রচনা - সুরজিৎ রায় || গল্প পাঠে - বুবাই সাহা, মৌমিতা সাহা || সমগ্র কারিগরি ও নির্মাণ - মিহান'স প্রোডাকশন হাউস
অধ্যায় ১: সেদিন রাতে
বাংলা রোমাঞ্চকর ভুতের ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
অবিনাশ পুরনো মারুতি গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে একদৃষ্টিতে সামনের পথের দিকে তাকিয়েছিল। গাড়ির জানলার বাইরে রাতের অন্ধকার যেন ঘনিয়ে আসছিল, শীতলকুচির রাস্তাগুলোও ক্রমশ জনশূন্য হয়ে পড়ছিল। শীতকালীন বাতাসের হিমেল ছোঁয়া জানলার ফাঁক দিয়ে তার মুখে এসে লাগছিল। অবিনাশ আজ সকাল থেকেই ব্যস্ত ছিল—ইন্সুরেন্স কোম্পানির ক্লেম অফিসার হিসেবে কাজ করতে সে আজ শীতলকুচি গিয়েছিল একটি কেসের তদন্ত করতে। এই কাজের জন্য সারা দিন ছুটোছুটি করার পর অবশেষে কাজ শেষ করতে রাত হয়ে যায়।
শীতলকুচি থেকে মাথাভাঙ্গার পথে রাস্তার চারপাশের দৃশ্য খুবই শান্ত—গাঢ় অন্ধকারে ডুবে থাকা ধানক্ষেত, গাছগাছালির ঝোপঝাড় আর মাঝে মাঝে দু-একটা পুরনো বাড়ির চূড়া দেখা যাচ্ছিল। অবিনাশের চোখের পাতা ভারী হচ্ছিল, কিন্তু তাকে বাড়ি ফিরতেই হবে। মাথাভাঙ্গা পৌঁছানোর আগেই হঠাৎ গাড়ি একটা ঝটকায় থেমে গেল।
গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে যেন আশেপাশের নিস্তব্ধতা আরও বেশি গভীর হয়ে উঠল। অবিনাশ কিছুটা চমকে উঠল। সে একবার গাড়ির ইঞ্জিন চালু করার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো লাভ হল না। এক অদ্ভুত নীরবতা চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশে হালকা মেঘ জমেছে, আর চাঁদের আলো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গেছে। দূর থেকে হালকা বাতাসে গাছের পাতার ফিসফিস শব্দ শোনা যাচ্ছে। অবিনাশ গাড়ির দরজা খুলে বাইরে নামল। ঠান্ডা বাতাস তার গায়ে আছড়ে পড়তেই সে গায়ের সোয়েটারের কলারটা টেনে তুলল।
“হায় রে, আবার এই সময়ে এমন বিপদ,” অবিনাশ বিরক্তি নিয়ে বলল।
গাড়ির ডিকি খুলে সে তার ছোট টর্চ আর একটা ছাতা বের করল। রাস্তার ধারে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কোনো জনমানব নেই। নির্জনতার মাঝে কোথাও যেন এক অদ্ভুত অস্বস্তিকর অনুভূতি তার শরীরে বয়ে চলছিল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সে সিদ্ধান্ত নিল গ্রামের দিকে হাঁটবে। হয়তো কোনো মেকানিক কিংবা ফোনের ব্যবস্থা করতে পারবে।
টর্চের আলোয় সে রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল। বৃষ্টি ধীরে ধীরে বাড়ছিল, বাতাসও তীব্র হয়ে উঠছে। চারপাশের অন্ধকার ঘন থেকে ঘনতম হয়ে উঠছিল। পায়ের নিচে রাস্তার নরম মাটি কাদা হয়ে গেছে।
“এমন সময়ে গাড়ি বিগড়ে যাওয়ার মানে নেই,” নিজের মনেই বিড়বিড় করল অবিনাশ। কিছুদূর এগিয়ে যেতে হঠাৎ দূরে একটা পুরনো বাড়ি চোখে পড়ল। দুই তলার বাড়ি, বাইরে থেকে মনে হচ্ছিল বহুদিনের পুরনো। রঙচটা দেয়াল, দরজায় লাল রঙের ছোপ যেন সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে আর কোনো বাড়িঘর চোখে পড়ল না।
অবিনাশ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। “একটু আশ্রয় তো পাবো,” বলে সে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অবিনাশ দরজায় টোকা দিল। ভিতর থেকে কোনো আওয়াজ আসছিল না। কিছুক্ষণ পর দরজার কপাটটা কড়াৎ করে খুলে গেল। দরজার ওপারে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। মাথায় ঘোমটা টানা, হাতে একটা কেরোসিনের হ্যারিকেন। হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় তার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না।
“কে?” মহিলার গলা শীতল শোনাল।
অবিনাশ কিছুটা ইতস্তত করে বলল, “আমার গাড়ি একটু আগে খারাপ হয়ে গেছে। আপনার কাছে যদি একটা ফোন থাকত বা মেকানিকের খবর দিতে পারতেন—”
মহিলা হালকা কণ্ঠে বললেন, “ফোন নেই বাবু। এই ঝড়-জলায় কেউ আসবে না। ভিতরে আসুন। বাইরে তো প্রচুর ঝড় শুরু হয়েছে।”
অবিনাশ দরজার দিকে তাকিয়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। একটি অপরিচিত বাড়ি, অপরিচিত মানুষ। কিন্তু বাইরে ঝড় আর বৃষ্টির তীব্রতা দেখে সে আর ভাবতে পারল না। “ঠিক আছে, একটু বসি। ঝড় থামলেই বেরিয়ে যাব,” বলল অবিনাশ।
মহিলা মাথা নিচু করে সরে দাঁড়ালেন। অবিনাশ বাড়ির ভিতরে পা রাখল। ভিতরে ঢুকতেই এক অদ্ভুত ঠান্ডা অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরল। বাড়ির ভেতরটা নিঃশব্দে অন্ধকারে ডুবে আছে। দেয়ালের পলেস্তারার ফাটল ধরে ঝুলে পড়েছে। পুরনো কাঠের মেঝে কড়াৎ কড়াৎ শব্দ করছে। মহিলার হ্যারিকেনের আলোটা ছাড়া আর কোনো আলো নেই।
“এখানে বসুন বাবু। আমি কিছু জলখাবারের ব্যবস্থা করি,” বললেন মহিলা, তার গলা ভারী শোনাল।
অবিনাশ কাঠের একটা মোড়ায় বসে চারপাশে তাকিয়ে দেখল। পুরনো ঘরের দেওয়ালে ছেঁড়া ছবি আর কয়েকটা ফ্রেম ঝুলছে। বাড়ির ঘড়িটা বিকল হয়ে আছে। সবকিছুতেই যেন একটা জীর্ণতার ছাপ।
“আপনার নাম কী?” জিজ্ঞেস করল অবিনাশ।
মহিলা একটু থেমে উত্তর দিল, “রঞ্জনা মুখার্জি। এখানে একাই থাকি। আমার স্বামী বাইরে থাকেন।”
“একা থাকেন?” অবিনাশ একটু অবাক হল।
রঞ্জনা নিঃস্পৃহ গলায় বলল, “হ্যাঁ বাবু, পাঁচ বছর হল বিয়ে হয়েছে। কোনো সন্তান হয়নি।”
এই কথার পর যেন আবার ঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে এল। বাইরে ঝড়ের গর্জন বাড়ছিল। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ যেন বাড়ির দেয়াল ভেদ করে ভিতরে এসে ঢুকছিল।
“বাইরে ঝড় খুব বেড়েছে,” বলে রঞ্জনা অবিনাশকে একটা পিঁড়ি আর রুটি-তরকারি দিয়ে গেল।
অবিনাশ খেতে বসল। কিন্তু অস্বস্তির অনুভূতি তার পিছু ছাড়ছিল না। মহিলার চলাফেরা আর কথা বলার ভঙ্গিতে একটা অদ্ভুত কিছু ছিল। আশেপাশের নিস্তব্ধতাও তাকে অস্বস্তিতে ফেলছিল। খাওয়া শেষ করে অবিনাশ বলল, “ঝড় থামলেই আমি বেরিয়ে যাব। আপনাকে একটু সমস্যায় দিলাম।”
রঞ্জনা কোনো উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “রাত অনেক হয়েছে বাবু। একটু বিশ্রাম করুন। আমি আপনাকে একটা ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি।”
অবিনাশ আর কিছু বলল না। রঞ্জনা তাকে একটি ঘরের দরজার সামনে নিয়ে গিয়ে বলল, “এখানেই থাকুন। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে নেবেন।”
অবিনাশ মাথা নাড়ল। রঞ্জনা হ্যারিকেনের আলো হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে অন্ধকার করিডোরের ভিতরে মিলিয়ে গেল। তার পায়ের শব্দ দূর থেকে মিলিয়ে যেতে শুরু করল।
অবিনাশ দরজা বন্ধ করে ঘরের ভেতর ঢুকে টর্চের আলো জ্বালল। ঘরটা ছোট, কিন্তু মেঝে পুরনো কাঠের। এক অদ্ভুত গন্ধে ঘর ভরে ছিল। মোমবাতির আলো জ্বালিয়ে সে ঘরের কোনায় রাখা একটা পুরনো বিছানায় বসে পড়ল।
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - অন্ধকারের ডাক: ভুতের গল্প প্রেমিক রোহিত ও মায়ার, অমরত্বের লোভে ভয়ঙ্কর রহস্যের সমাধান। ঝাড়খণ্ডির গ্রামে বাংলা গল্প ভুতের ডাক, মৃত্যুর দেবতার সাথে চুক্তি, আর আত্মত্যাগের মহত্ত্ব। কীভাবে অমরত্বের লোভ ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনল? এই রহস্যময় বাংলা গল্পে জেনে নিন ভুতের ডাকের প্রকৃত কারণ! সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ২: অদ্ভুত উপস্থিতি
বাংলা রোমাঞ্চকর ভুতের ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
নিশ্ছিদ্র নীরবতার মাঝখানে পুরনো ঘরটি যেন এক রহস্যময় ছায়ায় ঢেকে ছিল। বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব কিছুটা কমলেও বৃষ্টির ঝাপটা আর বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ যেন কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছিল। অবিনাশ ধীরে ধীরে শোবার ঘরে ঢুকল। ঘরটা ছোট হলেও অদ্ভুত এক গুমোট ভাব ছড়িয়ে ছিল। পুরনো কাঠের খাট, তাতে একটা মলিন তক্তাপোশ; পাশে টেবিলে একটা ভাঙা আয়না, আর কোণে একটা পুরনো কাঠের আলমারি।
রাত তখন গভীর, প্রায় একটা ছুঁইছুঁই। বাইরে নিস্তব্ধতার মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে ঝিঁঝি পোকার কণ্ঠস্বর আর গাছের পাতার মর্মর ধ্বনি। ঘরের মধ্যে যেন সেই নৈঃশব্দ আরও ঘনীভূত। বাতাস ভারী, শীতল। দেওয়ালে ঝোলানো পুরনো ঘড়িটার কাঁটা যেন অদ্ভুতভাবে ধীরে চলতে শুরু করেছে, যেন সময় থমকে গেছে।
অবিনাশ বিছানায় শুয়ে, চাদর মুড়ি দিয়ে চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ঘরের সেই ঠান্ডা… না, এই ঠান্ডা আর পাঁচটা শীতের ঠান্ডা নয়। এটা যেন হাড়ের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতলতা। ঘরের বাতাসে একটা অদ্ভুত গন্ধ ভাসছিল—নোনতা, পচা মাংসের মতো।
ঘরের চারপাশে তাকিয়ে অবিনাশের কেমন যেন অস্বস্তি হলো। জানালার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছিল, মেঘের আড়ালে চাঁদের আলোর ছায়া মেঝের উপর নড়াচড়া করছিল। ঘরের মধ্যে একটা পচা, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ মিশে আছে। গন্ধটা যেন ভেজা কাঠ আর মাটির সাথে মিশে আছে কোনো অজানা কিছুর। অবিনাশ শিউরে উঠল। নিজের সঙ্গেই ফিসফিস করে বলে উঠল,
“কি সব জায়গায় এসে পড়লাম! এই লোকালয়ে ফোন তো দূরের কথা, মানুষজনও দেখা যায় না। রঞ্জনা নামের মহিলাটাও কেমন অদ্ভুত! স্বামী বাইরে থাকে, অথচ কী যেন লুকাচ্ছে।”
সে একটা মোমবাতি খুঁজে টেবিলের ওপর রেখে জ্বালালো। মোমের হালকা আলোয় ঘরটার ছায়া আরও ভৌতিক হয়ে উঠল। দেয়ালের দিকটা ভালো করে লক্ষ্য করতেই তার চোখ আটকে গেল। দেয়ালের প্লাস্টারের উপর কিছু অদ্ভুত কালো দাগ। চতুর্ভুজ আকৃতির মতো কিছু চিহ্ন, যা দেখে মনে হচ্ছিল কেউ বুঝে-শুনে আঁকেনি, বরং যেন ক্ষিপ্তভাবে আঁচড় কেটেছে। অবিনাশের মনের মধ্যে কেমন যেন একটা শীতল ভয় দানা বাঁধছিল।
সে নিজের মনকে শান্ত করতে বিছানার একপাশে বসল। “এইসব পুরোনো বাড়িতে এমন ছাপ তো দেখা যায়। হয়তো জলের দাগ… বা পোকামাকড়ের কাজ।” নিজের মনকে প্রবোধ দিয়ে সে মোমবাতির আলোয় চারপাশে আবার নজর বুলাল। টেবিলের ভাঙা আয়নাটা দেখে কেমন একটা অস্বাভাবিক অনুভূতি হলো। মনে হলো যেন কেউ তাকে দেখছে। অবিনাশ অস্থির হয়ে একবার আয়নাটার দিকে তাকাল, আবার তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল।
“ভূত-প্রেত কিছুই নেই। এ সব বাজে কথা,” সে নিজেকেই বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু বুকের ভেতর একটা অজানা ভয় যেন গা শিরশির করে উঠছিল।
শুতে গিয়ে অবিনাশ কম্বলটা জড়িয়ে নিল। বাইরে ঝড়ের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তখনই, হঠাৎ ঘরের ভেতরটা আরও অস্বাভাবিক ঠান্ডা হয়ে উঠল। যেন অদৃশ্য কেউ জানালার ফাঁক দিয়ে শীতল বাতাস ঢুকিয়ে দিচ্ছে। মোমবাতির শিখা ক্ষীণ হয়ে কাঁপতে লাগল। ঘরের নিস্তব্ধতায় যেন আরও গাঢ় শূন্যতা এসে জমল।
চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতেই, তার কানে এল একটা দূরের আওয়াজ। প্রথমে মনে হলো বাতাসের শব্দ, কিন্তু একটু পরেই সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠল—মহিলার ফুঁপিয়ে কান্না। কণ্ঠস্বরে যেন করুণার চেয়ে বেশি ভয়।
হঠাৎই একটা ঠাণ্ডা বাতাস সজোরে এসে জানালাটা খুলে দিল। পর্দা দুলে উঠল। একইসঙ্গে রান্নাঘর থেকে আসা বাসনের ঠোকাঠুকি শব্দে অবিনাশের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল।
“কে কাঁদছে এই রাতে?” অবিনাশ নিজেকেই প্রশ্ন করল। সে উঠে বসল। কান পাততেই কান্নার আওয়াজটা আরও জোরে এল, যেন ঘরের বাইরের দিক থেকে। ভয় আর কৌতূহলের মিশ্র অনুভূতিতে অবিনাশ দরজা খুলে বাইরে বেরোল।
কেউ জবাব দিল না। হাতের টর্চটা ধরে সে আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে নামল। ঘরের মেঝে যেন বরফের চেয়েও ঠান্ডা। পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগিয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করতেই একটা গভীর আর্তনাদ ভেসে এল।
“আ-আ-মাকে বাঁচাও…”
অবিনাশের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। কণ্ঠস্বরটা ছিল নারীর। সে দরজা খুলে করিডোরে পা রাখতেই দেখে—সামনের ঘরের সোফায় রঞ্জনা বসে আছে। কিন্তু রঞ্জনা তো…! তার চোখ বড় হয়ে গেল।
সামনের হলঘরে গিয়ে দেখল, রঞ্জনা এক কোণে রাখা পুরোনো সোফায় বসে আছে। কেরোসিনের হ্যারিকেনটা টিমটিমে আলো ছড়াচ্ছিল। রঞ্জনার মাথা নিচু, তার গলা থেকে আসছে মৃদু কান্নার শব্দ। অবিনাশ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।
“কী হয়েছে? আপনি কাঁদছেন কেন?”
রঞ্জনা কিছু না বলে কাঁদতে থাকল। কিছুক্ষন পর রঞ্জনা ধীরে ধীরে মাথা তুলল। রঞ্জনা হঠাৎ মুখ তুলল। টর্চের আলোয় অবিনাশ যা দেখতে তাতে তার হাত থেকে প্রায় টর্চ পড়ে যাওয়ার জোগাড়। টর্চের আলোটা তার মুখের ওপর পড়তেই অবিনাশ চমকে উঠে পিছু হঠল। রঞ্জনার মুখটা যেন এক পোড়া কঙ্কালের মতো। তার চোখের জায়গায় গভীর গহ্বর, আর ঠোঁটের চারপাশে পোড়া চামড়ার মতো দাগ। মুখে অদ্ভুত বিকৃত হাসি।
“আমাকে ভয় পেয়ো না বাবু।” রঞ্জনা তীব্র অথচ বিষণ্ণ স্বরে বলল। তার গলা যেন গহ্বর থেকে আসছে।
রক্তহীম হয়ে গেল তার শরীর। পা যেন এক জায়গায় আটকে গেছে। রান্নাঘরের দিক থেকে এবার এল বাসনপত্র ঠোকাঠুকির শব্দ। যেন কেউ রান্নাঘরে কিছু করছে। অথচ পুরো বাড়িতে রঞ্জনা ছাড়া আর কেউ থাকার কথা নয়।
অবিনাশের কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল, “কে… কে রান্নাঘরে?”
রঞ্জনা এবার আর কোনো কথা বলল না। শুধু সেই বিকৃত মুখটা নিঃশব্দে অবিনাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তার ঠোঁটের কোণে সেই ভয়ানক হাসি।
অবিনাশ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। পায়ের কাছে রাখা টর্চটা তুলে ধরে সে ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে এগোল। ঘরের নিস্তব্ধতা এবার যেন কান ফাটিয়ে দিচ্ছে। রান্নাঘরের দরজার সামনে গিয়ে সে থমকে দাঁড়াল। ভিতর থেকে এখনও ঠকঠক আওয়াজ আসছে।
কাঁপতে কাঁপতে অবিনাশ দরজার পাল্লা ঠেলে খুলল। কিন্তু রান্নাঘরের ভেতরটা খালি। কিচ্ছু নেই। শুধু একটা পুরোনো বালতির উপর রাখা বাসনগুলো টালমাটাল অবস্থায় পড়ে আছে।
বাতাসের মধ্যে আবার সেই গা শিউরে ওঠা গন্ধ। এবার যেন গন্ধটা আরও তীব্র, আরও পচা। হঠাৎ, টর্চের আলোয় রান্নাঘরের মেঝেতে দেখতে পেল একটা ছায়া। কারও দাঁড়িয়ে থাকার ছায়া। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে কেউ নেই।
“কে… কে আছো এখানে?” অবিনাশের গলা কাঁপল। কিন্তু কোনো উত্তর এল না।
পিছন থেকে এবার শুনতে পেল সেই চেনা কান্নার আওয়াজ। ফিরে তাকাতেই দেখল রঞ্জনা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু এবার রঞ্জনার মুখটা পুরো কঙ্কাল হয়ে গেছে। তার পোশাক ছেঁড়া, আর গায়ের চামড়া যেন জ্বলে-পুড়ে কালো হয়ে গেছে।
টর্চ অবিনাশের হাত থেকে পড়ে গেল। আতঙ্কে দৌড় লাগাল সে। কিন্তু পুরোনো কাঠের মেঝেতে পা হড়কে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলাল। রঞ্জনার শীতল কণ্ঠস্বর যেন গোটা বাড়িতে প্রতিধ্বনি তুলল,
“এখানে কেউ বাঁচে না, বাবু… কেউ বাঁচে না!”
অবিনাশের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কী করবে বুঝতে পারছিল না। তার চারপাশে কেবল সেই ভৌতিক নীরবতা আর দূরের অদৃশ্য কোনো কান্নার সুর।
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - গ্র্যান্ড হোটেলের রাত্রি: এক ভয়ঙ্কর রাত্রি, ৭ জন বন্ধু পরিত্যক্ত গ্র্যান্ড হোটেলে আটকা পড়ে। রহস্য, ভয়, মৃত্যু – সব মিলিয়ে এক রোমাঞ্চকর বাংলা ভুতের গল্প। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৩: সত্যের মুখোমুখি
বাংলা রোমাঞ্চকর ভুতের ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
অবিনাশের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। দেওয়ালের দিকে পিছিয়ে যেতে গিয়ে সে একেবারে গায়ের সঙ্গে লেগে গেল। তার চোখ দুটো ক্রমশ বিস্ফারিত হচ্ছিল, শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল। রঞ্জনার ছায়ামূর্তিটা যেন ঘরের অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গিয়েও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
“তু… তুমি কে? কী চাও আমার কাছ থেকে?” অবিনাশের গলা ভাঙা ফুঁসে উঠল।
রঞ্জনা ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে গেল। তার নড়াচড়া এত নিস্তব্ধ ছিল যে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। তার পোশাকের জীর্ণ অংশগুলো ঝলসে যাওয়া, জায়গায় জায়গায় ছাইয়ের গাঢ় দাগ। মাথার চুল এলোমেলো হয়ে ঝুলে পড়েছে, তাতে যেন ধোঁয়ার কালো আভা লেগে আছে। রঞ্জনার চোখের জায়গায় গভীর ফাঁপা গহ্বর, কিন্তু তাতে শূন্যতা নেই—কেমন যেন জ্বলন্ত ছাইয়ের আলোর মতো কিছু মিটমিট করছে।
“আমার গল্পটা শোনো বাবু।”
রঞ্জনার কণ্ঠস্বর যেন চিরকালীন কষ্টে ডুবে থাকা একটা পুরনো মাটির হাঁড়ির ভাঙা শব্দ। অবিনাশের পা যেন মেঝেতে শেকড় গেড়ে বসে গেল। পালাবার ইচ্ছা থাকলেও শরীরটা যেন কাজ করছে না।
“তুমি মরে গেছ!” বলে উঠল অবিনাশ, তার মুখের কথা নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিল না।
“হ্যাঁ, আমি মরে গেছি।” রঞ্জনার কণ্ঠে এবার একটা তীক্ষ্ণ হাসির প্রতিধ্বনি। “কিন্তু মরেও শান্তি পাইনি।”
এই কথা বলতে বলতে রঞ্জনা সামনে এগিয়ে এল। তার চলার পথের মেঝেতে যেন কালো ছাইয়ের রেখা পড়ে যাচ্ছিল। অবিনাশ কান খাড়া করে দেখল, তার পায়ের নীচ থেকে যেন হালকা সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছে, যেন পোড়া মাংসের গন্ধ।
“ওরা আমাকে পুড়িয়ে মেরেছে,” রঞ্জনা ফিসফিস করে বলল, আর তার গলার স্বর কেঁপে উঠল। “রান্নাঘরের গ্যাস লিকেজ, হাহ্! সবাই ভেবেছিল দুর্ঘটনা, কিন্তু এটা খুন ছিল। আমার স্বামী… সেই শয়তান, ইনশিওরেন্সের টাকার জন্য আমার শরীরটাকে আগুনের লেলিহান শিখায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তারপর নির্বিকার মুখে চলে গেল কলকাতায়, নতুন বিয়ে করে সুখের সংসার পাতল।”
অবিনাশের কানে যেন বাজ পড়ল। এই ভয়ানক সত্য শোনার শক্তি তার শরীরে আর অবশিষ্ট নেই।
রঞ্জনা এবার থেমে দাঁড়াল। তার মুখের এক পাশে চামড়া কেমন যেন পুড়ে গিয়ে কালচে হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই তার চোখ থেকে কালো তরল গড়িয়ে নামতে লাগল। সেটা যেন চোখের জল নয়, বরং কালো রক্তের মতো ঘন কিছু।
“তুমি… তুমি কী চাও?” অবিনাশের গলা আবারও কেঁপে উঠল।
রঞ্জনা তার কঙ্কালের মতো হাতটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিল। তার হাতের নখগুলো সাদা আর লম্বা, যেন সেটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু। তার হাতে একটা পুরনো ফাইল। ধুলোপড়া, কোণাগুলো ছিঁড়ে গেছে, আর তার ওপর অদ্ভুত দাগ।
“এই নাও বাবু। এই ফাইলেই সব প্রমাণ আছে।” রঞ্জনা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল। “অজয় বিশ্বাস আর সন্দ্বীপ বসু—ওরা দু’জনেই এই ষড়যন্ত্রে জড়িত। তোমার কোম্পানির ভিজিল্যান্সে দাও এই ফাইলটা। ওদের শাস্তি দিতে হবে।”
ফাইলটা অবিনাশের হাতে তুলে দিতেই একটা অদৃশ্য ঠান্ডা স্পর্শ তার আঙুলে লাগল। ফাইলটা এত ঠান্ডা ছিল যে অবিনাশের মনে হল বরফের চেয়েও জমাট। চারপাশে ঝড়ের শব্দ আরও বেড়ে উঠল। জানালার পাল্লা আচমকা খুলে গিয়ে ধাক্কা মারল। বাইরে কোথাও যেন কান্নার আওয়াজ ভেসে এল।
“তুমি আমাকে সাহায্য করবে তো, বাবু?” রঞ্জনার গলার স্বর এবার যেন আরও ভারী আর গভীর হয়ে উঠল।
অবিনাশের মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোল না। তার ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। সে শুধু মাথা নাড়ল।
এমন সময় রঞ্জনার মুখটা বিকৃত হতে লাগল। তার মুখের চামড়া আরও গলতে শুরু করল, নীচের হাড়ের অংশ বেরিয়ে এল। চোখের গহ্বর থেকে কালো ধোঁয়ার মতো কিছু বেরিয়ে আসছিল। ঘরের বাতাসে সেই পোড়া গন্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠল।
“ভুল করো না বাবু। সত্যি লুকিও না…”
ফিসফিসানিটা এবার আরও জোরালো হয়ে উঠল। অবিনাশের মনে হল যেন চারপাশের দেয়াল থেকে অসংখ্য মুখ তার দিকে তাকিয়ে আছে, তাদের চোখে একই রকম তীব্র আক্রোশ আর দুঃখ। বাতাসে বিকট হাসির শব্দ ভেসে এল। জানালার পর্দা অদ্ভুত ভাবে উড়ে উঠল, যেন কেউ ওগুলোকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে।
হঠাৎ সমস্ত আলো নিভে গেল। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে গেল। অবিনাশ অনুভব করল ঘরের মধ্যে আরও কেউ আছে।
“কে… কে আছো?” তার গলা কাঁপল।
একটা ঠান্ডা নিশ্বাস তার ঘাড়ের কাছে লাগল। পেছনে তাকিয়ে সে কিছুই দেখতে পেল না। কিন্তু দেওয়ালের ছায়া যেন নড়ছে। সেখান থেকে একটা অবয়ব বেরিয়ে এল—একটা কালো অবয়ব, যার চেহারাটা রঞ্জনার মতোই।
“আমার বিচার চাই, বাবু।”
অবিনাশ আর সহ্য করতে পারল না। তার চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে এল। ফাইলটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে রইল। হঠাৎ ফাইলের ওপর কালো রক্তের ফোঁটা পড়তে শুরু করল।
ঘরের ভেতর সেই হাসির প্রতিধ্বনি আরও জোরে ছড়িয়ে পড়ল। আর বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব যেন পুরো বাড়িটাকে গিলে ফেলতে চাইছে। অবিনাশ নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে রইল মাটিতে।
হালকা ফিসফিসানি কানে ভেসে এল—
“সত্যিটা চাপা পড়তে দিও না, বাবু… নাহলে আমিও তোমার কাছে ফিরে আসব।”
বাতাসে ভেসে এল একটা বিকট আওয়াজ, যেন ঘরের সব জানালা একসঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল। চারপাশ আবার নিস্তব্ধ।
অন্ধকার ঘরে অবিনাশের শরীর নিথর হয়ে পড়ে রইল। সেই ফাইলের পাশে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল কালো রক্তের দাগ…
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - কুয়াশার কান্না: এক গ্রামে রহস্যময় কুয়াশা, অভিশাপ, আর অদ্ভুত ঘটনার কেন্দ্রে এক লেখিকা। ঈশান দত্তের জমি দখলের কাহিনী, অভিনন্দ দত্তের আত্মহত্যা, শিবনাথের লেখা রহস্যের সূত্র। কুয়াশার মধ্যে কান্নার শব্দ, অদ্ভুত ছেলে, সোনার বংশের রহস্য – সবকিছু মিলে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী। সত্যিটা কি অভিশাপ?লেখিকা কি সমাধান করতে পারবেন রহস্য? সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৪: পুড়ে যাওয়া স্মৃতি
বাংলা রোমাঞ্চকর ভুতের ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
অবিনাশের জ্ঞান ফিরতেই তার সমস্ত শরীরে এক অবর্ণনীয় ব্যথা চেপে বসল। মাথাটা ভারী লাগছিল, গা গুলিয়ে আসছিল। সে ধীরে ধীরে চোখ খুলল। সামনে এক ভয়ংকর দৃশ্য—ধ্বংসস্তূপের ভেতর সে পড়ে আছে। জায়গাটা যেন কোনো পোড়া প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ। ছাইয়ের গন্ধ এখনও বাতাসে মিশে রয়েছে, যেন আগুনের লেলিহান শিখা এখুনি নেভানো হয়েছে।
পাশেই পড়ে আছে সেই ফাইলটা, পুরনো ধুলোমাখা কাগজে লেপ্টে থাকা এক অদ্ভুত কালচে ছাপ। অবিনাশ কিছুক্ষণের জন্য নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না। রাতের সেই বিভীষিকা—রঞ্জনা, তার পোড়া চেহারা, বিকৃত হাসি, ঘরের আতঙ্কজনক পরিবর্তন—সব কিছু এক ঝটকায় মনের মধ্যে ফিরে এল।
সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। গোটা জায়গাটা যেন কেমন অদ্ভুতভাবে নিঃস্তব্ধ। ঘর ভেঙে পড়েছে, দেওয়ালগুলোর গায়ে আগুনের চিহ্ন। জানালার কাচগুলো গলিত অবস্থায় ঝুলে আছে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়েই অবিনাশ বুঝল, কোথাও একটা ফিসফিসানি হচ্ছে।
“অবিনাশ বাবু…”
গলার স্বরটা যেন দেওয়ালের মধ্যে থেকে আসছে। অবিনাশের পা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। সে পেছনে তাকাল। দেওয়ালের কোণায় সেই পোড়া ছায়াটা আবার দেখা দিল। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা রঞ্জনার অবয়বটা এবার আগের চেয়েও বিকৃত। তার পোড়া গায়ের চামড়া গলে পড়ছে, আর চুলগুলো যেন বাতাসে নিজে থেকেই উড়ছে।
“তুমি তো কথা দিয়েছিলে, বাবু,” রঞ্জনার স্বরটা কেঁপে উঠল। “আমার সত্যিটা সবাইকে জানাবে…”
“আমি জানাবো, সবাইকে জানাবো!” অবিনাশ চিৎকার করে বলে উঠল। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। “ফাইলটা জমা দেব। তদন্তও শুরু হবে। ওরা শাস্তি পাবে।”
রঞ্জনা হাসল। সেই হাসিটা শুনে যেন শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
“শাস্তি পাবে তো?” হঠাৎ করেই তার গলার স্বর তীব্র হয়ে গেল। “তাদের কি সেই আগুনে পোড়ানো হবে, বাবু? আমার মতো? আমার আর্তনাদ কি ওদের কানে পৌঁছবে? না কি শুধু কারাগারের গরাদেই শেষ হবে ওদের পাপ?”
অবিনাশের মাথা ঘুরতে লাগল। রঞ্জনার চোখদুটি হঠাৎই গাঢ় লাল হয়ে উঠল, সেখান থেকে গলগল করে কালো রক্ত বেরোতে লাগল। তার শরীর থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বাতাসে পোড়া মাংসের গন্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠল।
“বেরিয়ে যেতে দাও আমাকে!” অবিনাশ কাতর স্বরে চেঁচিয়ে উঠল। “আমার এখন কিছু করার নেই আর!”
রঞ্জনা ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল। তার পায়ের নিচে ছাই উড়ছে।
“তোমার কাছেই ভরসা, বাবু,” তার স্বরটা করুণ হয়ে এল। “আমার আত্মা মুক্তি চাইছে। জানিয়ে দাও সবাইকে। তাদের মুখোশ খুলে ফেলো…”
এবার ঘরের ভেতর হঠাৎ করেই আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। দেওয়ালের গা বেয়ে আগুন উঠছে, জানালার পর্দাগুলো দাউদাউ করে জ্বলছে। কিন্তু সেই আগুন অবিনাশকে ছুঁতে পারল না। চারপাশে আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে রঞ্জনা বিকট হাসি হাসছে। অবিনাশ মাটিতে পড়ে গেল, মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার করতে লাগল। চারপাশে একের পর এক ভয়ংকর মুখ ভেসে উঠছে—আগুনে পোড়া হাত, বিকৃত চেহারা, গলিত চোখের কোটর থেকে তাকে দেখছে।
“আমাকে ছেড়ে দাও!”
হঠাৎই সব কিছু থেমে গেল। নিস্তব্ধতা নামল চারপাশে। আগুনের শিখা নেই, রঞ্জনার ছায়াও উধাও। ঘরটা আবার সেই পোড়া ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অবিনাশ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার শরীরটা যেন পাথর হয়ে গেছে। ফাইলটা সে শক্ত করে ধরে ফেলল।
“আমি এটা শেষ করব।” তার কণ্ঠে শঙ্কা মিশ্রিত দৃঢ়তা।
কয়েক সপ্তাহ পর অবিনাশের কোম্পানিতে তদন্ত শুরু হলো। অজয় বিশ্বাস আর সন্দ্বীপ বসুর কুকীর্তি প্রকাশ্যে এল। রঞ্জনার মৃত্যুর পুরো সত্যি সামনে এলো। ইনশিওরেন্সের টাকার লোভে কীভাবে তারা নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করেছিল, তার প্রমাণ ফাইলের মধ্যেই ছিল। সংবাদপত্রে বড় বড় হেডলাইন বেরোল।
“আমি আমার দায়িত্ব পালন করলাম, আমি রঞ্জনাকে দেওয়া কথা রাখলাম।,” অবিনাশ নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু একটা অদ্ভুত অনুভূতি তার পিছু ছাড়ছিল না।
ঘটনার কয়েক মাস পর, অবিনাশ আবার সেই পোড়া বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল। সন্ধ্যা নেমে আসছে। ধোঁয়াটে অন্ধকারে বাড়িটার অবয়বটা আরও রহস্যময় মনে হচ্ছিল। ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। চারপাশে ধ্বংসাবশেষ, ছাইয়ের স্তূপ।
তার চোখ হঠাৎ একটা দেওয়ালের দিকে আটকে গেল।
সেখানে কয়লার লেখা—
“ধন্যবাদ অবিনাশ বাবু।”
অক্ষরগুলো দেখে যেন বুকের ভেতর ধক করে উঠল তার। শীতল হাওয়ার একটা ঝাপটা এসে গেল ঘরের ভেতর দিয়ে।
বাতাসের মধ্যে ভেসে এল সেই পরিচিত ফিসফিসানি, “শান্তি পেলাম, বাবু…”
অবিনাশ চমকে চারপাশে তাকাল। ঘর ফাঁকা। কিন্তু সেই হাসিটা—রঞ্জনার সেই মৃদু হাসির প্রতিধ্বনি, এখনও বাতাসে যেন ঝুলে আছে।
সে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সন্ধ্যার আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। দূর থেকে বাজ পড়ার শব্দে মাটি কেঁপে উঠল।
বাড়ির বাইরে এসে সে একবার পেছনে তাকাল। বাড়িটার ছাদে যেন অদ্ভুতভাবে একটা ছায়া দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। বাতাস হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। স্তব্ধ নিস্তব্ধতা নামল চারপাশে। দূর থেকে এক ঝাঁক কাক উড়ে গেল, তাদের পাখার শব্দে যেন একটা শেষ শীতল বার্তা বয়ে গেল তার কানে—
“সত্যিটা কখনো চাপা থাকে না…”