে। যদি সে এখনও বেঁচে থাকে, তবে তার কাছ থেকে সত্য জানা যাবে।”
পরদিন তারা বের হল কুসুমের সন্ধানে। বিভিন্ন মানুষের কাছে খোঁজ নিয়ে তারা জানতে পারল, কুসুম আগে এই শহরেরই এক কোণে থাকত, কিন্তু অনেক বছর ধরে তার কোনও খোঁজ নেই। কেউ কেউ বলল, সে পাগল হয়ে গেছে, কেউ বলল, সে কোথাও হারিয়ে গেছে।
তাদের খোঁজ চালিয়ে যেতে থাকতে এক সন্ধ্যায় তারা পৌঁছাল শহরের এক পুরোনো বাড়ির কাছে। এটি ছিল প্রায় ধ্বংসের পথে, চারিদিকে আগাছা আর ধূলায় ভরা। বাড়িটির সামনে একটি বৃদ্ধা বসে ছিল, যেন কোনও কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে। শিউলি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি কুসুমকে চেনেন?” বৃদ্ধার চোখ বড় হয়ে গেল। “কুসুম? ও এখানে ছিল। কিন্তু ও আর নেই।”
“আর নেই মানে? ও কি মারা গেছে?” শিউলির প্রশ্নে বৃদ্ধা চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “ও চলে গেছে। ওর মাথায় ছিল অনেক কথা। বলত, কেউ ওকে তাড়া করছে। তুমি যদি ওর খোঁজ করতে চাও, তাহলে সাবধানে থেকো। কারণ ওর গল্প এখনও শেষ হয়নি।”
বৃদ্ধার এই কথা শুনে শিউলি ও রেখা আরও চঞ্চল হয়ে উঠল। তারা ঠিক করল, এই পুরোনো বাড়িটাই হতে পারে কুসুমের জীবনের কোনও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তারা সেই রাতেই বাড়িটির ভেতরে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিল।
অন্ধকারের মধ্যে, তারা টর্চের আলো নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল। বাড়ির ভেতর যেন সময় থেমে ছিল। দেওয়ালে পুরোনো ছবি আর কাগজের টুকরো, মেঝেতে ভাঙা আসবাব। একটা ঘরে ঢুকে তারা দেখল, দেয়ালে কিছু লেখা রয়েছে। রেখা টর্চের আলো ফেলতেই তাদের চোখে পড়ল বড় বড় অক্ষরে লেখা: “মৃত্যু আমার ছায়া। সত্যি জানতে চাইলে ভয় পেতে শেখো।”
শিউলির মনে হল, যেন তার রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে। রেখা বলল, “এটা কুসুমের লেখা হতে পারে। ও কি বলতে চেয়েছিল?” তারা দেয়ালের লেখাগুলো নোট করতে লাগল। হঠাৎই এক ঝোড়ো হাওয়া এসে দরজা বন্ধ করে দিল। ঘরটা যেন এক মুহূর্তে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল।
“আমরা কি ভুল জায়গায় এসেছি?” শিউলি ভয়ে বলল। রেখা তার হাত ধরে বলল, “ভয় পেও না। আমরা সত্যি জানার জন্য এখানে এসেছি। আমাদের পথ খুঁজে বের করতেই হবে।”
এই অভিজ্ঞতা তাদের মনে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিল। কুসুম যদি সত্যিই জানত, তবে কেন সে এমন ভয়ঙ্করভাবে নিজের জীবন থেকে হারিয়ে গেল? সোনার মৃত্যুর সঙ্গে কুসুমের কী সম্পর্ক? তারা জানত, এই রহস্য আরও গভীর।
তাদের সামনে ছিল অজানা বিপদের হাতছানি, কিন্তু শিউলি আর রেখা ঠিক করল, তারা থামবে না। কারণ সোনার জন্যই তাদের এই সত্যের খোঁজে যাত্রা শুরু। আর এই যাত্রা এখন তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
তৃতীয় অধ্যায়: রহস্যের আঁধার
শীতের সন্ধ্যা। আকাশে মেঘ জমেছিল, আর হালকা ঠান্ডা বাতাস শিউলির শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছিল। রেখা তার হাতে একটি পুরোনো ডায়েরি নিয়ে বসেছিল। ডায়েরিটি ছিল সোনার। রেখা ধীরে ধীরে বলল, “সোনা মাঝে মাঝে এক বাইরের লোকের সঙ্গে দেখা করত। লোকটি হরিদাসের বাড়ির কাছেই থাকত।” রেখার কথাগুলো শিউলির মনকে চঞ্চল করে তুলল।
“তাহলে, এই লোকটি কি সোনার মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত?” শিউলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রশ্ন করল। রেখার উত্তর শিউলির মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিল। সোনার এই গোপন জীবনের গল্প আগে কখনও শোনা যায়নি। কে ছিল এই লোক? কেন সোনা তার সঙ্গে দেখা করত?
শিউলি আর রেখা সিদ্ধান্ত নিল, তাদের তদন্ত এখান থেকেই শুরু হবে। তারা রাতেই হরিদাসের বাড়ির পাশের এলাকায় খোঁজ করতে বেরোল। অন্ধকার রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের আলো আবছা হয়ে ছিল, আর চারপাশে ছিল অদ্ভুত নীরবতা। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ যেন রহস্যের এক নতুন দরজা খুলে দিচ্ছিল।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তারা জানতে পারল, সোনা মাঝে মাঝে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় যেত। সেখানে সে এক অজানা পুরুষের সঙ্গে দেখা করত। আশ্চর্যের বিষয় হল, এই পুরুষটির সঙ্গে হরিদাসের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
“তাহলে সোনা কেন এই জায়গায় যেত? আর এই পুরুষটা কে?” শিউলি জোর গলায় বলল। রেখা তার কাঁধে হাত রাখল। “আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে, শিউলি। এত সহজে আমরা উত্তর পাব না।”
তারা যেই জায়গাটির কথা শুনেছিল, সেখানেই পৌঁছানোর চেষ্টা করল। জায়গাটি ছিল এক নির্জন বাগানবাড়ি, যা বছরের পর বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বাগানবাড়ির চারপাশে ছিল কাঁটাতারের বেড়া, আর ঘাস এতটাই বড় হয়ে গেছে যে হাঁটাচলা করাও কঠিন।
“এখানে কি সোনা আসত?” শিউলি ফিসফিস করে বলল। রেখা হাত দিয়ে বেড়ার একটি অংশ সরিয়ে ভিতরে ঢুকল। “দেখি, ভেতরে কিছু পাওয়া যায় কি না।”
ভেতরে ঢুকে তারা দেখতে পেল, একটি পুরোনো কাঠের বেঞ্চ, যা অনেকদিনের অব্যবহারে ভেঙে পড়ার অবস্থায়। বেঞ্চটির পাশে ছিল কিছু পায়ে চলা পথের দাগ। “তুমি দেখেছ? এখানে অনেকবার পায়ের দাগ রয়েছে। কেউ না কেউ এখানে আসত।” রেখা বলল।
শিউলি বেঞ্চটির কাছে গিয়ে মাটি থেকে একটি ছোট ধাতব টুকরো তুলে নিল। সেটি ছিল একটি লকেট। লকেটের মধ্যে একটি ছবি ছিল—এক তরুণ পুরুষ, যার মুখে ছিল গভীর দুঃখের ছাপ। “এটা কে হতে পারে? সোনার সঙ্গে এই লোকটির কী সম্পর্ক?” শিউলি লকেটটি হাতে ধরে গভীরভাবে ভাবতে লাগল।
তারা সেদিনই স্থির করল, এই লোকটির পরিচয় খুঁজতে হবে। হরিদাসকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে আরও একবার। কারণ তার বাড়ির আশপাশেই হয়তো লুকিয়ে রয়েছে এই রহস্যের মূল সূত্র।
পরের দিন সকালে, শিউলি আর রেখা হরিদাসের কাছে গেল। তার বয়সের ভারে ন্যুব্জ শরীর আর কাঁপা কাঁপা গলায় হরিদাস বলল, “আমি ওই ছেলেটিকে চিনি। সোনা তার সঙ্গে দেখা করত, কিন্তু আমার থেকে সব লুকিয়ে রাখত। আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু সে কিছু বলত না।”
“তাহলে সোনা কি ভয়ে ছিল?” রেখা জানতে চাইল।
হরিদাস কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “হ্যাঁ, সে ভয় পেত। সে বলেছিল, কেউ তাকে খুন করতে চায়। কিন্তু কে, সেটা কখনও বলেনি।”
এই কথা শুনে শিউলির মনে সন্দেহের আরেকটি দিক খুলে গেল। সোনা কি সত্যিই বিপদে ছিল? আর সেই বিপদ কি তার মৃত্যুর কারণ?
তারা আরও খোঁজ শুরু করল। হঠাৎই শিউলির মনে পড়ল সোনার ডায়েরির কথা। সেদিন রাতে, শিউলি ডায়েরি খুলে বসে পড়ল। পাতায় পাতায় লেখা ছিল সোনার মনের কথাগুলো—তার ভয়, তার ব্যথা আর তার গোপনীয়তা।
ডায়েরির একটি পাতা খুলতেই শিউলির চোখ থমকে গেল। সেখানে লেখা ছিল:
“আমার কাছে সময় নেই। আমি জানি, তারা আমাকে দেখতে চায় না বাঁচতে। কিন্তু আমি কথা দিয়েছি, আমি শেষ পর্যন্ত সত্যি লুকিয়ে রাখব।”
ডায়েরির এই লাইন শিউলির মনের গভীরে এক অদ্ভুত শীতলতা আনল। সে রেখার দিকে তাকিয়ে বলল, “সোনা জানত, তার জীবন বিপদে। আর সে ইচ্ছা করেই সবকিছু লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কেন?”
তাদের তদন্তের পথ আরও গভীর হয়ে গেল। প্রতিটি নতুন তথ্য তাদের নতুন রহস্যের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছিল। শিউলি আর রেখা জানত, এই যাত্রা সহজ হবে না। কিন্তু তারা ঠিক করেছিল, সত্যিটা বের না করা পর্যন্ত তারা থামবে না।
রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প - রক্তকলমের রহস্য: "রক্তকলমের রহস্য" একটি রহস্য রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প, যেখানে সোনা ও কিং একটি অভিশপ্ত রক্তমাখা কলমের ভয়ানক সত্য উন্মোচন করে। গল্পে রহস্য, ভৌতিক থ্রিল এবং সাহসিকতার সমাহার। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
চতুর্থ অধ্যায়: সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা
নভেম্বরের হিমেল সকাল। শিউলি এবং রেখা এককাপ চায়ের তাপে নিজেদের সাহস সঞ্চার করছিল। সোনার মৃত্যুর রহস্য যেন তাদের প্রতিটি মুহূর্তকে গ্রাস করছিল। রেখার হাতে ছিল সোনার পুরোনো চিঠিগুলোর একটি গুচ্ছ, যেখানে অস্পষ্টভাবে লেখা কিছু লাইন তাদের আরো বিভ্রান্ত করে তুলেছিল।
“সোনা লিখেছিল যে একজন পুরুষ তাকে ভয় দেখাচ্ছে। কিন্তু সে কে?” শিউলি নিজেকে প্রশ্ন করছিল। রেখা হঠাৎ বলে উঠল, “হরিদাস মিস্ত্রির কাছে যাওয়া যাক। তিনি হয়তো আমাদের কিছু সাহায্য করতে পারবেন।”
তারা তৎক্ষণাৎ হরিদাস মিস্ত্রির ছোট্ট মাটির বাড়িতে হাজির হলো। হরিদাস, যিনি সবসময় কিছুটা নির্লিপ্ত থাকেন, আজ একটু উদ্বিগ্ন দেখালেন। শিউলির চাপের মুখে তিনি একসময় মুখ খুললেন।
“সোনা একজন পুরুষের সঙ্গে দেখা করত। তার নাম ছিল দেবানন্দ। সে ছিল একজন পত্রিকার সাংবাদিক। তবে তার একটি গোপন ইতিহাস আছে। সোনা তাকে বিশ্বাস করত, কিন্তু দেবানন্দের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী ছিল, তা আমি জানি না,” হরিদাস বলে উঠলেন।
দেবানন্দের নাম শোনামাত্রই শিউলির মনে একটি অদ্ভুত অনুভূতি জাগল। এই ব্যক্তি কি সোনার ভয়ের কারণ? তিনি কি সত্যিই সোনার মৃত্যুর পেছনে জড়িত? রেখা বলল, “আমাদের দেবানন্দের খোঁজ করতে হবে।”
দু’দিন ধরে তারা দেবানন্দ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করল। জানতে পারল, তিনি একজন খ্যাতনামা সাংবাদিক ছিলেন, যিনি অতীতের কিছু রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি ফাঁস করেছিলেন। কিন্তু কয়েক বছর আগে, তিনি হঠাৎ করেই চুপচাপ হয়ে যান এবং নিজের জীবন থেকে সরে যান।
একদিন বিকেলে, তারা দেবানন্দের বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ল। দরজা খুলতেই দেখা গেল এক মধ্যবয়সী লোক। তার চোখে ছিল গাঢ় ক্লান্তি আর মুখে রহস্যময় হাসি। “আপনারা কে?” তিনি কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
শিউলি নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, “আমরা সোনার মৃত্যুর বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করতে এসেছি। আপনাকে কি সোনা চিনত?”
দেবানন্দ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “হ্যাঁ, সোনা আমাকে চিনত। আমরা একসঙ্গে কিছুদিন কাজ করেছিলাম। তবে আমি তার মৃত্যুর বিষয়ে কিছু জানি না।”
শিউলি এবং রেখা তার কথায় বিশ্বাস করতে পারছিল না। তারা আরও চাপ প্রয়োগ করল। একসময় দেবানন্দ বলল, “সোনা নিজেই তার জীবনের শেষ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আমি তাকে বাধা দিতে পারিনি।”
এই কথাগুলো শিউলির মনে নতুন সন্দেহের জন্ম দিল। সোনা কি সত্যিই আত্মহত্যা করেছিল? নাকি তার মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে?
তারা দেবানন্দের ঘরটি নজরে রাখছিল। ঘরে একটি ডেস্ক ছিল, যেখানে কয়েকটি ফাইল এবং পুরোনো নথি এলোমেলোভাবে ছড়ানো ছিল। শিউলির চোখ পড়ে একটি নীল রঙের ফাইলের উপর, যেখানে সোনার নাম লেখা ছিল।
“আপনি কি এই ফাইলটি আমাদের দেখতে দেবেন?” শিউলি জিজ্ঞাসা করল। দেবানন্দ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, “নিন, দেখুন। তবে সাবধানে।”
ফাইলটি খুলে তারা দেখতে পেল সোনার লেখা কিছু পত্র এবং কিছু ফটোগ্রাফ। একটি ফটোগ্রাফে দেখা গেল সোনা এবং দেবানন্দ একটি নির্জন বাগানে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাদের মুখের অভিব্যক্তি ছিল অদ্ভুত—একটি চাপা ভয় এবং অস্বস্তি স্পষ্টতই দৃশ্যমান।
“এটা কোথায় তোলা হয়েছিল?” রেখা জিজ্ঞাসা করল।
“সোনার বাড়ির কাছেই। সেদিন সে আমাকে বলেছিল, তার জীবনে কিছু বড় পরিবর্তন আসতে চলেছে। কিন্তু সেই পরিবর্তন কী ছিল, আমি জানি না।” দেবানন্দ উত্তর দিল।
এই নতুন তথ্য শিউলিকে এক অজানা দ্বন্দ্বে ফেলল। সোনা কি কোনো বিপদজনক সত্য ফাঁস করতে চেয়েছিল? আর সেই কারণেই কি তাকে ভয় দেখানো হয়েছিল?
সন্ধ্যার অন্ধকারে শিউলি আর রেখা একসঙ্গে বসে নতুন তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করছিল। তাদের মনে হচ্ছিল, সোনার মৃত্যু নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়। তার পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র।
“আমাদের এই তদন্ত বন্ধ করা চলবে না। আমরা সত্যিটা উদঘাটন করব,” শিউলি দৃঢ় কণ্ঠে বলল। রেখা তার পাশে বসল।
তাদের যাত্রা এখনো অনেক বাকি। কিন্তু এই পথের প্রতিটি পদক্ষেপ তাদের রহস্যের কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছে। সত্য এখন তাদের হাতের নাগালে। কিন্তু এই সত্য জানার জন্য তাদের কি আরও বড়ো ঝুঁকি নিতে হবে?
রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প - অধরা জীবন: অজিত মিত্র, একজন অসফল লেখক, তার নামের একজন খ্যাতিমান লেখকের সাথে দেখা করেন। ঈর্ষায় অন্ধ হয়ে, সে তার জীবন চুরি করার চেষ্টা করে। কিন্তু তার কি ভাগ্য সঙ্গ দেবে? – রহস্য রোমাঞ্চে ভরা এক বাংলা গল্প! সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
পঞ্চম অধ্যায়: অন্ধকার সত্য
এক ঝড়ের রাতে, শিউলি তার ডেস্কের সামনে বসে সোনার পুরোনো চিঠিগুলো ঘাঁটছিল। একটি চিঠি হঠাৎ তার চোখে পড়ে, যা আগে সে দেখেনি। চিঠিটির কাগজে বয়সের দাগ পড়েছে, কিন্তু তাতে লেখা প্রতিটি শব্দ যেন নতুন করে রহস্য উন্মোচনের ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
“আমি জানি, কিছু লোক আমাকে খুন করতে চাচ্ছে, তবে আমি জানি না তারা কেন আমাকে ঘিরে রেখেছে।”
চিঠিটি পড়ার পর শিউলির শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। “এটা কীভাবে সম্ভব? সোনা কী জানত যে তার মৃত্যু পরিকল্পিত ছিল?” সে নিজেকেই প্রশ্ন করল। রেখাকে ডেকে এনে চিঠিটি দেখাল। রেখা গভীর মনোযোগ দিয়ে চিঠিটি পড়ল।
“তাহলে সোনার মৃত্যুর পেছনে নিশ্চয়ই আরও গভীর কোনও ষড়যন্ত্র রয়েছে,” রেখা বলল। “এবার আমাদের এই রহস্যের শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে।”
তারা তখনই সিদ্ধান্ত নেয়, সোনার জীবনের প্রতিটি দিক খুঁটিয়ে দেখবে। তারা সোনার ব্যক্তিগত ডায়েরি, ফোন রেকর্ড এবং তার পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। একের পর এক তথ্য উঠে আসতে শুরু করল। সোনা তার শেষ দিনগুলোতে বেশ অস্বাভাবিক আচরণ করছিল। সে অনেকের কাছেই বলেছিল, “আমি একটা নতুন জীবন শুরু করব।”
এই তথ্য শুনে শিউলি এবং রেখা বুঝতে পারল যে সোনা মৃত্যুর আগে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেনি। বরং সে একটি নতুন শুরু করতে চেয়েছিল। তাহলে তাকে কে বাধা দিল?
তারা আরও অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারল যে সোনা তার শেষ দিনগুলোতে একটি অদ্ভুত লোকের সঙ্গে বারবার দেখা করত। তার নাম ছিল অর্জুন। অর্জুন একজন বিতর্কিত ব্যবসায়ী, যার নামে নানা রকম বেআইনি কাজের অভিযোগ ছিল। তবে সোনার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী ছিল?
একদিন তারা অর্জুনের বাড়ির কাছে গিয়ে কিছু সন্দেহজনক লোকজনের কথোপকথন শুনতে পায়। একজন বলছিল, “আমাদের কাজ ঠিকমতো শেষ হয়েছে। তবে এই মেয়েটি আমাদের পেছনে কী জানি রেখে গেছে।” শিউলি এবং রেখা একে অপরের দিকে তাকাল।
“এবার বোঝা যাচ্ছে,” শিউলি ফিসফিস করে বলল। “অর্জুন এবং তার লোকজনই সোনার মৃত্যুর জন্য দায়ী। কিন্তু সোনা তাদের বিরুদ্ধে কী এমন জানত যা তাকে জীবন হারাতে বাধ্য করল?”
তারা আবার দেবানন্দের কাছে যায়। দেবানন্দ, যিনি প্রথম থেকেই রহস্যময় আচরণ করছিলেন, এবার আরও চাপের মুখে পড়েন। অবশেষে তিনি স্বীকার করেন যে সোনা তার কাছেও কিছু গোপন তথ্য দিয়েছিল।
“সোনা আমাকে বলেছিল, অর্জুন একটি বড়ো বেআইনি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সে এই প্রমাণ সংগ্রহ করেছিল এবং আমাকে বলেছিল, এই তথ্য নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করতে। তবে তার আগেই তাকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়,” দেবানন্দ বলল।
এই সত্য শিউলি এবং রেখাকে হতবাক করল। সোনার মৃত্যুর পেছনে যে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ষড়যন্ত্র ছিল, তা ভাবতে পারাও কঠিন ছিল।
তারা অবশেষে পুলিশের সাহায্য নিতে সিদ্ধান্ত নিল। তবে তার আগে তারা সোনার রেখে যাওয়া প্রমাণ খুঁজে বের করার জন্য তার ঘরে যায়। একটি পুরোনো আলমারির গোপন খোপে তারা একটি পেনড্রাইভ পায়। পেনড্রাইভ খুলতেই তাতে ছিল একাধিক ছবি এবং ভিডিও, যা অর্জুনের বেআইনি কার্যকলাপকে প্রমাণ করে।
এই প্রমাণগুলো পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অর্জুন এবং তার দল গ্রেপ্তার হয়। তবে এখানেই গল্পের শেষ নয়।
শিউলি এবং রেখা যখন তাদের যাত্রা শেষ মনে করছিল, তখনই সোনার একটি ডায়েরির পাতা তাদের হাতে আসে। তাতে লেখা ছিল:
“আমি জানি, আমার সত্য উদ্ঘাটনের জন্য আমাকে জীবন দিতে হবে। তবে আমি চাই, কেউ যেন আমার পেছনের গল্পটা জানে এবং আমার জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে।”
এই শব্দগুলো শিউলি এবং রেখার চোখে জল এনে দিল। সোনার মৃত্যুর রহস্য উন্মোচিত হলো, কিন্তু এর পেছনের সত্য তাদের জীবনের চিরকালীন শিক্ষা হয়ে রইল—সত্যের জন্য লড়াই কখনও থামানো যায় না।
শিউলি এবং রেখা জানল, সোনা হয়তো নেই, কিন্তু তার সংগ্রামের গল্প চিরকাল তাদের প্রেরণা হয়ে থাকবে।