অন্ধকারে ডুবে যাওয়া দীঘা, ঝড়ের থাবা, আর রহস্যময় কান্নার শব্দ!এই ভুতের গল্পে আপনি পাবেন ঝড়ের রাতে দীপস্তম্ভের রহস্য, শিউলির অপার্থিব কান্না, আর সোনামণির সাহসী অভিযান।

বাংলা ছোট গল্প

Home » বাংলা ছোট গল্প » মেঘে ঢাকা দীঘা

মেঘে ঢাকা দীঘা

অন্ধকারে ডুবে যাওয়া দীঘা, ঝড়ের থাবা, আর রহস্যময় কান্নার শব্দ!এই ভুতের গল্পে আপনি পাবেন ঝড়ের রাতে দীপস্তম্ভের রহস্য, শিউলির অপার্থিব কান্না, আর সোনামণির সাহসী অভিযান।

অঝর গর্জন। ঝড়ের থাবা লেগেছে মেদিনীপুরের উপকূলে। দীঘা সমুদ্র মোহনায় নিঃসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে সোনামণি দাস, দীঘার ঐতিহাসিক দীপস্তম্ভের একমাত্র রক্ষী। ষাট বছরের এই বৃদ্ধ, ঝড়ের তোড়ের মাঝেও অবিচল, চোখ রেখেছেন কয়েক মাইল দূরে ভাসমান জাহাজের দিকে। হঠাৎ, দীপস্তম্ভের (লাইটহাউস) ভিতর থেকে এক অশরীরী কান্নার শব্দ ভেসে আসে। সোনামণি চমকে উঠে পড়েন। এই দীপস্তম্ভে তিনি একা। এই কান্না কোথা থেকে?

চল্লিশ বছর ধরে এই ঐতিহাসিক স্থাপনার রক্ষক সোনামণি। কখনো এমন শোনা যায়নি। সে মনে করতে থাকে, লাইটহাউস-এর নির্মাণের কিছুদিন পরেই প্রথম এই গল্প শোনা যায়। ১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাহাকার চলছে চারিদিকে। ঠিক সেই সময়, দীঘার কাছে এক জাহাজ ডুবে যায়। জাহাজে থাকা কয়েকশো মানুষের মধ্যে একমাত্র বেঁচে যায় শিউলি নামের একটি তরুণী। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার পিছু ছাড়ে না। সেই দুর্ঘটনার পর থেকেই শিউলির কান্নার আওয়াজ শোনা যায় লাইটহাউস -এর ভিতর।

সোনামণি জানত, অনেকেই একে গল্প বলে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু আজ, ঝড়ের রাতে, এই নিঃসঙ্গ পরিবেশে শোনা কান্না তাকে শিউরে উঠিয়ে দেয়। সে ঢোঁক গিলে সামলাতে চেষ্টা করে নিজেকে। হঠাৎ, লাইটহাউস -এর চূড়ায় লাগানো আলো নিভে যায়। চারপাশে অসম্ভব অন্ধকার। ঝড়ের গর্জন আর ঢেউয়েদের আছড়ন ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সোনামণি বুঝতে পারে, জরুরী মেরামতির কিট নিয়ে আসা লোকেরা ঝড়ের কারণে আটকে পড়েছে। তাকেই একা হাতে সমস্যাটা মেটাতে হবে।

কিন্তু কিভাবে? অন্ধকারে তো কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ, সোনামণির হাত ধরে ফেলে কেউ একজন। ঠাণ্ডা, কোমল স্পর্শ। সোনামণি চিৎকার করতে যাবে, ঠিক সেই সময় এক মৃদু গলার আওয়াজ ভেসে আসে, “ভয় পেও না, সোনামণিদা। আমি শিউলি।”

শিউলি! সেই মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণী! সোনামণি স্তম্ভিত হয়ে যায়। কিন্তু শিউলি তাকে সময় দেয় না। সে সোনামণিকে আলো জ্বালানোর জায়গায় নিয়ে যায়। অদৃশ্য হাতে সাহায্য করে মেরামতির কাজে। ঝড় কমতে থাকতেই আলো জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে শিউলির স্পর্শ মিলিয়ে যায়। সোনামণি চারপাশে তাকায়, কিন্তু সেখানে কেউ নেই। শুধু নিথর, ফাঁকা ঘর। কিন্তু সে মনে মনে জানে, শিউলি এখানেই আছে, এই লাইটহাউস -এর অন্ধকার কোণে।

ঝড়ের পরের সকালে জরুরী মেরামতির কাজে আসা লোকেরা অবাক হয়ে যায়। সোনামণি একাই কিভাবে ঝড়ের মধ্যে আলো ঠিক করে ফেলল, সেটা তারা বুঝতে পারে না। কিন্তু সোনামণি চুপ থাকে। শিউলির কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, সেটা সে ভালো করে জানতো।

এরপর থেকে, শিউলির সঙ্গ আরও ঘন হতে থাকে। রাতের অন্ধকারে, ঝড়ের গর্জনের মধ্যে, শিউলি সোনামণিকে সাহায্য করেন দীপ জ্বালানোর কাজে। কখনো কখনো দীঘার মুখোমুখি বাতাসে শিউলির কান্নার স্বর ভেসে আসে, যেন দুঃখের এক অসীম সাগর বয়ে আনে।

এক রাতে, সোনামণি সাহস করে শিউলির কাছে জানতে চায়, তিনি কেন এতটা কষ্ট করছেন। শিউলির মৃদু গলার আওয়াজ আসে, “আমি চাই না, কোনো জাহাজ বা নৌকা আর ডুবে যাক। সেই দুর্ঘটনার পর থেকে, আমার আত্মা আটকে আছে এই লাইটহাউস -এ। আমিই পারি জাহাজগুলোকে সাবধান করতে। কিন্তু এই আলোর মাধ্যমে, হয়তো…”

শিউলির কথা শেষ হবার আগেই সোনামণি বুঝতে পারে। শিউলির আত্মা লাইটহাউস -এর সঙ্গে যুক্ত। সে এই আলো জ্বালিয়ে জাহাজগুলোকে সাবধান করছে, যাতে তার মতো আর কারো জীবন নষ্ট না হয়। কিন্তু কেন কান্না?

“আমি স্বাধীনতা চাই, সোনামণিদা,” শিউলির গলা কাতর, “আমি চাই এই দীপস্তম্ভের বন্ধন থেকে মুক্তি। কিন্তু কেউ জানে না, কিভাবে।”

সোনামণি মর্মাহত হয়। শিউলির দুঃখ তার বুকে আঘাত করে। তিনি শিউলির আত্মাকে শান্তির পথ দেখাতে পারবে না জেনে মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু ঠিক কি করবে, তা বুঝতে পারে না।

এরকমই কয়েকটা দিন কাটে। শিউলির সঙ্গ আরও বাড়ে। কিন্তু এক নিদ্রাহীণ রাতে, হঠাৎ ঝড়ের থাবা আবার নামে দীঘার উপকূলে। ঠিক সেই সময়, জাহাজের ইঞ্জিনের ঘরে আগুন লেগে যায়। জাহাজের ক্যাপ্টেন দিশাহারা, বুঝতে পারছেন না কি করবেন।

এদিকে, দীপস্তম্ভের উপরে দাঁড়িয়ে সোনামণি সব দেখছে। সে জানে, শিউলির সাহায্য ছাড়া আলো জ্বালানো সম্ভব নয়। কিন্তু শিউলি কোথায়? চারপাশে খুঁজেও শিউলির কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। ঝড়ের তোড়ে চিৎকারও করা যাচ্ছে না। হঠাৎ, সোনামণির মনে পড়ে শিউলির কথা – “আমি চাই স্বাধীনতা…”

এই কথাই কি শিউলির মুক্তির সুযোগ? ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবারও চিন্তা করার সময় ছিল না সোনামণির। সে জানতো, দীপ জ্বালানো না গেলে জাহাজটি নিশ্চিত ডুবে যাবে। নিজের জীবন বাজি রেখে সোনামণি ঝড়ের মধ্যে দীপস্তম্ভের চূড়ায় ঝুলতে থাকা লণ্ডভণ্ড ঝুলিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

কষাকষি লেগে যায় ঝড়ের সঙ্গে। সোনামণি প্রাণপণ চেষ্টায় ঝুলিতে ঝুলন্ত আলো জ্বালানোর কাজ সারে। ঠিক সেই সময়, একটা বিদ্যুৎচমকের আলোয় সোনামণি দেখতে পান দীপস্তম্ভের দেওয়াল জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিউলির আত্মাকে। কিন্তু আজ আর সেই শোকার্ত চেহারা নেই। মুখে এক অপার্থিব শান্তি, চোখে কৃতজ্ঞতা।

আলো জ্বালানোর পর ঝড়ের তীব্রতা কমতে থাকে। জাহাজের ক্যাপ্টেন দূর থেকে দেখতে পান দীপস্তম্ভের আলো জ্বলে উঠেছে। তিনি জাহাজ ঘুরিয়ে নিরাপদ জলে নিয়ে যান।

সকালে সূর্য উঠলে ঝড়ের কোনো চিহ্ন থাকে না। কিন্তু দীপস্তম্ভের চূড়ায় আর সোনামণিকে দেখা যায় না। জরুরী মেরামতির লোকেরা খুঁজে পান শুধু দীপ জ্বালানোর জায়গায় জ্বলজ্বল করা একটি শঙ্খ। কিছুদিন পর, দীঘার মৎস্যজীবীরা সমুদ্রের বুকে ভাসতে দেখেন এক তরুণীর মৃতদেহ। মুখে এক অপার্থিব শান্তি, হাতে একটি সাদা শঙ্খ। কেউ জানতে পারে না, সেই মৃতদেহ শিউলির নাকি।

কিন্তু এখনও, ঝড়ের রাতে দীঘার মুখোমুখি বাতাসে শোনা যায় মৃদু সুরে এক শঙ্খের ধ্বনি। যেন সাগরের কোল থেকে শিউলি নৌকাগুলিকে সাবধান করিয়ে দিচ্ছে – “আঁধারে থেকো না, আলোর পথ ধরে চলো।”

এই রকম চিত্তাকর্ষক বাংলা ছোট গল্প -এর আপডেট পেতে আমাদের WhatsApp চ্যানেল জয়েন করুন।

About The Author

নতুন বাংলা ছোট গল্প

অমীমাংসিত রহস্য

অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে এক অনন্য বাংলা ছোট গল্প, যেখানে অতীতের গোপন সত্য উন্মোচনে শ্রেয়ার যাত্রা রহস্য ও রোমাঞ্চে ভরা। রহস্য রোমাঞ্চ প্রেমীদের জন্য আদর্শ পাঠ।

অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে এক অনন্য বাংলা ছোট গল্প, যেখানে অতীতের গোপন সত্য উন্মোচনে শ্রেয়ার যাত্রা রহস্য ও রোমাঞ্চে ভরা। রহস্য রোমাঞ্চ প্রেমীদের জন্য আদর্শ পাঠ।

সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়ুন: অমীমাংসিত রহস্য

অনুভূতির ঢেউ

"অনুভূতির ঢেউ" একটি হৃদয়স্পর্শী রোমান্টিক বাংলা ছোট গল্প, যেখানে নন্দিনী ও জয়ন্তের স্বপ্ন, সম্পর্ক এবং দূরত্বের মধ্যে গড়ে ওঠা ভালোবাসা সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায় তাদের জীবন।

"অনুভূতির ঢেউ" একটি হৃদয়স্পর্শী রোমান্টিক বাংলা ছোট গল্প, যেখানে নন্দিনী ও জয়ন্তের স্বপ্ন, সম্পর্ক এবং দূরত্বের মধ্যে গড়ে ওঠা ভালোবাসা সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায় তাদের জীবন।

সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়ুন: অনুভূতির ঢেউ

জীবনপথের সন্ধানে

মোটিভেশনাল বাংলা ছোট গল্প: সঞ্জয়ের আত্ম-উদ্বোধন এবং নতুন জীবন শুরু করার যাত্রা। অনুপ্রেরণা এবং বিশ্বাসের মাধ্যমে জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একটি সাফল্যমণ্ডিত গল্প।

মোটিভেশনাল বাংলা ছোট গল্প: সঞ্জয়ের আত্ম-উদ্বোধন এবং নতুন জীবন শুরু করার যাত্রা। অনুপ্রেরণা এবং বিশ্বাসের মাধ্যমে জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একটি সাফল্যমণ্ডিত গল্প।

সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়ুন: জীবনপথের সন্ধানে

Leave a Comment

অনুলিপি নিষিদ্ধ!