সাগরের বুকে, যেখানে সূর্য অস্তমিত হবার ঠিক আগে লাল লেজুর মত গলে যায়, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দীঘা, ক্ষীণকায় ছায়ামিনার – সাগর সন্ধ্যা. বছরের পর বছর, ঝড়ঝঞ্ঝা, ঢেউয়েদের ক্রোধ সহ্য করে দাঁড়িয়ে আছে সে, নিরবচ্ছিন্ন আলোক রশ্মি বর্ষণ করে জাহাজগুলোকে পথ দেখিয়ে. অবিনশ্বর সেই আলোর পাহারাদার ছিলেন বিপিন দাস, এক কিংবদন্তি যিনি কখনো তাঁর কর্তব্যে ফাঁক ফেলেননি।
আমি যখন সাগর সন্ধ্যায়ের নতুন আলোক রক্ষক হিসেবে এলাম, তখনই একটা অস্বস্তি আমাকে গ্রাস করলো। লোহার সিঁড়িগুলো পায়ের নিচে আর্তনাদ করছে, প্রতিটি ধাপ যেন একটা সতর্কবার্তা জানাচ্ছে। চাহিদার ঘরটা ইতিহাসের গুরুত্বে ভারাক্রান্ত, দেওয়ালগুলো বিবর্ণ ছবি আর কাঠে খোদাই করা রহস্যময় চিহ্ন দিয়ে সজ্জিত।
এক ঝড়ো রাতে, যখন ঝড়ের থাপ্পড়ে কাঁচের জানালা কাঁপছিল, নিচের পাথরে একটা ছায়া মূর্তি দেখে আমার চোখ কপালে উঠলো। বিপিন দাসের আত্মা কি? কিন্তু তিনি কেন তাঁর প্রিয় সাগর সন্ধ্যায়ের আশেপাশে ঘুরে বেড়াবেন? উত্তর খুঁজতে আমি পুরোনো নথিপত্র, ডায়েরি খতিয়ে দেখলাম।
জানতে পারলাম, আলোর প্রতি বিপিনের নিষ্ঠা কর্তব্যের চেয়ে অনেক বেশি ছিল, এমনকী পূজার সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। সাগর সন্ধ্যা শুধু জাহাজ চালনার সাহায্যই করত না, এর মধ্যে লুকিয়ে ছিল একটা রহস্য – অন্য এক জগতে যাওয়ার একটা দরজা। ১৯৮৫ সালের একটা ভয়ঙ্কর ঝড়ের সময় বিপিন এই সত্য আবিষ্কার করেন। কুয়াশার মধ্যে থেকে একটা আত্মীয় জাহাজ দেখতে পান, যাতে ছিল হারিয়ে যাওয়া নাবিকদের আত্মা। আলো তাদের বাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু একটা মূল্যে। বিপিন সমুদ্রের সাথে একটা চুক্তি করেন, তাঁর জীবনশক্তি সাগর সন্ধ্যায়ের সাথে জড়িয়ে দেন।
এই রহস্য উদঘাটনের পরে, অদ্ভুত ঘটনা আরও বাড়তে লাগলো। আলোটা ঝলসানি দিতে লাগলো, দেওয়ালগুলোতে ভয়ঙ্কর ছায়া ফেলল। গলিগুলোয় কানে কানে ফিসফিসানি শোনা যেতে লাগলো, যা আলোক রক্ষককে ‘জ্বালা জ্বালিয়ে রাখতে’ বলছিল। সমুদ্র অস্থির হয়ে উঠল, ঢেউ অস্বাভাবিক জোরে পাথরে আছড়ে পড়ল।
অভিশাপ ভাঙার জন্য উঠেপড়ে লাগলাম বৃদ্ধ মাঝি এলিয়াসের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি জাহাজডুবি, কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়া নাবিকদের গল্প, আর সাগর সন্ধ্যায়ের অতৃপ্ত ক্ষুধা বর্ণনা করলেন। এলিয়াস সাবধান করে দিলেন যে, চুক্তি না ভাঙা পর্যন্ত বিপিনের আত্মা শান্তি পাবে না – যতক্ষণ না আরেকজন আলোক রক্ষক নিজেকে আলোর কাছে স্বেচ্ছায় উৎসর্গ করবেন।
ডুবে যাওয়া নাবিকদের দৃষ্টিভ্রম আর বিপিনের গভীর চোখের দ্বারা আমি প্রাণাক্রান্ত হয়ে পড়লাম। এখন আমার সামনে এমন একটা অসম্ভব পছন্দ, যা করা অসম্ভব। এই বন্ধন ছিন্ন করতে, পরের ঝড়ের সময়, যখন সমুদ্র সবচেয়ে বেশি উত্তাল থাকবে, তখন লণ্ডন কক্ষে উঠতে হবে। সেখানে, আমাকে নিজেকে আলোর কাছে উৎসর্গ করতে হবে, এর প্রাচীন জাদুর সাথে এক হয়ে যেতে হবে।
ঝড় যত এগিয়ে আসছিল, আমার হৃদপিণ্ডটা ঢিম চিম করে উঠছিল লোহার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলাম। চাহিদার ঘরের দেওয়ালগুলি যেন কাছে এসে জড়িয়ে ধরছে, প্রতিটি ধাপে বিপিনের অবিচল প্রহরার স্মৃতি আমাকে ভাবিয়ে কুলিয়ে দিচ্ছে। লণ্ডন কক্ষে আলোটা জ্বলজ্বলে জ্বলছে, যেন একটা ক্ষুধার্ত গহ্বর, আমাকে গ্রাস করার জন্য প্রস্তুত।
আমি ঘূর্ণায়মান সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছি, জানি যে আমার আত্মত্যাগ অসংখ্য জীবন বাঁচাবে।
ঝড়ের মাঝে, আমি আলোর মধ্যে পা রাখলাম, সাগর সন্ধ্যায়ের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম। দিশা নির্দেশক আলোটা আরও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠল, অন্ধকারকে আলোকিত করল, আর সমুদ্র তার পাওনা আদায় করে নিল।
বিপিনের আত্মা পাথরের উপর থেকে দেখছে, তার গভীর চোখগুলো এখন অবশেষে শান্তিতে রয়েছে। সাগর সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে আছে, তার রহস্য অক্ষত, পরের আলোক রক্ষককে ডাকার জন্য অপেক্ষা করছে এবং হাবড়া নগরীর লোকেরা বিপিন দাসের গল্প বলে চলেছে – সেই আলোক রক্ষক, যে মৃত্যুর পরেও কখনো রাত কাটায়নি।