অধ্যায় ১: রহস্যময় রাতের সূচনা
আমি রাহুল। আজ আমি আপনাদের এমন একটি ঘটনার কথা বলব যা আমার জীবনের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। মেট্রিক পরীক্ষার আর কিছুদিন বাকি। দিনের বেলা পড়ার প্রতি আমার তেমন একটা ঝোঁক ছিল না। বরং রাতের নীরব পরিবেশে পড়তে আমার বেশ ভালো লাগত। আম্মু আমার এই অভ্যাসের কথা জানতেন, তাই রাতে চা বানিয়ে রাখতেন। তার সেই চা খেয়েই আমি সারারাত জেগে পড়াশোনা করতাম।
সেদিন ছিল ১১ ফেব্রুয়ারি। সবেমাত্র রাত ১২টা পেরিয়েছে। ঘরের সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। আমি পড়ার টেবিলে বসে ইংরেজি গ্রামার বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি। দু’দিন পরেই স্যারের বাসায় মডেল টেস্ট পরীক্ষা, তাই কোনোভাবেই পড়া অসম্পূর্ণ রাখতে চাইনি। সময়ের দিকে খেয়াল না রেখে পড়ে চলেছিলাম। তবে রাত যত বাড়ছিল, ততই আমার চোখে ঘুম ভর করছিল। মাথাটা কেমন ভারী লাগছিল। বুঝলাম একটু বিশ্রাম দরকার।
আমাদের বারান্দায় একটি ইজি চেয়ার রাখা ছিল। বাবা এটি বিশেষভাবে আমার জন্যই কিনে এনেছিলেন। বিকেলের সময়টা আমি সেখানে বসে কাটাই। তাই মনে হলো, বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষণ ইজি চেয়ারে বসলে হয়তো মনটা শান্ত হবে। আমি বই রেখে ধীর পায়ে বারান্দায় গেলাম। বারান্দায় তখন হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। ইজি চেয়ারে বসে আরাম করে চোখ বন্ধ করলাম।
চোখ বন্ধ করেই মনে মনে কিছুক্ষণ আগে পড়া বিষয়গুলো ঝালিয়ে নিতে লাগলাম। এমন সময়, হঠাৎ আমি একটি অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দটি খুবই মৃদু, কিন্তু পরিষ্কার। শব্দটা অনেকটা কোমল গলায় কারও ডাকের মতো। আমি চমকে উঠলাম। চোখ খুলে এদিক-ওদিক তাকালাম, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না।
আমরা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি আর্মি কোয়ার্টারে থাকতাম। নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই কড়া ছিল। চোর-ডাকাতের ভয় একেবারেই ছিল না। নিচে গেটে সারাক্ষণই একজন গার্ড থাকতেন। তাই রাতের এই নীরবতায় হঠাৎ এমন শব্দ শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম। শব্দটা আমাদের বাড়ির আশপাশ থেকেই আসছে বলে মনে হলো। আমি বারান্দার রেলিং থেকে নিচের দিকে উঁকি দিলাম। নিচের পথ পুরোপুরি ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই।
মনের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি কাজ করতে লাগল। কে ডাকলো? কেন ডাকলো? এমন গভীর রাতে এখানে কেউ আসবে কেন? মনের মধ্যে প্রশ্নের ঝড় উঠল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বারান্দার দরজা আটকে দিয়ে আমি আবার ঘরে ঢুকে গেলাম। কিন্তু ঘরে ঢুকে পড়ার দিকে মন বসাতে পারলাম না।
রাত তখন প্রায় ৩টা। চারপাশ একদম নিস্তব্ধ। আমি আবার বারান্দার দরজা খুলে বাইরে গেলাম। বারান্দার ঠান্ডা বাতাসে শরীর শিউরে উঠল। হঠাৎ, আবার সেই একই ধরনের আওয়াজ। এবার শব্দটা আরও পরিষ্কার। শব্দটি যেন খুব কাছ থেকেই আসছে। কিন্তু আশপাশে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
আমার বুক ধুকপুক করে উঠল। সাহস করে বারান্দার রেলিং ধরে নিচে তাকালাম। ঠিক তখনই, মনে হলো কেউ একজন ছায়ার মতো হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু ভালো করে তাকানোর আগেই ছায়াটি অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি দ্রুত বারান্দার দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে পড়লাম। ভেতরে ঢুকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলাম।
বুকের মধ্যে চাপা ভয়। কিন্তু একইসঙ্গে মনের মধ্যে জেগে উঠল এক অদ্ভুত কৌতূহল। শব্দটা কার? ছায়াটা কি সত্যিই আমি দেখেছি, নাকি এটি আমার মনের ভুল? উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি আরও বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম।
গ্র্যান্ড হোটেলের রাত্রি - ভুতের বাংলা ছোট গল্প: এক ভয়ঙ্কর রাত্রি, ৭ জন বন্ধু পরিত্যক্ত গ্র্যান্ড হোটেলে আটকা পড়ে। রহস্য, ভয়, মৃত্যু – সব মিলিয়ে এক রোমাঞ্চকর বাংলা ভুতের গল্প। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ২: অদ্ভুত অনুভূতি ও ভয়
বারান্দায় ঘটে যাওয়া সেই অদ্ভুত ঘটনার পর আমি নিজেকে পড়াশোনায় মন দিতে বাধ্য করার চেষ্টা করলাম। ভাবলাম, ব্যস্ত হয়ে পড়লে হয়তো সবকিছু ভুলে যেতে পারব। কিন্তু মন ছিল পুরোপুরি অস্থির। বই খুলে বসে থাকলেও পড়ার মধ্যে কোনোভাবেই মন বসছিল না। মাথার মধ্যে কেবল একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—শব্দটা কার ছিল? ছায়াটা কি সত্যিই আমি দেখেছিলাম, নাকি এটা ছিল আমার কল্পনা?
১০ মিনিটের মতো সময় কেটে গেল। আমি কেবল বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, কিন্তু এক লাইনও পড়তে পারিনি। শেষে ঠিক করলাম, আর যাই হোক, একবার বারান্দায় ফিরে দেখতে হবে। হয়তো কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সাহস সঞ্চয় করে বারান্দার দরজা খুললাম। হালকা ঠান্ডা বাতাস আমার মুখে এসে লাগল। চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। না, কোথাও কিছু নেই। সবকিছুই নির্জন আর নিস্তব্ধ।
ধীরে ধীরে গিয়ে ইজি চেয়ারে বসে পড়লাম। ইজি চেয়ারে বসে সাধারণত আমার মন শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু আজকের অনুভূতি ছিল একদম ভিন্ন। বসার সঙ্গে সঙ্গে আমার পুরো শরীর যেন শিউরে উঠল। এক অজানা শীতল স্রোত যেন আমার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে এলো।
মনে পড়ল, আমি ইজি চেয়ার ছেড়ে ঘরে ঢুকে গিয়েছিলাম প্রায় ১০ মিনিট আগে। এই সময়ে ঢাকা শহরের এই ঠান্ডায় চেয়ারটা পুরোপুরি ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, চেয়ারে বসার সঙ্গে সঙ্গেই আমি টের পেলাম এটি বেশ গরম। যেন মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগেই কেউ সেখানে বসে ছিল।
আমার বুকের ভেতর ধুকধুক শুরু হলো। মনে হলো, হৃদপিণ্ড যেন হাতুড়ির মতো বেজে উঠছে। চোখ বন্ধ করে বারবার আল্লাহর নাম নিতে লাগলাম। তখন আমার বয়স ছিল খুবই কম, কিন্তু অন্য মেয়েদের তুলনায় আমি অনেক বেশি সাহসী ছিলাম। তবুও, এই অদ্ভুত পরিস্থিতি আমার শরীরকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
প্রায় দুই মিনিট এইভাবে কেটে গেল। এক অদ্ভুত শূন্যতায় আবদ্ধ হয়ে বসে ছিলাম। হঠাৎ, আমার নাম ধরে কেউ ডাকল। ভয়ে আমার শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেল। এবার শব্দটি একদম পরিষ্কার। কোনো স্বপ্ন নয়, এটা আমি নিশ্চিত। বাতাসে ভেসে আসা সেই কণ্ঠ যেন আমাকে থমকে দিল।
“মিম… মিম… দেখো…”
শব্দগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন, যেন কোথাও থেকে ভেসে আসছে। গলা শোনাতে বেশ অচেনা লাগল। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে চোখ মেললাম। এবারও কিছুই দেখতে পেলাম না। চারপাশ নিঃশব্দ, যেন এই শব্দের কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
আমি বারান্দা থেকে সামনের বাড়িগুলোর দিকে তাকালাম। বেশিরভাগ বাড়ির জানালার আলো নিভে গেছে। শুধু দূরের এফ ব্লকের একটি বাড়িতে আলো জ্বলছে। আলোটা দেখতে খুব স্বাভাবিক লাগল না। মনে হলো, সেখান থেকেই কোনো অদৃশ্য শক্তি আমাকে ডাকছে।
আমার মন সন্দেহ করতে শুরু করল। শব্দটা কি নিচ থেকে আসছিল? আমাদের বারান্দায় কোনো গ্রিল ছিল না। তাই নিচের দিকে ঝুঁকে দেখা বেশ সহজ ছিল। আমি সাহস করে আল্লাহর নাম নিয়ে বুকে ফুঁ দিয়ে বারান্দার ওয়ালে ঝুঁকে নিচে উঁকি দিলাম।
নিচে তাকিয়ে প্রথমে কিছুই দেখতে পেলাম না। রাস্তাটা একদম ফাঁকা। রাস্তার আলো প্রায় নিভু নিভু। বাতাসে পাতার মৃদু নড়াচড়া ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পর, রাস্তার ধারের একটি ছায়ামূর্তি দেখতে পেলাম।
ছায়াটা এত দ্রুত নড়ছিল যে, প্রথমে ভাবলাম এটা হয়তো বাতাসে দুলতে থাকা গাছের পাতার ছায়া। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, এটি কোনো গাছ নয়। ছায়াটি একজন মানুষের আকারের মতো ছিল, কিন্তু কেমন যেন অস্বাভাবিক। তার হাত-পা লম্বা আর পাতলা, যেন কোনো কঙ্কাল হাঁটছে।
আমি ভয়ে পিছিয়ে এলাম। মনে হলো, ছায়াটি ধীরে ধীরে আমাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। এক অদ্ভুত অনুভূতিতে আমার শরীর হিম হয়ে গেল। সাহস করে আবার নিচের দিকে তাকালাম। এবার ছায়াটি আর দেখলাম না। যেন কোথাও গায়েব হয়ে গেছে।
ভয়ে আর সেখানে দাঁড়াতে পারলাম না। দ্রুত বারান্দার দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে পড়লাম। দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলাম। হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি যেন থামছেই না। ভেতরে এসে বিছানায় বসে পড়লাম।
অধ্যায় ৩: মুখোমুখি সংঘর্ষ ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া
কলিংবেলের পাশে লাগানো লাইটের নীচে চারপাশটা অনেকটা আলোকিত ছিল। মেইন গেটের সামনে থেকে সেই আলো গিয়ে রাস্তায় মিশে গেছে। রাতের অন্ধকারে সেই আলোতে চারপাশের জিনিসপত্র পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছিল। তবে যা আমি দেখলাম, তা আমার জীবনে আর কখনোই ভুলতে পারব না।
বারান্দার রেলিংয়ে ঝুঁকে নিচে তাকালাম, আর সেই মুহূর্তে মনে হলো, কেউ যেন আমার ঠিক দিকেই তাকিয়ে আছে। এমনভাবে তাকিয়েছিল, যেন সে জানত আমি ঠিক এই মুহূর্তে উঁকি দেব। গেটের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অবয়বটি এমন জায়গায় ছিল, যেখানে গেটের লাইট তার মুখে এসে পড়ছিল।
প্রথমে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। সেটা ছেলে না মেয়ে, তা বোঝা কঠিন ছিল। তবে তার মুখ দেখে আমার শরীর কাঁপতে শুরু করল। মুখটা এক অদ্ভুত বিকৃতভাবে বাঁকানো, যেন কোনো মানুষ নয়। চোখদুটো এমন অস্বাভাবিক স্থিরতা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, যা আমার বুকের ভেতর ঠাণ্ডা শীতল স্রোত বইয়ে দিল।
সে কিছুক্ষণ আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে তার একটি হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। আমি চিৎকার করতে চেয়েও পারলাম না। গলা থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না। শরীর যেন পাথরের মতো জমে গিয়েছিল। আমার মনে হলো, আমি বুঝি এখানেই শেষ।
হঠাৎ, সেই অদ্ভুত অবয়বটি হাওয়ায় ভাসতে শুরু করল। যেন মাটি ছুঁয়েও নয়, উড়ন্ত কোনো ঘুড়ির মতো আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি আতঙ্কে পাগল হয়ে গেলাম। চিৎকার করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু এক ফোঁটা শব্দও বের হচ্ছিল না। আমার পা চলছিল না, দৌড়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার কথা ভাবছিলাম, কিন্তু পুরো শরীর পাথরের মতো অসাড় হয়ে গিয়েছিল।
সেই জিনিসটি ক্রমশ আমার কাছাকাছি চলে এল। তখন আমার থেকে তার দূরত্ব ছিল তিন-চার হাতের মতো। এত কাছে আসার পর আমি তার মুখটা আরও পরিষ্কারভাবে দেখতে পেলাম। তার মুখে ছিল অদ্ভুত বিকৃতি, আর চোখের দিকে তাকিয়েই আমার ভেতর এক শীতল স্রোত বইতে লাগল।
শেষবারের মতো আমি আবার চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বের হওয়ার আগেই, হঠাৎ কোয়ার্টারের পাশের মসজিদ থেকে আজানের শব্দ ভেসে এলো। সেই শব্দ যেন পুরো পরিবেশটাকে বদলে দিল।
আজানের ধ্বনি শোনা মাত্রই সেই অবয়বটি থমকে গেল। তার গতির পরিবর্তন হলো, আর সেটি আমার থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে লাগল। তবে এটি হাঁটছিল না। যেন বাতাসে ভেসে ভেসে পিছিয়ে যাচ্ছিল।
আমি স্থির দাঁড়িয়ে ছিলাম, পুরোপুরি হতভম্ব। সেই অবয়বটি যতক্ষণ আলোতে ছিল, আমি তার চলাচল দেখছিলাম। সে ধীরে ধীরে গেট পেরিয়ে রাস্তায় পৌঁছাল। তারপর আলোর সীমানা ছাড়িয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কিন্তু তার যাওয়ার আগে, এক মুহূর্তের জন্য সেটি মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল।
এবার আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম তার চোখ থেকে অন্ধকারে সবুজ রঙের আলো বের হচ্ছে। সেই দৃশ্য দেখে আমার পুরো শরীর শীতল হয়ে গেল। যেন সেই চোখ দুটো সরাসরি আমার আত্মার ভেতরে তাকিয়ে ছিল।
আমি মুহূর্তের জন্য স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর দ্রুত বারান্দার দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে পড়লাম। দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে, শ্বাস নিতে চেষ্টা করছিলাম। আমার পুরো শরীর কাঁপছিল, মনে হচ্ছিল যেন আমি এক দুঃস্বপ্নে আটকে গেছি।
বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম, কিন্তু ঘুমানো সম্ভব ছিল না। মনের মধ্যে কেবল সেই দৃশ্য ভেসে উঠছিল। অবয়বটি কে ছিল? তার চোখ থেকে সবুজ আলো বের হচ্ছিল কেন? আর সে কেন আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল?
আজানের ধ্বনি শুনে সে চলে গেল, কিন্তু এই রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আমার মনে গভীর দাগ কেটে গেল। আমার মনে হচ্ছিল, এই ঘটনা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। হয়তো এটি কেবল শুরু, আর সামনে আরও কিছু অপেক্ষা করছে, যা আমার জীবনের গতিপথ বদলে দেবে।
কুয়াশার কান্না - ভুতের বাংলা ছোট গল্প: এক গ্রামে রহস্যময় কুয়াশা, অভিশাপ, আর অদ্ভুত ঘটনার কেন্দ্রে এক লেখিকা। ঈশান দত্তের জমি দখলের কাহিনী, অভিনন্দ দত্তের আত্মহত্যা, শিবনাথের লেখা রহস্যের সূত্র। কুয়াশার মধ্যে কান্নার শব্দ, অদ্ভুত ছেলে, সোনার বংশের রহস্য – সবকিছু মিলে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী। সত্যিটা কি অভিশাপ?লেখিকা কি সমাধান করতে পারবেন রহস্য? সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৪: ভয়ানক সকাল
পরদিন সকালে যখন আমার চোখ খুলল, তখন নিজেকে নিজের রুমের খাটে শোয়ানো অবস্থায় দেখতে পেলাম। মাথার উপর ফ্যানটা দ্রুত ঘুরছে, যেন আমার ভেতরের সমস্ত অস্বস্তি দূর করার চেষ্টা করছে। উঠে বসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু শরীরে এতটাই দুর্বলতা ছিল যে সামান্য নড়াচড়াও সম্ভব হচ্ছিল না। গলা দিয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করলাম, মাকে ডাকতে চাইলাম, কিন্তু কেমন যেন গড়গড় শব্দ বের হলো।
ভাগ্য ভালো, মা ঠিক পাশেই ছিলেন। রান্নাঘরে কিছু কাজ করছিলেন হয়তো। আমার অদ্ভুত আওয়াজ শুনে দৌড়ে এলেন। তাঁর চোখে আতঙ্ক আর উদ্বেগ স্পষ্ট। আমাকে দেখেই তিনি মাথায় হাত রাখলেন।
মা উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে তোর? শরীর খারাপ লাগছে?”
আমি খুব দুর্বল অনুভব করছিলাম, যেন শরীরের সমস্ত শক্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মাকে বললাম, “পরে বলবো মা। আগে বল, আমি ঘরে এলাম কীভাবে? রাতে তো বারান্দায় ছিলাম!”
মা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তাঁর মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “সকালে ফজরের নামাজের জন্য উঠেছিলাম। তখন তোকে রুমে না দেখে বারান্দায় যাই। সেখানে দেখি তুই ইজি চেয়ারের পাশে মেঝেতে পড়ে আছিস। চোখ বন্ধ ছিল, আর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। অনেক ডেকে তারপর তোকে তুলতে পেরেছি।”
মায়ের কথা শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি কিছু বলতে চাইলাম, কিন্তু গলার স্বর আটকে গেল। মায়ের মুখে ভয়ের ছাপ আরও গভীর হলো। তিনি একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, “আজ সকালে আরেকটা অদ্ভুত ঘটনা হয়েছে। আমাদের বিড়ালটা তোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে করেছিলাম, হয়তো নিচে কোথাও ঘুরছে। কিন্তু পরে উপর তালার আঙ্কেল বাজার থেকে আসার পথে বাসার পাশের ঝোপে বিড়ালটাকে মরা অবস্থায় পেয়েছেন।”
“মরা অবস্থায়?” আমি বিস্ময়ে ফিসফিস করলাম।
মা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “হ্যাঁ। কিন্তু ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। বিড়ালটার শরীর পুরো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। নাড়িভুঁড়ি সব বের হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ওর শরীরে এক ফোঁটাও রক্ত ছিল না। যেন কেউ ওর সমস্ত রক্ত চুষে নিয়েছে।”
মায়ের এই কথা শুনে আমার গা শিরশির করে উঠল। রাতের সেই অদ্ভুত দৃশ্য, সেই সবুজ চোখের আলো, আর তার ধীরে ধীরে আমার দিকে আসার স্মৃতি যেন আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল। মনে হলো, বিড়ালটার এই পরিণতির সঙ্গে রাতের ঘটনাগুলোর কোনো না কোনো যোগসূত্র রয়েছে।
আমি মাকে কিছু বলতে চেয়েও কিছু বলতে পারলাম না। মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, কিছু অদৃশ্য শক্তি আমার মনের গভীরে বসে আছে, আমাকে কথা বলতে দিচ্ছে না।
মা আমাকে পানি খেতে দিলেন। আমি ধীরে ধীরে পানির গ্লাসটা হাতে নিলাম। কিন্তু হাত কাঁপছিল। গ্লাসটা ঠোঁটে নিয়ে ছোট ছোট চুমুক দিয়ে পানি খেলাম। কিছুটা স্বাভাবিক অনুভব করতে শুরু করলাম।
কিছুক্ষণ পর মা রান্নাঘরে চলে গেলেন। আমি শুয়ে থেকে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাইরে দিনের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। চারপাশে যেন সবকিছু স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, এই স্বাভাবিকতার আড়ালে কিছু একটা লুকিয়ে আছে।
আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম, কিন্তু মনে মনে ঘটনাগুলোর কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলাম। কীভাবে আমি বারান্দায় গিয়ে পড়েছিলাম? আর সেই অবয়বটি কি সত্যি ছিল, নাকি শুধুই আমার কল্পনা? আর বিড়ালটার মৃত্যু… এটা কি কোনো অশুভ শক্তির কাজ?
রাতে যে ঘটনা ঘটেছিল, তার সঙ্গে বিড়ালটার এই মর্মান্তিক পরিণতির যোগসূত্র কি? মনে হলো, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার খুঁজে বের করতেই হবে। তবে কোথা থেকে শুরু করব, তা বুঝতে পারছিলাম না।
মনে পড়ল, আমাদের বাসার পাশের পুরোনো পুকুরের কাছে কিছু গল্প শোনা যায়। অনেকেই বলে, ওই এলাকায় অদ্ভুত কিছু ঘটে। গ্রামের বয়স্করা একসময় বলতেন, ওখানে একটা অভিশপ্ত গাছ ছিল। সেই গাছের নিচে নাকি প্রায়ই রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটত। পরে গাছটা কেটে ফেলা হয়, কিন্তু এলাকার বাসিন্দারা বলে, সেই গাছের অশুভ শক্তি এখনো রয়ে গেছে।
এইসব ভাবতে ভাবতে আমার শরীরে কেমন একটা শীতল অনুভূতি হলো। মনে হলো, রাতের সেই অবয়ব আর বিড়ালটার মৃত্যু, এগুলো সব হয়তো সেই পুরোনো গল্পগুলোর কোনো ধারাবাহিক অংশ।
আমি ঠিক করলাম, রাতে আর যাই হোক বারান্দায় যাব না। কিন্তু মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—আমার ওপর কি কোনো অশুভ শক্তি নজর রাখছে? যদি তা-ই হয়, তবে এর থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী?
পরদিনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মনে হলো, হয়তো রাতের অন্ধকারে আবার সেই রহস্যের জট খুলবে। কিন্তু সেই জট খোলার জন্য কি আমি প্রস্তুত? নাকি এটাই হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল?
জীবন্ত মূর্তি - রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প: "জীবন্ত মূর্তি" একটি রহস্য রোমাঞ্চে ভরা বাংলা ছোট গল্প, যেখানে ইতিহাস, প্রেম এবং অতীতের সঙ্গে বর্তমানের অদ্ভুত সংযোগ তুলে ধরা হয়েছে। চমকপ্রদ ঘটনায় গল্পটি পাঠককে মুগ্ধ করবে। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৫: পরিণতি ও স্মৃতিচারণা
এই ঘটনাটি আমার পুরো জীবনটাকেই এলোমেলো করে দিয়েছিল। ঘটনার পরের দিন থেকেই আমার শরীর খারাপ হতে শুরু করে। প্রথমে সামান্য জ্বর ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তা বেড়ে ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। একটানা ১৫ দিন আমি ভয়াবহ জ্বরে ভুগলাম। মা-বাবার দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। ডাক্তাররা এসে পরীক্ষা করে জানালেন, আমার শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে। তারা বারবার মাকে বলছিলেন, “এই অবস্থায় আপনার ছেলের জন্য পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে না। পুরোপুরি সুস্থ হতে অনেক সময় লাগবে।”
এই কথা শুনে মায়ের চোখে পানি চলে আসত। আমি জানতাম, তিনি কী পরিমাণ উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই চোখের জল দেখেও আমি কিছু বলতে পারতাম না। আমার নিজের শরীরই যেন আমার শত্রু হয়ে উঠেছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেবল ভাবতাম, “এ কি সত্যিই আমার শেষ? কীভাবে সব কিছু এভাবে ঘটে গেল?”
জ্বরের সময় মাঝে মাঝে ভয়াবহ স্বপ্ন দেখতাম। সেই রাতের ঘটনা যেন বারবার আমার চোখের সামনে ফিরে আসত। কখনো দেখতাম, সেই সবুজ চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কখনো দেখতাম, আমি সেই ইজি চেয়ারের পাশে পড়ে আছি আর কেউ একজন আমার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো আবার বিড়ালটার মৃতদেহের দৃশ্য আমার স্বপ্নে উঠে আসত। এসব স্বপ্ন আমাকে আরও দুর্বল করে দিত।
মাঝে মাঝে মনে হতো, হয়তো আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছি। মা-বাবার সামনে কিছু বলতে পারতাম না। তারা তো এমনিতেই আমার শারীরিক অবস্থার জন্য যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি জানতাম, এসব শুধুই স্বপ্ন নয়। এগুলো এমন কিছু যা বাস্তবে ঘটেছিল।
জ্বরের সেই ১৫ দিন আমার জন্য যেন এক চরম পরীক্ষার সময় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদিকে শারীরিক কষ্ট, অন্যদিকে মানসিক অশান্তি। মাঝেমাঝে ভাবতাম, হয়তো এটাই আমার শেষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ইচ্ছায় আমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠি। ডাক্তাররা যখন বললেন, আমি পরীক্ষা দেওয়ার মতো অবস্থায় চলে এসেছি, তখন আমার আনন্দের সীমা ছিল না। মনে হচ্ছিল, আমি নতুন করে বাঁচার সুযোগ পেয়েছি।
তবে সুস্থ হলেও সেই ঘটনার স্মৃতি আমার মন থেকে কখনো মুছে যায়নি। জানি, অনেকেই বলবেন যে আমি হয়তো হ্যালুসিনেশন করেছি। অনেকে বলবেন, পড়ার চাপ বা মানসিক ক্লান্তির কারণে এমন কিছু দেখেছি। কিন্তু আমি জানি, আমি যা দেখেছিলাম তা একেবারে সত্যি ছিল।
ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। কিন্তু আজও সেই রাতের কথা লিখতে বসলে মনে হয়, আমি যেন আবার সেই রাতে ফিরে গেছি। প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি অনুভূতি এতটাই জীবন্ত যে মনে হয় সবকিছু তখনই ঘটছে।
আজ পাঁচ বছর পরও বারবার মনে হয়, সেই রাতের সবকিছুর পেছনে আসলে কী লুকিয়ে ছিল? কীভাবে সেই অবয়ব আমার কাছে পৌঁছালো? আর বিড়ালটার মৃত্যুর সঙ্গে সেই রাতের ঘটনার কী সম্পর্ক ছিল? এর কোনো উত্তর আমি আজও পাইনি। তবে এতদিনে বুঝেছি, কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়তো কখনোই পাওয়া যায় না।
এই অভিজ্ঞতা আমাকে শুধু শারীরিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও পরিবর্তন করেছে। সেই রাত থেকে আমি কখনোই বারান্দায় একা যেতে পারি না। সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে পা রাখতে আমার ভয় লাগে। এমনকি সেই ইজি চেয়ারটাও আমরা পরে বাসা থেকে সরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তবুও মনে হয়, সেই অদ্ভুত সবুজ চোখ আজও আমাকে অনুসরণ করছে।
পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। জীবনে অনেক কিছু বদলেছে। কিন্তু সেই রাতের স্মৃতি এখনো তাজা। আজও কখনো কখনো রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয়, কেউ যেন আমার রুমে দাঁড়িয়ে আছে, চুপচাপ আমাকে দেখছে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি। তখন মনে পড়ে সেই ভয়াবহ রাতের কথা, যেটা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
তবে একটা জিনিস আমি বুঝেছি। জীবনে কিছু ঘটনা এমন হয়, যা আমাদের সামনে নিয়ে আসে অজানা এক সত্য। সেই সত্য হয়তো ভয়ঙ্কর, কিন্তু তা আমাদের জীবনের গভীরে কিছু পরিবর্তন করে দেয়। সেই রাতের অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে, ভয়কে কীভাবে মেনে নিতে হয়। কারণ ভয় আমাদের জীবনের অংশ, আর তাকে অস্বীকার করা মানে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা।
আজ এই লেখাটা শেষ করতে গিয়ে মনে হচ্ছে, হয়তো এই লেখা আমার জন্য একটা মুক্তি। যে ঘটনা এতদিন আমার মনকে চেপে রেখেছিল, তা যেন এই লেখার মাধ্যমে একটু হালকা হয়ে গেল। কিন্তু সেই রাতের সবুজ চোখের স্মৃতি? তা কি কখনো ভুলতে পারবো? আমি জানি না। হয়তো না। কারণ সেই রাতের সবুজ চোখ আমার জীবনের এক অন্ধকার অধ্যায়, যা কখনোই মুছে যাবে না।