প্রথম অধ্যায়: ঝড়ের রাত
ঝড়ের রাত। মেদিনীপুরের উপকূলীয় এলাকা অন্ধকারে ঢেকে গেছে। ঝোড়ো হাওয়ার শব্দ আর সমুদ্রের গর্জন একসঙ্গে যেন এক বিভীষিকাময় পরিবেশ তৈরি করেছে। দীঘার প্রাচীন দীপস্তম্ভটি সাগরের কোলে একাকী দাঁড়িয়ে, শতাব্দীর সাক্ষী হয়ে। কুয়াশায় ঢাকা সাগর যেন আজ আরো গভীর, আরো রহস্যময়। ঝড়ের তাণ্ডবে সৈকতের বালিতে ছড়িয়ে পড়েছে ভাঙা শামুক আর ছোট ছোট পাথরের টুকরো। এমন রাত যেন কেবল কল্পকাহিনিতেই শোনা যায়।
সোনা দাস, দীপস্তম্ভের রক্ষক, ষাটের কোটায় পা রাখা এক কঠোর অথচ স্নেহশীল বৃদ্ধ। পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি এই দীপস্তম্ভের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছেন। ঝড়-বৃষ্টির রাতগুলো তার কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু আজকের রাতটা অন্যরকম। সোনাদা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, দূর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ঝড়ের হাওয়ায় জানালার কাঁচ ঠকঠক শব্দ করছে। বাতাসের তোড়ে সামুদ্রিক লবণাক্ত গন্ধ তার নাক ভেদ করে। দূরে সাগরের বুকে ভেসে থাকা একটি জাহাজের ক্ষীণ আলো মাঝে মাঝে দেখা দিচ্ছে। কিন্তু জাহাজটি যেন এক স্থানে থেমে আছে। যেন কোনো শক্তি তাকে আর এগোতে দিচ্ছে না।
হঠাৎ, দীপস্তম্ভটি প্রবল হাওয়ার দোলায় কেঁপে ওঠে। সোনাদা চমকে ওঠেন। এমনটা সাধারণত হয় না। তারপরই শোনা গেল অশরীরী কান্নার এক করুণ আওয়াজ। ধাক্কা খাওয়া পাখির ডানার মতো ভাঙা সুরেলা কান্না। শব্দটি দীপস্তম্ভের ভেতর থেকেই আসছে। সোনাদা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। এত বছর ধরে এই জায়গায় আছেন, কখনো এমন শব্দ শোনেননি। কান্নার আওয়াজ ক্রমশ আরও তীব্র হচ্ছে। যেন কারো আর্তি, কারো অসহায় আহ্বান।
“কে? কে আছিস?” সোনাদা ভাঙা গলায় চিৎকার করেন। কিন্তু কোনো উত্তর আসে না। শুধু ঝড়ের শব্দ আর সেই কান্নার করুণ আওয়াজ। তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে কাকে ডাকবেন তিনি?
ঝড়ের তোড়ে হঠাৎ দীপস্তম্ভের চূড়ার আলো নিভে যায়। চারপাশে আরও গভীর অন্ধকার নেমে আসে। সোনাদা বুঝতে পারেন, আলোর ব্যবস্থা না করলে জাহাজগুলো বিপদে পড়বে। কিন্তু অন্ধকারে এই কাজ করা কি সম্ভব? তার ভেতরে সাহস জোগানোর চেষ্টা করলেন। এত বছর ধরে এই কাজ করছেন, এখন পিছিয়ে আসবেন না।
তিনি ধীরে ধীরে লণ্ঠন হাতে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলেন। সিঁড়িগুলো যেন আজ আরও দীর্ঘ। প্রতিটি ধাপ তার কাছে এক দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। ঝড়ের শব্দ, ঢেউয়ের গর্জন আর সেই কান্নার করুণ আওয়াজ একসাথে যেন তার কানে সাইরেন বাজিয়ে চলেছে।
সিঁড়ি বেয়ে আরও কয়েক ধাপ উঠতেই, হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন পেছনে একটি ঠাণ্ডা স্পর্শ। প্রথমে তিনি ভাবলেন, হয়তো বাতাসের ঠাণ্ডা হাওয়া। কিন্তু এই স্পর্শ যেন ভিন্ন। কোমল অথচ শীতল, যেন কোনো অশরীরী অস্তিত্ব তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে।
তিনি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালেন। তার সামনে দাঁড়িয়ে একটি আবছা মূর্তি। মূর্তিটি ধোঁয়ায় ঢাকা, কিন্তু স্পষ্টভাবে বোঝা যায় এটি একটি মেয়ের। তার চুল এলোমেলো, চোখ দুটো অন্ধকারে দীপ্তিময়। মেয়েটি মৃদু গলায় বলে ওঠে, “ভয় পেও না, সোনাদাদা। আমি শিউলি।”
এই প্রথমবার সোনাদার মনে হয়, তিনি বাস্তব থেকে কোনো অদ্ভুত জগতে প্রবেশ করেছেন। শিউলি নামটি তার পরিচিত, কিন্তু এই মূর্তিটি কে? তার শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়। মেয়েটির কণ্ঠস্বর কোমল হলেও, তার উপস্থিতি এক ভৌতিক শীতলতার আভাস দেয়। সোনাদা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন, তার হাতে থাকা লণ্ঠন যেন হাওয়ার ঝাপটায় প্রায় নিভে যেতে চায়।
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - ঝড়ের রাত: "ঝড়ের রাত" একটি ভৌতিক বাংলা ছোট গল্প যেখানে ভয়, রহস্য ও অতিপ্রাকৃত ঘটনায় ভরপুর এক রাতের অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে। ভুতের গল্প প্রেমীদের জন্য শিহরণ জাগানো এক উপহার। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
দ্বিতীয় অধ্যায়: শিউলির গল্প
শিউলি। নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই সোনাদার মনের অতলে এক পুরনো গল্পের পাতা খুলে যায়। সেই ১৯৪২ সালের ট্র্যাজেডি, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডব পুরো পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। সাগরের গভীর অন্ধকারে, একটি ব্রিটিশ জাহাজ জার্মান টর্পেডোর আঘাতে ডুবে গিয়েছিল দীঘার উপকূলের কাছে। সেই জাহাজে থাকা প্রায় সকল যাত্রীই সেদিন সমুদ্রের অতলে হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিল এক তরুণী—শিউলি।
শিউলি ছিল কলকাতার এক সাধারণ মেয়ে। পড়াশোনায় ভালো এবং সাহসী মনের মেয়ে হিসেবে পরিচিত। যুদ্ধের সময় তার বাবা ব্রিটিশ বাহিনীতে কাজ করতেন, সেই সূত্রেই তার পরিবার জাহাজে যাত্রা করছিল। কিন্তু সেই যাত্রা তাদের শেষ যাত্রায় পরিণত হয়। শোনা যায়, শিউলি সমুদ্রের তাণ্ডব আর জাহাজডুবি থেকে বাঁচতে সাঁতার কেটে উপকূলের দিকে পৌঁছান। দীপস্তম্ভটি তখন তার কাছে আশ্রয়ের মতো মনে হয়েছিল। শরীর ক্ষতবিক্ষত, ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া অবস্থা, কিন্তু বাঁচার আকাঙ্ক্ষা তাকে ঠেলে নিয়ে এসেছিল সেখানে।
তবে ভাগ্যের নিষ্ঠুর খেলায় শিউলির জীবন এখানে শেষ হয়ে যায়। দীপস্তম্ভের নীচে কাতর অবস্থায় পড়ে থাকা শিউলির ক্ষতবিক্ষত শরীর সেদিন আর সেরে ওঠেনি। কোনো সাহায্য বা চিকিৎসা পৌঁছানোর আগেই সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। লোকমুখে শোনা যায়, মৃত্যুর আগে শিউলি নিজের পরিবারের জন্য কেঁদেছিল। তার অশ্রুভেজা চোখ আর শেষ মুহূর্তের আর্তনাদ বাতাসে মিশে গিয়েছিল। সেদিনের সেই কান্না আজও দীপস্তম্ভের চারপাশে প্রতিধ্বনিত হয়।
সোনাদা এই গল্প বহুবার শুনেছেন। গল্পটি নিয়ে দীঘার গ্রামবাসীদের মুখে নানা কথা ঘুরে বেড়ায়। কেউ বলে, শিউলির আত্মা দীপস্তম্ভে বন্দী হয়ে গেছে। কেউ বলে, সে স্রেফ কল্পকাহিনি। সোনাদা নিজেও সবসময় এই গল্পকে অবিশ্বাসের চোখে দেখেছেন। তবে আজ, নিজের চোখে শিউলিকে দেখে, তার মন ভেঙে যায়।
শিউলির আবছা মূর্তি দীপস্তম্ভের আলো-আঁধারিতে যেন আরো বাস্তব মনে হয়। তার পোশাক সেদিনেরই মতো ভিজে, ক্ষতচিহ্নে ভরা। তার চোখ দুটি অদ্ভুত এক শূন্যতায় ভরা। সোনাদার দিকে তাকিয়ে শিউলি মৃদু গলায় বলে, “সেদিন কেউ আমাকে সাহায্য করতে আসেনি। আমার পরিবার, আমার স্বপ্ন সব কিছু সমুদ্রের অতলে হারিয়ে গেছে। আমি শুধু চাই না, আমার মতো কেউ আর মরুক। কিন্তু আমি নিজেও মুক্তি চাই, সোনাদাদা। আমার আত্মা এতদিন এখানে বন্দী হয়ে আছে। এই অভিশপ্ত দীপস্তম্ভ থেকে আমি মুক্তি পেতে চাই।”
শিউলির কথা শুনে সোনাদার গলা শুকিয়ে আসে। এত বছরের কাজের অভিজ্ঞতায় তিনি কখনো ভাবেননি যে একদিন তার এমন অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। শিউলির কণ্ঠস্বর ভারী বেদনার আর্তিতে ভরা। তার প্রতিটি শব্দ সোনাদার হৃদয়কে আঘাত করে।
“কিন্তু আমি কীভাবে তোমাকে সাহায্য করব, শিউলি?” সোনাদা অবাক গলায় প্রশ্ন করেন। তার মাথায় কোনো সমাধানের পথ আসে না। দীপস্তম্ভটি যেন এক অভিশপ্ত স্থান, যেখানে শিউলির আত্মা আবদ্ধ হয়ে আছে। তার মুক্তির জন্য কিছু করতে হবে, কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব?
শিউলি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। বাতাসে তার উপস্থিতি যেন আরও শীতল হয়ে ওঠে। সে বলে, “এই দীপস্তম্ভের ভেতরেই রয়েছে আমার মৃত্যুর স্মৃতি। এখানে এমন কিছু আছে যা আমার আত্মাকে আটকে রেখেছে। তুমি যদি এটি খুঁজে বের করতে পার, তবে আমিও মুক্তি পাব। কিন্তু সাবধান, এই দীপস্তম্ভে শুধু আমি নই। আমার মতো আরও অনেক স্মৃতি, অনেক দুঃখ এখানে বন্দী হয়ে আছে। তাদের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে হবে।”
সোনাদা শিউলির কথাগুলো শুনে বুঝতে পারেন, তার সামনে অপেক্ষা করছে এক অজানা চ্যালেঞ্জ। শুধু আলো ঠিক করার কাজ নয়, এবার তাকে লড়াই করতে হবে অতৃপ্ত আত্মার শৃঙ্খল ভাঙার জন্য। দীপস্তম্ভটি যেন তার নিজের অস্তিত্বের গভীরে একটি গোপন রহস্য লুকিয়ে রেখেছে।
ঝড়ের শব্দ আরও বেড়ে যায়। দীপস্তম্ভের কাঠামো কেঁপে ওঠে। সোনাদা মোমবাতি জ্বালিয়ে নীচের কক্ষগুলোর দিকে তাকাতে থাকেন। কিন্তু মনে হয়, প্রতিটি করিডর, প্রতিটি দেয়াল আজ তাকে আরো গভীর অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে চায়। শিউলির উপস্থিতি তার পাশে থেকে যায়, তাকে পথ দেখায়।
সোনাদা অনুভব করেন, এই রাতে কেবল ঝড় নয়, তাদের সামনে অপেক্ষা করছে এক ভয়ঙ্কর সত্যের উদ্ঘাটন।
তৃতীয় অধ্যায়: আত্মার পথপ্রদর্শন
ঝড়ের রাতে দীপস্তম্ভের আলো জ্বালানো এককথায় দুঃসাধ্য। সোনাদা একা কখনোই এই কাজটি করতে পারতেন না। কিন্তু শিউলির অদৃশ্য উপস্থিতি এবং তার শীতল স্পর্শ যেন সোনাদার হাতে শক্তি এনে দেয়। শিউলির সাহায্যে, প্রতিবার আলো জ্বালানোর কাজ শেষ করেন সোনাদা। আলো জ্বলে উঠতেই সমুদ্রের বুকে যেন ঝড়ের উত্তাল ঢেউ কিছুটা শান্ত হয়। আশ্চর্যের বিষয়, প্রতিবার আলো জ্বালানোর পর শিউলির করুণ কান্নার আওয়াজ কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায়।
সেই রাতগুলোর একটি ছিল বিশেষত ভয়ঙ্কর। ঝড়ের তাণ্ডবে দীপস্তম্ভ কেঁপে উঠছিল। বাতাসের গর্জন, ঢেউয়ের আঘাত, আর সেই অদ্ভুত শীতলতা যেন রাতটিকে আরও অদ্ভুত করে তুলেছিল। সোনাদা মোমবাতি হাতে নিয়ে নীচের কক্ষে বসে ছিলেন। শিউলির উপস্থিতি অনুভব করে তিনি সাহস সঞ্চয় করেন। কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করেন, “শিউলি, তুমি আমাকে সাহায্য করছ, কিন্তু তুমি নিজে মুক্তি পাবে কিভাবে? তুমি কী চাও?”
শিউলির কণ্ঠস্বর আসে হাওয়ার মতো মৃদু কিন্তু ভারী, “আমি শুধু শান্তি চাই, সোনাদাদা। এতদিন ধরে এখানে বন্দী আছি। আমি জানি না, কীভাবে এই শৃঙ্খল ভাঙা সম্ভব। কেউ কখনো আমার আর্তি শোনেনি। তুমি প্রথম যে আমাকে দেখতে পেরেছ।”
সোনাদার মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তিনি বলে ওঠেন, “তোমার মুক্তি আমি এনে দেব, শিউলি। যেভাবেই হোক। কিন্তু কীভাবে সম্ভব হবে? কোথায় খুঁজব তোমার শান্তি?”
শিউলি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, “এই দীপস্তম্ভেই লুকিয়ে আছে আমার যন্ত্রণার স্মৃতি। আমার মৃত্যু এখানেই হয়েছিল। আমার শরীর এখানেই পড়ে ছিল অনেক দিন। দীপস্তম্ভের দেয়ালের ভেতর আমার কিছু আছে যা আমাকে এখানে আটকে রেখেছে।”
সোনাদা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “তুমি কি বলতে চাও, এখানে তোমার স্মৃতি বা অবশেষ কিছু রয়ে গেছে? তা কীভাবে খুঁজব?”
শিউলির কণ্ঠস্বর আরও মৃদু হয়ে আসে, “তুমি যদি দীপস্তম্ভের ভেতরের গোপন কক্ষটি খুঁজে পাও, তাহলে হয়তো আমার মুক্তি সম্ভব হবে। কিন্তু সাবধান, সেই কক্ষে শুধু আমার নয়, আরও অনেক আত্মার যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে। তারা হয়তো তোমাকে বাধা দিতে চাইবে।”
সোনাদার শরীরে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। গোপন কক্ষ? দীপস্তম্ভে এতদিন কাজ করার পরেও তিনি কখনো এমন কোনো কক্ষের কথা শোনেননি। তিনি সাহস করে বলেন, “তুমি আমাকে পথ দেখাও, শিউলি। আমি তোমার শান্তি ফিরিয়ে আনব।”
শিউলি ধীরে ধীরে দীপস্তম্ভের একটি পুরনো করিডরের দিকে ইশারা করে। বাতাসে তার উপস্থিতি অনুভব করা যায়। “এই পথে যাও, সোনাদাদা। তবে মনে রেখো, যাই দেখো বা শোনো, ভয় পেও না। কারণ ভয়ই তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু।”
সোনাদা মোমবাতি হাতে নিয়ে করিডরের দিকে এগিয়ে যান। পুরনো দেয়াল থেকে পলেস্তারার গন্ধ বের হয়। করিডরটি খুবই অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে। হঠাৎই, এক অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পান। যেন কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। “সোনাদা… সোনাদা…”
তিনি থেমে যান। গলা শুকিয়ে আসে। পেছনে তাকালে কেউ নেই। কিন্তু সেই ডাক বারবার শোনা যায়। একসময় তিনি উপলব্ধি করেন, এটা শিউলির সতর্কবার্তা। তিনি আরও এগিয়ে যান। করিডরের শেষে একটি দরজা দেখা যায়, যা এতদিন তিনি কখনো দেখেননি। দরজাটি অদ্ভুতভাবে বন্ধ।
শিউলির কণ্ঠস্বর আবার শোনা যায়, “দরজাটি খুললেই তুমি দেখতে পাবে সেই কক্ষ। কিন্তু মনে রেখো, ভেতরে যেই স্মৃতি লুকিয়ে আছে, তা তোমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করবে। সাহস হারিয়ো না।”
সোনাদা দরজার হাতল ধরে টান দেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই, শীতল বাতাসের ঝাপটা এসে তার মোমবাতি নিভিয়ে দেয়। ভেতর থেকে ভেসে আসে করুণ আর্তনাদ। একটি পুরনো আয়না আর কিছু ক্ষতবিক্ষত জিনিসপত্র পড়ে আছে। আয়নার কুয়াশামাখা পৃষ্ঠে দেখা যায় শিউলির প্রতিচ্ছবি, তার দুঃখমাখা মুখ।
সোনাদা ধীরে ধীরে ভেতরে ঢোকেন। তার মনে শুধু একটাই সংকল্প—শিউলিকে মুক্তি দেওয়া। কিন্তু কক্ষের ভেতর প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে তাকে অনুভব হয়, যেন চারপাশের অদৃশ্য শক্তি তাকে আক্রমণ করতে চাইছে।
শিউলির কথা মনে করে তিনি মন স্থির রাখেন। তার মনে হয়, শিউলির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এই রাতই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - অন্ধকারের ডাক: "অন্ধকারের ডাক" একটি রোমাঞ্চকর ভুতের গল্প। ভয়ের ছায়ায় ঘেরা এই বাংলা ছোট গল্প আপনাকে নিয়ে যাবে এক অজানা জগতের রহস্যে, যেখানে বাস্তবতা আর কল্পনার সীমানা মুছে যায়। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
চতুর্থ অধ্যায়: চূড়ান্ত বিপদ
কয়েকদিন কেটে যায়। শান্ত দিনগুলো যেন ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছিল। রাত নামতেই আকাশ অন্ধকার করে আসে। সাগরের দিক থেকে ভেসে আসা ঝোড়ো হাওয়ার তীব্রতা বাড়তে থাকে। দীপস্তম্ভের আশপাশে উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে। এ রকম রাতগুলোতে দীপস্তম্ভের আলোই নাবিকদের পথ দেখায়। কিন্তু আজ যেন ঝড়ের তাণ্ডব সবকিছু ছাপিয়ে গেছে।
সোনাদা উপরে উঠে আলো জ্বালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় দূরে সাগরের বুকে একটি জাহাজে আগুন লেগে যায়। জাহাজটি ঝড়ে দিক হারিয়েছে, আর দীপস্তম্ভের আলো না পেলে নিশ্চিতভাবেই ডুবে যাবে। সোনাদার মন ভারী হয়ে ওঠে। তিনি জানেন, দীপস্তম্ভের আলো জ্বালানো ছাড়া সেই নাবিকদের আর কোনো উপায় নেই।
তবে আজকের ঝড় যেন অস্বাভাবিক। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে তিনি কয়েকবার পড়ে যান। বাতাসের তীব্রতা তার শরীরকে ঠেলে ফেলে দিতে চায়। হঠাৎই শিউলির মৃদু কণ্ঠস্বর শুনতে পান, “তুমি পারবে, সোনাদাদা। আমি আছি তোমার সঙ্গে।”
সোনাদা কিছুক্ষণ থেমে যান। বাতাসের শব্দে তার কান ঝাঁ ঝাঁ করছে, কিন্তু শিউলির কণ্ঠ তাকে সাহস জোগায়। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, “শিউলি, তুমি আমার সঙ্গে আছ তো? এই ঝড় থামানোর কোনো উপায় নেই?”
শিউলির কণ্ঠস্বর আবার শোনা যায়, “ঝড় থামবে না, কিন্তু তুমি আলো জ্বালাতে পারলে অনেক প্রাণ বাঁচবে। আমি তোমাকে সাহায্য করব।”
সোনাদা মোমবাতি হাতে নিয়ে এগিয়ে যান। ঝড়ের তোড়ে মোমবাতির শিখা বারবার নিভে যেতে চায়, কিন্তু শিউলির অদৃশ্য হাত যেন সেই শিখাকে বাঁচিয়ে রাখে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে তিনি আলো জ্বালানোর জন্য প্রস্তুতি নেন। কিন্তু ঠিক তখনই তার চারপাশে অদ্ভুত এক পরিবর্তন ঘটে। বিদ্যুৎচমকের আলোয় তিনি দেখতে পান, ঘরের দেয়ালে ছায়ামূর্তি নড়ছে।
ছায়াগুলো স্পষ্টতই মানুষের, কিন্তু তাদের মুখ নেই। সোনাদার গলা শুকিয়ে যায়। শিউলির কণ্ঠ আবার শোনা যায়, “ওরা তোমাকে থামানোর চেষ্টা করবে, কিন্তু তুমি ভয় পেও না। ওরা আমাকে মুক্ত হতে দেবে না।”
সোনাদা মোমবাতি জ্বালিয়ে দেন, তারপর আলোর যন্ত্রটি চালু করার জন্য হাত বাড়ান। ঠিক তখনই এক তীব্র চিৎকার শোনা যায়। ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ছায়াগুলো যেন তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। শিউলির কণ্ঠ আবার শোনা যায়, “সোনাদাদা, আলোর কাজ শেষ করো। আমি আছি তোমার সঙ্গে।”
বাতাসের প্রতিরোধ উপেক্ষা করে সোনাদা আলো জ্বালানোর কাজ চালিয়ে যান। অবশেষে দীপস্তম্ভের আলো জ্বলে ওঠে। সেই মুহূর্তে একটি বিশাল বিদ্যুৎচমক আকাশকে আলোকিত করে তোলে। আলোয় তিনি দেখতে পান, শিউলির মূর্তি তার সামনে দাঁড়িয়ে। তবে এবার তার চেহারা আগের মতো করুণ নয়, বরং শান্ত।
শিউলি ধীরে ধীরে বলেন, “তুমি আজ আমাকে মুক্তি দিলে, সোনাদাদা। এই আলো শুধু নাবিকদের পথ দেখাল না, আমাকেও মুক্তি দিল। তোমার সাহস আর সহানুভূতির জন্য আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব।”
সোনাদা তার দিকে এগিয়ে যান, কিন্তু শিউলির মূর্তি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যেতে থাকে। তিনি বলেন, “শিউলি, তুমি কি সত্যিই শান্তি পেয়েছ?”
শিউলির কণ্ঠ শেষবারের মতো শোনা যায়, “হ্যাঁ, সোনাদাদা। এবার আমি মুক্ত। আর কেউ যেন আমার মতো এখানে আটকে না থাকে।”
এরপর শিউলি সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যায়। সোনাদা কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন, বিদ্যুৎচমকের আলোয় তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। তার মনে হয়, তিনি শুধু একটি আত্মাকে মুক্তি দেননি, নিজের মধ্যেও একটি পরিবর্তন এনেছেন। দীপস্তম্ভে কাজ করতে আসার পর থেকে যা কিছু তার জন্য অদ্ভুত ছিল, আজ তা এক গভীর অর্থ পেয়ে গেল।
সোনাদা জানতেন, শিউলি হয়তো আর কখনো তার সঙ্গে কথা বলবে না, কিন্তু তার স্মৃতির মধ্যে শিউলি চিরকাল বেঁচে থাকবে। দীপস্তম্ভের আলো জ্বলতে থাকবে, যেমন জ্বলবে মানুষের সহানুভূতি এবং সাহসের আলো।
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - গ্র্যান্ড হোটেলের রাত্রি: এক ভয়ঙ্কর রাত্রি, ৭ জন বন্ধু পরিত্যক্ত গ্র্যান্ড হোটেলে আটকা পড়ে। রহস্য, ভয়, মৃত্যু – সব মিলিয়ে এক রোমাঞ্চকর বাংলা ভুতের গল্প। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
পঞ্চম অধ্যায়: আলোর পথ
ঝড় থেমে যায়। দীপস্তম্ভের আলো জ্বলে উঠেছে, আর দূরে সাগরের বুকে সেই জাহাজটি ধীরে ধীরে নিরাপদে সরে যাচ্ছে। সোনাদার চোখে ক্লান্তি, কিন্তু তার মনে এক গভীর তৃপ্তি। তিনি জানতেন, আজকের এই রাত শুধু নাবিকদের জীবনই রক্ষা করেনি, বরং শিউলির আত্মাকেও মুক্তি দিয়েছে।
তবে রাতটি যেন এক অদ্ভুত রূপ নিচ্ছিল। দীপস্তম্ভের ভেতর অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে আসে। ঝড় থেমে যাওয়ার পরও বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ যেন কানে বেজে চলছিল। সোনাদা নিচে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময়, তার দৃষ্টি পড়ে ঘরের এক কোণে। সেখানে একটি পুরনো শঙ্খ রাখা। শঙ্খটি অদ্ভুতভাবে আলোকিত হয়ে উঠছে।
সোনাদা ধীরে ধীরে শঙ্খটির দিকে এগিয়ে যান। তার মনে এক অদ্ভুত টান অনুভূত হয়। শঙ্খটি হাতে তুলে নিতে গেলে হঠাৎই চারপাশে এক শীতল হাওয়া বয়ে যায়। তার মনে হতে থাকে, কেউ যেন তাকে ডাকছে। শিউলির কণ্ঠস্বর শুনতে পান—“ধন্যবাদ, সোনাদাদা। কিন্তু আমার শেষ ইচ্ছাটি এখনও অপূর্ণ।”
সোনাদা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “কী ইচ্ছা, শিউলি? কী করলে তুমি সম্পূর্ণ মুক্তি পাবে?”
শিউলির কণ্ঠ আরও মৃদু হয়ে আসে, “আমার শরীর সাগরে পড়ে আছে। সেটিকে যেন সাগর কেড়ে নিতে না পারে। আমাকে ভূমিতে শান্তি দিতে হবে।”
সোনাদা বুঝতে পারেন, শিউলির আত্মার শান্তি তখনই আসবে, যখন তার শরীরকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি জানেন না, কোথায় খুঁজবেন সেই দেহ। শিউলি তাকে শুধু একটি ইঙ্গিত দেয়—“সাগরের বুকের দিকে তাকাও, সোনাদাদা। আলো তোমাকে পথ দেখাবে।”
পরের সকালে, সূর্য উঠলেও সোনাদার দেখা মেলে না। স্থানীয়রা দীপস্তম্ভে খুঁজে দেখলেও তার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না। তবে দীপস্তম্ভের ঠিক পাদদেশে পড়ে থাকে একটি শঙ্খ। শঙ্খটি অদ্ভুতভাবে চকচক করছে, যেন রাতের সমস্ত রহস্য তা নিজের মধ্যে ধারণ করে রেখেছে।
এদিকে, দীঘার মৎস্যজীবীরা সাগরে মাছ ধরতে গেলে একটি মর্মান্তিক দৃশ্য দেখতে পান। জলের ওপর ভেসে রয়েছে এক তরুণীর মৃতদেহ। মৃতদেহটির মুখে এক অপার্থিব শান্তি। তার শরীরের ক্ষতগুলো সময়ের চিহ্ন বহন করলেও, তার চোখ বুজে ছিল যেন এক চিরশান্তির মধ্যে।
স্থানীয়রা সেই দেহটিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। তাদের মনে হয়, বহু বছরের ঝড় আর কান্নার যন্ত্রণা যেন এক মুহূর্তে শেষ হয়ে গেছে। শিউলির দেহকে ভূমিতে সমাধিস্থ করা হয়, দীপস্তম্ভের কাছেই। সেই জায়গাটি স্থানীয়দের কাছে পরিণত হয় এক পবিত্র মন্দিরের মতো, যেখানে সবাই সাগরের তাণ্ডব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করতে আসে।
আজও দীঘার বাতাসে ঝড়ের রাতে শোনা যায় শঙ্খধ্বনি। অনেকেই বলে, সেই শঙ্খধ্বনি আসলে শিউলির আত্মার সতর্কবার্তা। যেন সে সকলকে বলে চলেছে—“আলোই পথ দেখাবে। আঁধারে থেকো না।”
স্থানীয়রা বিশ্বাস করে, শিউলি আজ আর কোনো কষ্টে নেই। তার আত্মা দীপস্তম্ভের আলো হয়ে দীঘার সাগরের ওপর জ্বলজ্বল করছে। আর সোনাদা? তিনি যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেও, তার সাহসিকতার গল্প চিরকাল মানুষের মুখে মুখে বেঁচে থাকবে। দীপস্তম্ভের আলো যেমন রাতের আঁধার ভেদ করে পথ দেখায়, তেমনি সোনাদা আর শিউলির কাহিনি সাহস আর মানবতার মশাল হয়ে দীঘার মানুষদের মনে স্থান করে নিয়েছে।
শিউলির মুক্তি আর সোনাদার আত্মত্যাগের এই গল্প যেন চিরকাল মনে করিয়ে দেয়, আলো সবসময়ই অন্ধকারকে জয় করে।