সোনাময়ী রায়, তার বন্ধুরা সবাই তাকে সোনা বলে ডাকতো। সে ছিল কলকাতার এক জ্বলজ্বল নক্ষত্র, স্বপ্ন দেখা মেয়ে। লেখালেখির জগতে নিজের নাম কাড়া করে লিখতে চাইতো সে। কিন্তু কী লিখবেন, তা নিয়েই ছিল তার মহাবিপত্তি।
একদিন, কলেজের লাইব্রেরি থেকে হাতে আসে স্টিফেন কিং-এর ‘দ্য শাইনিং’। সেই রাত্রে, পুরোনো ঢাকা বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেদ করে সোনার চিৎকার উঠলো। কিং-এর ভয়ঙ্কর কাহিনীতে সে হাবিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ভয়ের সঙ্গে জাগলো আর একটা অনুভূতি – লেখার তীব্র তৃষ্ণা।
কিং-এর বইগুলো একের পর এক পড়তে লাগলো সোনা। সেই রহস্য, সেই ভয়, সেই অতিপ্রাকৃত ঘটনা – সবকিছুই তাকে টেনে নিয়ে গেল এক অন্ধকার, কিন্তু আকর্ষণীয় জগতে। নিজের লেখায় সে চেষ্টা করতে লাগলো কিং-এর ছায়া ধরতে। কিন্তু প্রতিবারই প্রকাশকরা তার লেখা ফিরিয়ে দিতেন। “খুব বেশি ‘কিং-কিং’ লাগছে,” বলতেন তারা।
এই ধাক্কা সোনাকে হতবাক করেনি, বরং তার জেদ আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু একসাথে একটা হতাশাও নেমে এসেছিল তার মনে। একদিন, বন্ধুদের সঙ্গে ওয়ালগ্রীন্স-এ দাঁড়িয়ে সামনে দেখতে পেল সে স্বয়ং স্টিফেন কিং-কে! সারা শরীর কাঁপতে লাগলো তার। দ্বিধার পর দ্বিধায় কিং-এর কাছে গিয়ে সে নিজের লেখা এবং প্রত্যাখ্যানের কথা জানালো।
কিং শান্ত স্বরে বললেন, “সোনা, সবাই তো স্টিফেন কিং হতে পারে না। তুমি নিজের পথ খুঁজে নাও। তোমার নিজের ভয়, তোমার নিজের গল্প লেখো।”
কিং-এর কথাগুলো সোনার মনে গভীরভাবে লেগে গেল। সে বুঝতে পারলো, অনুকরণ নয়, অনুপ্রেরণা দরকার তার। সে ঠিক করলো, কিং-এর ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজের মতো লিখবে।
কিন্তু ধীরে ধীরে সোনার মধ্যে একটা অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসতে লাগলো। কিং-এর প্রতি তার শ্রদ্ধা এক অসুস্থ আবেগে রূপান্তরিত হলো। কিং-এর মতো সে নিজের বাড়ির দেওয়ালে রক্ত দিয়ে লিখতে শুরু করলো। নিজের লেখা নিয়ে কিং-এর কাছে পরামর্শ নেওয়ার জন্য সে কিং-এর মেইনের বাড়ি, সিমলা পাহাড়ের ‘ব্র্যামস্টোকার হিল’ পর্যন্ত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
কিন্তু সোনা জানতো না, তার এই নিরাপদ আবেগই তাকে এক ভয়ঙ্কর রহস্য-এর মধ্যে ফেলে দেবে।
রাত তখন দু’টো। ঝমঝমিয়ে ঝরে নেমেছে কুয়াশা। ব্র্যামস্টোকার হিলের পুরো এলাকা নিস্তব্ধ। গাড়ি থামিয়ে সোনা হাতে নিয়ে নামলো ড্রোনটা। কিং নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে আছেন, ভাবল সে। একটা ভিডিও বার্তা রেকর্ড করে সেটা কিং-এর বাড়ির জানালার কাছে পাঠিয়ে দিল। তারপর ড্রোনটাকে বাড়ির চারপাশে ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু হঠাৎ করেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
চিন্তা হলো সোনার। ড্রোনটা হয়তো কোথাও আটকে গেছে। সে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু ঠিক সেই সময় একটা চিৎকার ভেদ করে নিস্তব্ধ রাত। সোনা হিম হয়ে গেল। চিৎকারটা কিং-এর?
সাহস নিয়ে সে বাড়ির দরজা ঠেলে দেখলো। ভিতরে অন্ধকার। দেওয়াল জুড়ে লেখা – “আমি লিখবো, রক্তকলমে!” কিন্তু কিং কোথায়?
আতঙ্কে সোনা আরও একটু ভিতরে ঢুকলো। দেখল একটা ঘরের দরজা খোলা। ঢুকে চোখে পড়লো একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য।
একটা লোক ডেস্কের উপর মাথা নুইয়ে পড়ে আছে । তার পাশেই রয়েছে একটা রক্তমাখা কলম। সোনা চিৎকার করে উঠলো, “মিঃ কিং!” কিন্তু কোনো সাড়া নেই।
সোনা এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে উল্টে দিল। চোখের পলক পড়লো না তার। সেই লোকটা স্টিফেন কিং নয়!
এমন সময় হঠাৎ একটা ঠান্ডা হাত তার কাঁধে পড়লো। ঘুরে দেখলো, সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্টিফেন কিং নিজে। চোখ দুটো রক্ত লাল। হাতে একটা রক্তমাখা কলম।
“কে তুমি?” কাঁপানো গলায় জিজ্ঞাসা করলো সোনা।
“আমি লেখক,” নিচু গলায় বললেন কিং, “আমিই ‘রক্তকলমের রহস্য’ লিখব।”
চমকে উঠলো সোনা। কিং কি পাগল হয়ে গেছেন?
কিন্তু কিংয়ের পরের কথায় তার রক্ত জমে গেল।
“আর তুমিই হবে এর প্রথম অধ্যায়…”
চেঁচামেচি করতে গিয়েও সোনার গলা বের হলো না। চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু কিং-এর রক্তাক্ত কলমের ঝিলিক সামান্য আলো ফেলেছে ঘরে। কিং ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন। সোনা পিছিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ঘরের কোণে আটকে গেল। কিং তার কাছে এসে দাঁড়ালেন।
“তোমার গল্প ভালো লাগলো না, সোনা?” হাসলেন কিং, কিন্তু সেই হাসি আরও বেশি ভয়ঙ্কর লাগলো।
সোনা মাথা নাড়লো, জিহ্বা জড়িয়ে গেছে।
“মিথ্যে কথা বলো না,” কড়া গলায় বললেন কিং, “আমার কাছে তোমার গল্পের চেয়ে বাস্তবের গল্পই বেশি রোমাঞ্চকর লাগছে।”
কিং হঠাৎ করেই সোনার হাত ধরলেন। তার হাতটা ঠান্ডা, মৃতের মতো। সোনা চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু কিং তার মুখ চেপে ধরলেন।
“চিৎকার করলেও কোনো লাভ নেই,” ফিসফিস করে বললেন কিং, “এই বাড়ির রহস্য কখনো কেউ জানতে পারবে না।”
কী করবেন, কিছুই সোনার মাথায় আসছিল না। হঠাৎ করেই তার চোখে পড়লো লেখ desk-এর ওপর থাকা রক্তমাখা কলমটা। সে জোরে ঠেলে কিং-এর হাত সরিয়ে নিল এবং সেই কলমটা দিয়ে তার দিকে ছুড়ে মারলো।
কিং অপ্রস্তুত হয়ে এক পা পিছিয়ে গেলেন। সেই ফাঁকে সোনা দৌড় দিল। বাড়ির বাইরে এসে সে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো, “সাহায্য করুন! সাহায্য করুন!”
কিন্তু নিথুর রাতে তার চিৎকার কেউ শুনলো না। সোনা বাড়ির বাইরেই দৌড় লাগালো। কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ি রাস্তায় দিশেহারা হয়ে গেল সে।
পুলিশ পরে ঘটনাস্থলে এলো। সিমলা পাহাড়ের নিচে কিং-এর বাড়িতে রক্তাক্ত লেখকের লাশ উদ্ধার হলো। কিন্তু সেই লাশটা স্টিফেন কিং-এর নয়। তদন্ত শুরু হলো। সোনার ড্রোনটাও পাওয়া গেল, কিন্তু ভিডিও বার্তাটা মুছে ফেলা।
দিন যত গেল, রহস্য তত জটিল হলো। সোনাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। সে কি বেঁচে আছে, নাকি কিং-এর রক্তকলমের শিকার হয়ে গেল, তা আজও এক রহস্যই থেকে গেল।