ঠিক মধ্যরাতে, ঝমঝমিয়ে ঝড়ের থাবায় কেঁপে উঠল ঝাড়খণ্ডি। বাতাসের দাপটে পুরোনো বাড়ির কাঠের জানালার ফ্রেম কেঁদে উঠলো। বিছানায় শুয়ে শুয়ে অবিনাশ চমকে উঠলো। সেদিন অস্ত্রোপচারের পর, শরীরটা এতো অসাড় যে নড়াচড়া করারও জো নেই। চারপাশে অন্ধকার, শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া ঝলমলে বিদ্যুৎ দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ, টিভির আওয়াজটা বিরক্তিকর লেগে উঠলো। খবরে বলছে কোন এক অজানা ভাইরাসে আতঙ্কিত গোটা গ্রাম। অবিনাশের কপালে জল জমে উঠলো। অসুস্থ শরীর আর এই সব খবর মিলে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল।
এমন সময়, জানালার কাচে একটা মুখের আভাস! অবিনাশ চোখ কচলালো। আবার কি? অস্ত্রোপচারের পর থেকেই মাঝে মাঝে এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখছে সে। কিন্তু এবারের মতো স্পষ্ট নয়। লম্বা চুল, বিশ্রী চোখ, আর মুখখানা একদম সাদা! অবিনাশ চিৎকার করতে গেল কিন্তু শব্দ বের হলো না। শরীরটা এতো অসাড় যে নড়তেও পারছে না সে। শুধু চোখ দুটো ফাটিয়ে সেই অমানবিক মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
কয়েক সেকেন্ড পর, ঝড়ের দমকা হাওয়ায় জানালাটা জোরে ঝম্ করে খুলে গেল। সেই সঙ্গে সেই মুখটাও আর দেখা গেল না। কিন্তু অবিনাশ জানে, সেখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে সেই অমানবিক জীবটা। ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে যে কোন মুহুর্তে। অসহায় অবিনাশ শুধু প্রার্থনা করতে লাগলো যেন ঝড় থামে, বিদ্যুৎ চলে যায়, আর সেই অজানা ভয়ঙ্কর জিনিসটা যেন তার কাছে না আসে।
কিন্তু ভাগ্য তার সঙ্গে নেই। ঝড় থামার কোনো লক্ষণ নেই, বরং আরও বেড়ে গেছে। বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই মুখটা আবার জানালার কাচে দেখা দেয়। এবার মুখটা আরও কাছে, আরও বিশ্রী লাগছে। অবিনাশ চেঁচামেচি করতে চায় কিন্তু শরীরটা একেবারেই সাড়া দিচ্ছে না। সেই মুহুর্তে, হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ চলে গেল।
ঘরটা অন্ধকারে ঢেকে গেল। অবিনাশ আরও বেশি ভয় পেয়ে গেল। সে জানে না, এখন সে কোন অবস্থায় আছে, সেই ভয়ঙ্কর জিনিসটা ঘরে ঢুকে পড়েছে কিনা। সে শুধু শুনতে পাচ্ছে ঝড়ের গর্জন আর নিজের হৃৎপিণ্ডের উচ্চ আওয়াজ।
এমন সময়, ঘরের কোণ থেকে একটা মৃদু আলো জ্বলে উঠলো। অবিনাশ চোখ বড় বড় করে সেই
দিকে তাকাল। এটা তার ঠাকুরদার পুরোনো হ্যারিকেন লণ্ঠনটা, যেটা বছরের পর বছর ঘরের কোণায় ধুলোয় ঢাকা থাকতো। কিন্তু আজ, সেটা নিজে থেকেই জ্বলে উঠেছে! মৃদু আলোয় ঘরের মধ্যে অবিনাশ একটা মূর্তি দেখতে পেল। এটা তার ঠাকুমার মূর্তি, যে ঠাকুমা কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন। মূর্তিটা হাসছে, কিন্তু সেই হাসিটা কোন সুখের হাসি নয়, যেন একটা রহস্য লুকিয়ে আছে সেই হাসির ভাঁজে।
ঠাকুমার মূর্তিটা আস্তে আস্তে অবিনাশের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। অবিনাশ চিৎকার করতে চাইলো কিন্তু পারলো না। সে জানে না, এটা সত্যি তার ঠাকুমা নাকি কোন অশুভ শক্তি তার ঠাকুমার রূপ ধরে নিয়েছে। মূর্তিটা এখন তার বিছানার ঠিক পাশেই।
হঠাৎ, ঠাকুমার মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। সেই সুন্দর চেহারাটা এখন একটা ভয়ঙ্কর খুলির মতো লাগছে। ঠোঁট দুটো আলগোছে ফেঁপসিয়ে উঠলো এবং একটা শুকনো, কর্কশ কণ্ঠে বললো, “অবিনাশ, তুমি এখন আমার কাছে আসবে।”
অবিনাশ জানতো না কি করবে। সে শুধু চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের চিন্তায় মন দিলো। কিন্তু কিছুই হলো না। ঠাকুমার ভয়ঙ্কর রূপটা তার আরও কাছে এসে গেল। ঠান্ডা একটা হাত তার হাতটা ধরলো।
ঠিক সেই সময়, হ্যারিকেন লণ্ঠনটা নিভে গেল। ঘরটা আবারও অন্ধকারে ঢেকে গেল। হাতটাও ছেড়ে গেল। অবিনাশ আর সহ্য করতে পারলো না। সে চিৎকার করে উঠলো, “ঠাকুমা! দয়া করুন! আমাকে ক্ষমা করুন!” কিন্তু কোনো সাড়া নেই।
কয়েকটা মিনিট পর, ঝড়ের গর্জন কমতে লাগলো। আকাশে সূর্যের আলো দেখা দিল। অবিনাশ চোখ খুললো। সে দেখলো, তার ঠাকুমার মূর্তিটা আবার আগের মতোই রয়েছে। হ্যারিকেন লণ্ঠনটাও নিভে আছে. সারারাতের ঘটনাটা কি স্বপ্ন ছিল?
অবিনাশ বিছানা থেকে নামতে চাইল কিন্তু পারলো না। সে দেখলো, তার হাতটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আর তার হাতের উপর কালো কটা চিহ্ন, ঠিক যেন কোনো অমানবিক শক্তি তার হাত ধরেছিল. অবিনাশ জানে না, সে রাতে ঠিক কি ঘটেছিল। কিন্তু সে জানে, এই অভিজ্ঞতা তার জীবনে চিরদিনের মতো দাগ ফেলে দিয়েছে।