অধ্যায় ১: বন্ধুত্বের পুনর্মিলন
কলকাতার বুকের বহু পুরনো অলিগলি, যেখানে দিনের আলোও ঠিকমতো পৌঁছায় না। সেসব গলির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দীপ্রাচীন এক হোটেল—‘গ্র্যান্ড হোটেল’। এক সময়ে রাজকীয়তা আর চাকচিক্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এই ভবন এখন কেবল এক শূন্য অভিশপ্ত কাঠামো। বাইরে থেকে দেখলেই শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নামে। হোটেলের জানালার ভাঙা কাঁচে ধূসর শ্যাওলার স্তর জমেছে, সিঁড়ির রেলিংগুলো মরচে পড়ে গেছে, আর বাতাসে লেগে আছে এক অদ্ভুত ভেজা গন্ধ। মনে হয়, যেন শতাব্দীপ্রাচীন দেয়ালগুলো কিছু বলতে চাইছে… কিছু চেপে রাখা কথা। দিনের আলোতে পরিবেশ যতটা অস্বস্তিকর, রাতের অন্ধকারে যেন এই ভবন নিজেই জেগে ওঠে।
এমনই এক অন্ধকার রাতে সাতজন বন্ধু—সোনা, আকাশ, নীল, রিমা, ইন্দ্র, শুভম আর অনি—জড়ো হয়েছে গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে। আসলে নীলের জন্যই এই আয়োজন। সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিচ্ছে, আর যাওয়ার আগে সবার সঙ্গে এক রাত কাটিয়ে নস্টালজিয়ার স্বাদ নিতে চেয়েছে। বন্ধুরা প্রথমে দ্বিধা করলেও শেষমেশ এই ভুতুড়ে জায়গাটাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে তাদের শেষ আড্ডার জন্য।
নীল উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল, “এই তো, পারফেক্ট স্পট! সবটা যেন সিনেমার সেটের মতো!”
কিন্তু সোনা আর রিমা এতটাও স্বস্তিতে নেই। গ্র্যান্ড হোটেল ঘিরে কলকাতার লোকমুখে নানা গল্প শোনা যায়। একসময় এই হোটেলে নাকি বেশ কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। কেউ ফিরে আসেনি, কেউ শুনেছে দেওয়ালের আড়াল থেকে কান্নার শব্দ।
“কী ভেবেছিস তোরা? ভূত-টুত কিছু নেই। যা আছে, আমাদের মস্ত আড্ডা আর কিছু পুরনো স্মৃতি।” নীলের গলায় জোরালো হাসির সুর। কিন্তু সেই হাসিতে বন্ধুরা আশ্বস্ত হতে পারল না।
ভাঙা দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢোকার সময়েই একটা শিরশিরানি অনুভব করল সবাই। দরজার কব্জাগুলো চিৎকারের মতো শব্দ তুলে খুলে গেল, যেন কেউ তাদের ভেতরে টেনে নিচ্ছে। নিস্তব্ধতা এতটাই গভীর যে নিজেদের পায়ের আওয়াজও প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে। করিডোরের দেওয়ালজুড়ে সাদা ছোপ আর শ্যাওলার রেখা, একেকটা যেন বিকৃত মুখের মতো দেখতে লাগছে। কার্পেট মুড়ে গিয়ে ধুলো জমে শক্ত হয়ে গেছে, এবং বাতাস ভারী, তীব্র গুমোট।
“এটা কি সত্যিই নিরাপদ জায়গা?” রিমার কণ্ঠে একটা দমচাপা ভয় ছিল।
“ভয় পাচ্ছিস? আরে ধুর! এটা একটা হোটেল মাত্র।” আকাশ নরম হাসল।
সিঁড়ির ধুলো জমা কার্পেটের ওপর দিয়ে বন্ধুরা উঠে গেল প্রধান হলঘরে। সেখানে একটা পুরনো, ভাঙাচোরা সোফা পড়ে আছে মাঝখানে। ধুলোয় মোড়া চেয়ার আর একপাশে পড়ে থাকা একটি কালো রঙের টিভি, যার পর্দা ফেটে গেছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ বহু বছর ধরে এই জায়গার দিকে তাকিয়েও দেখেনি।
“ওয়াও! এখানেই আমরা বসব। সত্যি জমবে আজকের রাত!” নীল খুশি হয়ে সোফায় বসে পড়ল।
কিন্তু ঠিক তখনই, ঠান্ডা বাতাসের একটা ঝাপটা এসে মুখে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা চাপা নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। অন্ধকার কোণ থেকে যেন কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে। রিমা থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
“শুনছিস?” ওর গলায় শঙ্কা।
“কি হলো? ভয় পেয়েছিস?” নীল হাসতে হাসতে বলল।
এমন সময় ইন্দ্র গম্ভীর গলায় বলে উঠল, “শুনেছিস তোরা? এই হোটেলে নাকি একটা মেয়ের আত্মা ঘুরে বেড়ায়। নাম ছিল মায়া। কুড়ি বছর আগে এখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সেই থেকে লোকজন বলে মায়া আজও এখানে আটকে আছে।”
‘মায়া’র নামটা যেন কক্ষে আরও ঠান্ডা অনুভূতি এনে দিল। কেউ যেন এক নিঃশব্দ চিৎকার করছে, যা কেবল তাদের অনুভূতিতে পৌঁছাচ্ছে। সোনার কণ্ঠ কাঁপল, “এসব গল্প বলে আর ভয় বাড়াস না।”
“আরে! ভূতের গল্প তো না, মজা করছি। ভয় পেলে বলে দে!” নীলের কণ্ঠে জোরালো হাসি। কিন্তু ওর হাসির আড়ালেও একটা ছদ্ম চাপা ভয় ছিল।
ঠিক তখনই, দরজার বাইরে থেকে কড়া নাড়ার আওয়াজ এলো। বন্ধুরা একে অপরের দিকে তাকাল। কেউই নড়ল না।
“কেউ কি আসছে?” আকাশ ফিসফিস করল।
“এখানে আসবেই বা কে? এটা তো বহু বছর ধরে বন্ধ।” শুভমের গলায়ও আতঙ্ক।
হঠাৎ একটা বিকট শব্দ হলো ওপর তলায়, যেন ভারী কিছু একটা মাটিতে আছড়ে পড়ল। শব্দটা এত জোরে ছিল যে সবাই একসঙ্গে চমকে উঠল। নীরবতা আবার ফিরে এলো। কিন্তু সেই নীরবতার মধ্যে এবার যেন স্পষ্ট মনে হলো কারও পদশব্দ। ধীরে ধীরে, ভারী পায়ের শব্দ নামছে সিঁড়ির ধাপ ধরে।
“এটা কি…?” রিমার গলায় স্বর ফেটে গেল।
বন্ধুরা একে অপরের হাত শক্ত করে ধরল। সেই পদশব্দ ধীরে ধীরে কাছাকাছি আসছে। অন্ধকারে কুয়াশার মতো একটা অবয়ব সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রিমার চোখ স্থির হয়ে গেল—একটা মেয়ের অবয়ব, সাদা জামা পরা, মুখটা ধোঁয়াশায় ঢাকা। সেই অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে, চুপচাপ।
“চল, পালাই এখান থেকে!” সোনা ভয়ে চিৎকার করে উঠল।
কিন্তু ঠিক তখনই ভাঙাচোরা টিভির পর্দায় হঠাৎ বিকট এক শব্দে ঝিঁঝিঁ করে উঠল। পর্দার ফাটল থেকে যেন রক্ত ঝরছে, আর সেই রক্ত লাল রঙের বুদবুদের মতো নড়ছে। বন্ধুরা হতভম্ব হয়ে দেখছে সেই দৃশ্য।
এখনও সেই সাদা অবয়ব নড়েনি। মুখটা ধীরে ধীরে তাদের দিকে ফিরছে। বাতাসে যেন ফিসফিস করে কিছু একটা শব্দ ভেসে এলো, “তোমরা… এখানে কেন?”
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - কুয়াশার কান্না: এক গ্রামে রহস্যময় কুয়াশা, অভিশাপ, আর অদ্ভুত ঘটনার কেন্দ্রে এক লেখিকা। ঈশান দত্তের জমি দখলের কাহিনী, অভিনন্দ দত্তের আত্মহত্যা, শিবনাথের লেখা রহস্যের সূত্র। কুয়াশার মধ্যে কান্নার শব্দ, অদ্ভুত ছেলে, সোনার বংশের রহস্য – সবকিছু মিলে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী। সত্যিটা কি অভিশাপ?লেখিকা কি সমাধান করতে পারবেন রহস্য? সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ২: অজানা আতঙ্কের শুরু
শুভম গা-ঝাড়া দিয়ে বলে, “দেখে আসছি! কিচ্ছু নেই।” কিন্তু মিনিট পাঁচেক পর, সে ফিরে আসে আতঙ্কিত অবস্থায়। তার মুখ সাদা, গলা শুকিয়ে গেছে।
শুভমের কণ্ঠের সেই অস্পষ্ট কম্পন যেন পুরো হলঘর জুড়ে গিয়ে বসল। তার চোখে ভয়ের ছাপ, ঘামে ভেজা মুখটা সাদা পড়ে গেছে। কেউই তখন আর ঠাট্টা করার মুডে নেই।
সোনা চাপা গলায় বলল, “তুই ঠিক কি দেখলি?”
শুভম গলা শুকিয়ে উত্তর দিল, “বললাম না… জানালার ধারে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সাদা শাড়ি পরা, মুখটা… মুখটা দেখার সাহস পাইনি। শুধু চোখ দুটো… যেন শূন্যের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।”
রিমা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল, “এইসব বাজে কথা বলবি না! তোর চোখে ভুল দেখেছে।”
নীল হাসার চেষ্টা করলেও তার গলায় কেমন যেন একটা ভয় ঢুকে গেছে। “আরে দোস্ত, তুই একটু রেস্ট নে। আমাদের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। এ হোটেল পুরোটাই ফাঁকা। পুরনো বাড়ি, কোথাও কিছু ছায়া পড়েছে হয়তো।”
ঠিক তখনই হঠাৎ করেই হলঘরের মাথার উপর থেকে এক দীর্ঘ, ভাঙা আওয়াজ ভেসে এল— ‘ঠক ঠক ঠক… ঠক ঠক ঠক…’
সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। হলঘরের বড় ঝাড়বাতিটা হালকা দুলছে। কেউ একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। রিমা কান পেতে বলল, “ওপর থেকে আওয়াজটা আসছে।”
অনি আস্তে বলল, “ওটা বোধহয় বিড়াল বা ইঁদুর হবে। পুরনো বাড়ি… এসব তো হবেই।”
“না!” শুভম কাঁপতে কাঁপতে বলল। “ওটা… ওটা বিড়াল নয়। আমি জানি!”
এরপর পুরো ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। যেন কেউ অলক্ষে সবার নিঃশ্বাস টেনে নিচ্ছে। ঠিক তখনই সেই পুরনো টিভি সেট আবার নিজে থেকেই চালু হয়ে গেল। পর্দা ভেসে উঠল ফিকে সাদা আলোর ঝলকানি নিয়ে।
স্ক্রিনে বড় বড় অক্ষরে আবার সেই লেখাটা ভেসে উঠল—
“আপনাদের স্বাগত জানাই, মৃত্যুর দিকে।”
“এটা কি রকম ফাজলামি!” ইন্দ্র চেঁচিয়ে উঠল। তার গলা কাঁপছিল।
নীল সাহস জড়ো করে টিভির সুইচ অফ করতে এগোল। কিন্তু সুইচটা কাজ করছিল না। তার হাতটা কিছুক্ষণ ধরে রেখে দিল টিভির গায়ে। সে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই টিভির ভেতর থেকে একটা গলা শোনা গেল—
“তোমরা চলে যাও… এখান থেকে চলে যাও। ও আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
গলা শুনেই সবাই জমে গেল। কণ্ঠস্বরটা যেন একটা মেয়ের, কিন্তু অসম্ভব ফাঁকা আর শীতল। শুভম আর চেঁচাতে পারছিল না। নীল হতভম্ব হয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক তখনই টিভির পর্দায় ভেসে উঠল এক পুরনো মুখ। সেটা একটা তরুণীর মুখ— চোখের গর্ত দুটো ফাঁকা, চামড়াগুলো যেন ঝুলে পড়েছে। তার ঠোঁট দুটো আস্তে আস্তে নড়ছে।
“ও আমার জন্য অপেক্ষা করছে… ও এসে গিয়েছে…”
রিমা হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “চলো এখান থেকে! আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকব না!”
সোনা আর অনি তার হাত ধরে টানল। “আরে, ঠিক আছে! এসব মজা করার জন্য কেউ কিছু করেছে!”
“কে করবে?” শুভম আতঙ্কে ফিসফিস করে বলল। “এই হোটেলে তো কেউ নেই!”
সিঁড়ির দিক থেকে আবার সেই আওয়াজ ভেসে এলো— ‘ঠক ঠক ঠক… ঠক ঠক ঠক…’
“উপর থেকে আসছে!” আকাশের গলা অস্পষ্ট শোনাল। “উপরের ঘরগুলো থেকে।”
“আমরা উপরে যাচ্ছি না। এখানেই থাকব।” নীল দৃঢ়ভাবে বলল, কিন্তু তার কণ্ঠেও কাপুনি ছিল।
হঠাৎ করেই বাতাস ভারী হয়ে এল। ঘরের ভেতরে ঠান্ডা হয়ে গেল। যেন কেউ নিঃশ্বাস নিচ্ছে সবার পাশেই। রিমা হঠাৎ পেছন ফিরে দেখল— জানালার পাশের ছায়ার ভেতর কী যেন নড়ল।
“ওখানে…” রিমা গলা কাঁপিয়ে বলল। “ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে!”
সবাই জানালার দিকে তাকাল। শূন্যতা। কিন্তু কেউই স্বস্তি পেল না। ধীরে ধীরে একটা মৃদু হাসির শব্দ ঘরের কোণ থেকে ভেসে এল। সেটা একটা মেয়ের হাসি, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে একটা অদ্ভুত আতঙ্ক ছিল।
“তোমরা চলে যাও। শেষবারের মতো বলছি…”
গলার আওয়াজটা চারদিক থেকে যেন ভেসে আসছিল। শুভম আতঙ্কে কান ঢেকে বসে পড়ল। “কে তুমি? কী চাই আমাদের কাছে?”
কেউ উত্তর দিল না। শুধু জানালার পাশ থেকে একটি সাদা ছায়া ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল। অন্ধকারের মধ্যে থেকে তার শাড়ির আঁচল দেখতে পাওয়া গেল। চুলগুলো সামনে ঝুলছে, চোখের জায়গায় শুধু গভীর অন্ধকার।
সে আস্তে আস্তে বলে উঠল—
“তোমাদের চলে যেতে বলেছি… কিন্তু তোমরা শোনোনি…”
এক মুহূর্ত পরেই চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে গেল। জানালার কাঁচ ভেঙে পড়ল। ঝাড়বাতিটা পুরো শক্তিতে দুলতে লাগল। দরজার বাইরে থেকে কেউ দরজা ধাক্কাতে লাগল।
“ঠক ঠক ঠক… ঠক ঠক ঠক…”
নীল চেঁচিয়ে উঠল, “দৌড়াও! সবাই দৌড়াও!”
এক মুহূর্তও দেরি না করে সবাই ছুটতে শুরু করল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার সময় তাদের পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। শুভম পেছন ফিরে দেখল— সেই সাদা ছায়া ধীরে ধীরে হলঘরের সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
তার ঠোঁট থেকে শেষবারের মতো একটা শব্দ ভেসে এল—
“ও এখনো এসেছে…”
রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প - মেঘদূত: রহস্য রোমাঞ্চে ভরা বাংলা গল্প “মেঘদূত”রাজা রবি বর্মার বিখ্যাত চিত্রকর্ম “মেঘদূত” রহস্যজনকভাবে চুরি! ইন্সপেক্টর সত্যজিৎ সেনের কাছে এই রহস্যের সমাধানের ভার। চুরির সাথে জড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত রং, গোপন বার্তা, এবং এক অজানা ব্যক্তি। কৌতূহল, রোমাঞ্চ, এবং অপ্রত্যাশিত মোড়ে ভরা এই গল্পেআপনাকে টেনে নিয়ে যাবে রহস্যের জগতে। শিল্প, রহস্য, এবং রোমাঞ্চের অপূর্ব মেলবন্ধন “মেঘদূত”। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৩: ফাঁদের মধ্যে বন্ধুরা
রাত গভীর হচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে গেছে। ঘরটায় শুধু নিঃস্তব্ধতা, আর তারই মধ্যে কোথাও থেকে ভেসে আসছে চাপা কান্নার শব্দ। জানালার বাইরে ঘন কালো অন্ধকার যেন গিলে ফেলতে চায় সবকিছু। শুভম, রিমা, সোনা, আকাশ আর নীল দাঁড়িয়ে আছে স্থবির হয়ে।
আকাশ ফিসফিস করে বলে উঠল, “এটা ঠিক হচ্ছে না… আমরা এখানে আটকে পড়েছি!”
শুভম কাঁপা গলায় বলল, “দেখ, জানালা-দরজা সব বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ বেরোতে পারবে না। আর এই কান্নার আওয়াজ… কোথা থেকে আসছে?”
সোনা তখন কিছুটা দূরে গিয়ে সেই পুরনো টেবিলের পাশে একটা দেয়ালে চোখ রাখল। হঠাৎই তার গা শিরশির করে উঠল। দেয়ালের গায়ে রক্ত দিয়ে লেখা—
“সত্য স্বীকার করো, নইলে মৃত্যু অবধারিত।”
“ওই দেখ!” সোনা হাত তুলে সবাইকে দেখাল। তার গলা শুকিয়ে গেছে।
রিমা চিৎকার করে উঠল, “এগুলো কি? এসব আমাদের সাথে কেন হচ্ছে?”
নীল আতঙ্ক চেপে ধরে বলল, “ওটা… ওটা আমাদের উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে। মনে হচ্ছে, এই জায়গাটা আমাদের চেনে। আমাদের গোপন সত্য জানে!”
শুভম ঘাড় নাড়ল, “আমার মনে হচ্ছে এটাই সত্যি। দেখো, এমন কিছু ঘটছে যা যুক্তির বাইরে। এটা আমাদের তাড়াচ্ছে।”
তখনই আবার সেই চেনা আওয়াজ— ঠক… ঠক… ঠক… দরজার ওপাশ থেকে কে যেন ধাক্কা মারছে। কিন্তু কেবল আওয়াজই হচ্ছে, দরজা খুলছে না। একসঙ্গে সবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল।
“আমাকে ছেড়ে দাও… আমি ক্ষমা চাইছি… প্লিজ!”
একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সেটা আকাশের গলায়। সবাই অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ বসে পড়েছে মেঝেতে, মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
রিমা চেঁচিয়ে উঠল, “আকাশ! তুই কি বলছিস?”
আকাশ কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমি… আমি একসময় বড় ভুল করেছি। একটা মিথ্যে বলেছিলাম, আর তাতে একজন মানুষের জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তার আত্মাটা এখন… এখন আমার কাছেই এসে জবাব চাইছে!”
“এটা কী পাগলের কথা বলছিস?” নীল চিৎকার করে উঠল।
ঠিক তখনই দেয়ালের পাশ থেকে একটা ছায়া বেরিয়ে এল। সেটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগল— এক মেয়ের অবয়ব। সাদা শাড়ি পরা, চুলগুলো এলোমেলো, চোখ দুটো কালো গহ্বরের মতো। সেই মুখের সামনে আকাশ ঘুম থেকে উঠে বসে পড়ল যেন।
“মিথ্যে তুমি বলেছিলে… তার শাস্তি পেতেই হবে।”
মেয়েটির গলা ভেসে এল। ভয়ঙ্কর শীতল কণ্ঠ, যার মধ্যে কোনো জীবনের চিহ্ন নেই।
“না! না! আমি ভুল করেছি! আমি ক্ষমা চাইছি!” আকাশ ফুঁপিয়ে উঠল।
শুভম বলল, “ওকে ছেড়ে দাও! ও তো ক্ষমা চাইছে!”
মেয়েটি তখন শুভমের দিকে তাকাল। তার ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল।
“আর তোমার সত্য কী? তুমিও তো নিঃপাপ নও।”
শুভম থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তার চোখে আতঙ্ক ভেসে উঠল। “আমি… আমি কী বলব?”
নীল হঠাৎ বলল, “আমরা পালাব! সবাই মিলে এই জায়গা থেকে বেরোতে হবে!”
“কিন্তু দরজাগুলো বন্ধ!” রিমা চেঁচিয়ে উঠল।
নীল মোমবাতি হাতে নিয়ে বলল, “ওকে একটুও পাত্তা দিও না! এরা আমাদের গোপন কথা জানে বলে ভয় দেখাচ্ছে। একসঙ্গে দরজা ভেঙে বেরোতে হবে।”
বন্ধুরা তাড়াহুড়ো করে দরজার দিকে এগোলো। কিন্তু সেই মেয়েটির ছায়া হঠাৎ করেই দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। বাতাস ভারী হয়ে গেল।
মেয়েটি বলল, “এ জায়গা থেকে কেউ বেরোতে পারবে না। তোমরা এখানে আমার জন্যই এসেছো। তোমাদের সত্য আমি জানি। আর কেউ এ সত্য এড়াতে পারবে না।”
সোনা সাহস করে মেয়েটির সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি কে? আমাদের কেন তাড়া করছো?”
মেয়েটির চোখে অন্ধকারের গর্ত গভীর হলো। তার কণ্ঠ যেন অনেকদূর থেকে ভেসে এলো—
“আমি ছিলাম তোমাদের মতোই একজন। ভুলের শিকার। প্রতারণার শিকার। এই হোটেলটাই আমার কবর। তোমাদের পাপ আমার কণ্ঠ দিয়েই ধরা দেবে।”
মেয়েটি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল, আর দরজার কাঁচে রক্তের দাগ দেখা গেল।
সোনা অসহায় কণ্ঠে বলল, “আমাদের সত্যগুলো… সত্যি কি বলতে হবে?”
রিমা তার হাত চেপে ধরল, “কিন্তু কীভাবে? যদি না বলি, আমরা কি মরে যাব?”
শুভম বলল, “আমার মনে হচ্ছে আমাদের সামনে দুইটাই রাস্তা— সত্য স্বীকার করা, না হলে এখানে… এখানেই আটকে যাওয়া।”
চারপাশের বাতাসে শীতলতা আরও বেড়ে গেল। মোমবাতির শিখাগুলো কাঁপছে। দেওয়ালের ঘড়ির কাঁটা আবার চলতে শুরু করেছে— ধীরে ধীরে।
রাত যত গভীর হচ্ছে, তাদের নিঃশ্বাসের শব্দই যেন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আওয়াজ হয়ে উঠছে।
ঠিক তখনই জানালার বাইরে ঝলকে উঠল এক বিদ্যুৎ চমক। সেই আলোয় বন্ধ দরজার গায়ে স্পষ্টভাবে দেখা গেল নতুন একটি লেখা—
“সত্যের মুখোমুখি হও। নয়তো এখানেই শেষ।”
সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ কিছু বলার সাহস পেল না। অন্ধকারের মধ্যে শুধু বন্ধ জানালা আর সেই পুরনো বাড়ির অলৌকিক গা-ছমছমে অস্তিত্ব যেন ফিসফিসিয়ে বলে চলল—
“তোমাদের সময় শেষ হয়ে আসছে…”
রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প - জীবন্ত মূর্তি: "জীবন্ত মূর্তি" একটি রহস্য রোমাঞ্চে ভরা বাংলা ছোট গল্প, যেখানে ইতিহাস, প্রেম এবং অতীতের সঙ্গে বর্তমানের অদ্ভুত সংযোগ তুলে ধরা হয়েছে। চমকপ্রদ ঘটনায় গল্পটি পাঠককে মুগ্ধ করবে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৪: মায়ার প্রতিশোধ
রাত যেন শেষ হবার নামই নিচ্ছে না। পুরনো হোটেলের পলেস্তারা খসে পড়া দেয়ালের ফাঁক দিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর বাতাস ঢুকছে। ঘরের অন্ধকারে ভীতসন্ত্রস্ত সোনা আর আকাশ এক কোণে বসে আছে। তাদের শরীরে আর সাহস নেই। বন্ধুরা একে একে হারিয়ে গেছে— শুভম, রিমা, ইন্দ্র। প্রতিটি মৃত্যু আরও ভয়ানক, আরও অবিশ্বাস্য।
সোনা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলল, “এখান থেকে বের হতে হলে আমাদের সত্য স্বীকার করতেই হবে। এটা না করলে আমরা কেউই বাঁচব না।”
আকাশ মুখে হাত চেপে বসে থাকল। তার চোখে লুকানো আতঙ্কের ছাপ। হঠাৎ জানালার বাইরে থেকে আবার সেই পরিচিত কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। এবার কান্নার মাঝে একটা মেয়ের কণ্ঠস্বরও স্পষ্ট শোনা গেল—
“তোমাদের জন্যই আমি মরেছি… আমার জীবন কেড়ে নিয়েছ তোমরা…”
সোনা আর আকাশের শরীরের রক্ত যেন জমে গেল। সোনা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার গলা কাঁপছে, কিন্তু চোখে একরকমের দৃঢ়তা।
“কে তুমি? কী চাও আমাদের থেকে?” সোনা চিৎকার করে বলল।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। তারপর সেই কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল— “আমি… মায়া। তোমাদের পাপের প্রতিচ্ছবি।”
এক মুহূর্তের জন্য হোটেলের বাতাস ভারী হয়ে গেল। হঠাৎ দরজার ফাঁক গলে সাদা শাড়ি পরা একটি অবয়ব ঘরে প্রবেশ করল। তার চুল এলোমেলো, চোখের গর্ত যেন গভীর অন্ধকার। সারা শরীর থেকে শীতল বাতাস বেরিয়ে আসছে।
“তোমাদের সত্য এখনো বলা হয়নি। বলো… নইলে তোমাদেরও একই পরিণতি হবে।” মায়ার কণ্ঠস্বর শীতল এবং অশরীরী।
আকাশ ভয়ে ফুঁপিয়ে উঠল, “আমরা কীভাবে জানব যে তুমি সত্যিই আমাদের জন্য এসেছ?”
মায়া এগিয়ে এসে আকাশের সামনে দাঁড়াল। তার মুখে এক অদ্ভুত হাসি। তারপর সে ফিসফিস করে বলল, “আমার মৃত্যুতে তুমিই ছিলে। সেই রাতের কথা কি মনে নেই?”
আকাশের চোখ বড় হয়ে গেল। সে যেন মুহূর্তের মধ্যে অতীতের সেই রাতে ফিরে গেল।
ফ্ল্যাশব্যাক
বৃষ্টিভেজা রাত। আকাশ গাড়ি চালাচ্ছে। মদের নেশায় চোখ ঘোলা, স্টিয়ারিংয়ে হাত কাঁপছে। হঠাৎই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মায়াকে সে দেখতে পায়। সে চিৎকার করে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু গাড়ির চাকায় পিছলে গিয়ে মায়া ছিটকে পড়ে। রাস্তায় ছড়িয়ে পড়া রক্তের মাঝে মায়ার হাতটা কেঁপে উঠছিল সাহায্যের আশায়। কিন্তু আকাশ গাড়ি থেকে নামেনি। সে ভয়ে, লজ্জায় ঘটনাস্থল ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল।
আকাশ আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “না! আমি সেটা চাইনি! আমি… আমি সাহায্য করতে পারতাম। কিন্তু ভয়ে পালিয়েছিলাম। আমার দোষ ছিল। আমি সেই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।”
মায়ার মুখের হাসি ক্রমশ অদৃশ্য হতে লাগল। হঠাৎ ঘরের বাতাস থেমে গেল। মোমবাতির শিখা নিভে গেল।
সোনা ভয়ে চিৎকার করে উঠল, “আমিও দোষী। আমি একবার প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য মিথ্যে বলেছিলাম। একজনের ক্যারিয়ার নষ্ট করেছিলাম নিজের স্বার্থের জন্য। আমি জানি, সেটা অন্যায় ছিল। আমি সত্যিই দোষী।”
ঘরটা নিস্তব্ধ। মায়া স্থির দৃষ্টিতে সোনা আর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তার শরীর থেকে শীতল বাতাস বেরিয়ে গিয়ে মিলিয়ে যেতে লাগল। তার কণ্ঠস্বর এবার শান্ত, যেন কোনো গোপন ভার নেমে গেছে।
“সত্য স্বীকার করেছো। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। তোমাদের ক্ষমা পেতে হবে নিজেদের কাছ থেকে।”
সেই মুহূর্তে জানালার বাইরে থেকে সূর্যের আলো ঢুকে পড়ল। কয়েক মুহূর্ত আগেও যেখানে অন্ধকার ছিল, এখন সেখানে সকালের সোনালি আলো এসে পড়েছে। মায়ার অবয়ব ধীরে ধীরে হালকা হতে লাগল। তার চোখের গভীর কালো গহ্বর থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
“আমি মুক্তি পেয়েছি…”
মায়া পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেল। হোটেলের বাতাসে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল। বন্ধ জানালাগুলো একে একে খুলে গেল। দরজার লক নিজে থেকেই খুলে গেল এক বিকট শব্দে।
সোনা আর আকাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে মেঝেতে বসে পড়ল। তাদের শরীর নিস্তেজ।
সকালের আলোয় তারা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। হোটেল যেন অন্যরকম মনে হচ্ছে— শান্ত, নিস্তব্ধ।
সোনা ফিসফিস করে বলল, “আমরা বেঁচে আছি… এটা শেষ হয়েছে। মায়া মুক্তি পেয়েছে।”
আকাশ বাইরে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু আমরা কি সত্যিই মুক্ত? আমরা কি নিজেদের পাপ ভুলতে পারব?”
সোনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ। সত্যিটা স্বীকার করতে সাহস লাগে। কিন্তু আমাদের এটাই করতে হয়েছিল। এবার থেকে নতুন করে শুরু করতে হবে।”
হোটেল থেকে বেরিয়ে তারা পেছনে তাকাল। পুরনো সেই বাড়িটা যেন নিঃস্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে। জানালার ভাঙা কাচের ফাঁকে যেন কিছু একটা তাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
দূরে কোথাও থেকে আবার হালকা হাওয়া বয়ে এলো। তার মধ্যে ভেসে এল মায়ার ফিসফিস কণ্ঠ—
“সত্য কখনো মরে না…”
সোনা আর আকাশ চুপচাপ হাঁটা দিল। পেছনে সেই পুরনো বাড়ির নিস্তব্ধতায় নতুন দিনের সূর্য উঠছে, কিন্তু তাদের মন এখনো সেই রাতের ভয়ের স্মৃতিতে আটকে।