কলকাতার বুকে, ঠাকুরবাড়ি আর তার পাশের সংকীর্ণ গলির মাঝে, গল্পটা শুরু হয় আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে। সেই সময়টা ছিল বাংলার নবজাগরণের সূচনা।
আমাদের গল্পের নায়ক, রঘু, ছিলেন একজন মৃদুস্বভাবের পুঁথিপত্র-পাগল ছেলে। তার বাবার মতো ধনী ব্যবসায়ী না হয়ে রঘু ইচ্ছে করতেন লেখালেখির জগতে নিজের নাম কুঁড়ে কুঁড়ে করে তোলা।
রঘুর প্রতিবেশী ছিলেন অমৃতা। অমৃতা ছিলেন ঐতিহ্যবাহী ঘরের মেয়ে, কিন্তু তার মনের মাঝে ছিল অসাধারণ জ্ঞানের লাগন। ছেলেবেলা থেকেই রঘু আর অমৃতা দু’জনে মিলে কাশীনাথ সীতারামের মতো লেখকদের রচনা আলোচনা করতেন। তাদের আড্ডা ছিল ঠাকুরবাড়ির পাশেই বটগাছের তলায়।
এক গরম দুপুরে, বটগাছের তলায় বসে রঘু অমৃতাকে দেখালেন তার নতুন লেখা। সেটা ছিল সমাজের বৈষম্য নিয়ে লেখা এক গল্প। রঘু লিখেছিলেন কিভাবে উঁচু জাতের লোকেরা নিচু জাতের মানুষের উপর অত্যাচার চালায়। গল্পটি শেষ করে রঘু অমৃতার মুখের দিকে তাকালেন। অমৃতা চুপ করে ছিলেন। তারপর সে গম্ভীর গলায় বললেন, “রঘু, লেখাটা সুন্দর, কিন্তু একটা জিনিস কম আছে।”
“কী?” জিজ্ঞাসা করলেন রঘু।
“সমস্যা দেখানোর পাশাপাশি, সমাধানের কথাটাও লিখতে হবে। আমাদের সমাজকে বদলাতে হবে, কিন্তু কিভাবে, সেটাও আমাদের লেখায় থাকা দরকার।”
অমৃতার কথা শুনে রঘু চিন্তায় পড়ে গেলেন। সেদিন রাতে ঘুম আসেনি তার। ভোরে উঠে কাগজ-কলম নিয়ে বসলেন রঘু। এবার লিখলেন ঐ একই গল্প, কিন্তু এবার গল্পের শেষে দুই গ্রামের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালানোর কথা লিখলেন। শিক্ষাই যে একমাত্র উপায় সমাজের এই বৈষম্য দূর করার।
কয়েকদিন পরে রঘু আর অমৃতা মিলে তাদের লেখা নিয়ে গেলেন তৎকালীন বিখ্যাত পত্রিকা “সংবাদ প্রভাকরে”। সম্পাদক মহাশয় লেখা পড়ে মুগ্ধ হলেন। রঘুর লেখায় সমস্যা চিত্রিত হয়েছিল, আর অমৃতার লেখায় ছিল সমাধানের পথ। দুই লেখা একত্রে ছাপানো হলো পত্রিকায়।
পত্রিকায় লেখা ছাপানোর পর রঘু আর অমৃতার জীবন একেবারে বদলে গেল। তাদের লেখা নিয়ে আলোচনা শুরু হলো সারা কলকাতা জুড়ে। তারা আরও বেশি লেখালেখি শুরু করলেন। কিন্তু সবকিছু যে ঠিকঠাক চলবে, তা নয়। রঘুর লেখা যত জনপ্রিয় হতে লাগল, ততই বাড়তে লাগল বিরোধিতা। রক্ষণশীল সমাজের চোখে রঘু আর অমৃতা হয়ে উঠলেন বিদ্রোহী। রঘুর বাবা ছেলের লেখা পড়ে অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি চাইছিলেন ছেলে ব্যবসায়ে মন দেবে। অমৃতার পরিবারও মেয়ের লেখালেখি নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল। সমাজের ছেলেদের সঙ্গে মিশে লেখালেখি করা, তাদের মতে, একটা মেয়ের পক্ষে শোভা পায় না।
এসব বাঁধা সামলাতে রঘু আর অমৃতা দুজন হয়ে দাঁড়ালেন আরও দৃঢ়ভাবে। রঘু লিখলেন নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, আর অমৃতা লিখলেন সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তাদের লেখা জাগিয়ে দিল মানুষের মনের মধ্যে এক প্রশ্নের ঝড়। কেন সমাজে এতো বৈষম্য? কেন নারীরা পড়াশোনা করতে পারবে না?
একদিন রাতে, রঘুর বাড়িতে হামলা হলো। কয়েকজন গুন্ডা ঢুকে রঘুর লেখা সব নষ্ট করে দিল। রঘুকেও মারধর করলো। এই ঘটনা কলকাতা জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করলো। রঘুর লেখার সমর্থনে বিক্ষোভ মিছিল বের হলো। অমৃতার পরিবারও আর নিরব থাকতে পারলো না। তারা বুঝতে পারলো রঘু আর অমৃতা ঠিকই করছে।
এই ঘটনার পর আরও বেশি জনপ্রিয় হলেন রঘু আর অমৃতা। তাদের লেখা ছাপানোর জন্য নতুন নতুন পত্রিকা এগিয়ে এলো। রঘু আর অমৃতা ছেলেমেয়েদের জন্য বিশেষ স্কুল খুললেন, যেখানে ছেলেমেয়ে দু’জনেই শিক্ষা লাভ করতে পারবে।
বছরের পর বছর, রঘু আর অমৃতা লিখে চললেন। তাদের লেখা ছিল সমাজের দর্পণ। তাদের লেখার মাধ্যমে মানুষ জানতে পারলো নতুন জ্ঞান, নতুন চিন্তাধারা। রঘু আর অমৃতা হয়ে উঠলেন বাংলার নবজাগরণের দুই গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি।
কিন্তু ইতিহাস কখনো সোজা পথ চলে না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে রঘুর শরীর ক্ষীণ হতে লাগলো। লেখালেখিতে আগের মতো জোর আর থাকলো না। অমৃতা সারাক্ষণ তার পাশে থাকতেন, তাকে সাহায্য করতেন। এমনকি, রঘুর লেখার ধারা বজায় রাখতে নিজেও লিখতে শুরু করলেন। রঘুর লেখাগুলোকে গুছিয়ে বই আকারে প্রকাশ করার কাজও অমৃতার কাঁধেই এসে পড়লো।
এক অশ্বিনী পূর্ণিমার রাতে, রঘু চিরবিদায় নিলেন। তাঁর মৃত্যু কলকাতা জুড়ে শোকের ঢেউ আনলো। কিন্তু রঘুর শেষ কথা ছিল, “আমার লেখা থাকবে, আমার চিন্তাধারা থাকবে।”
রঘু চলে গেলেও অমৃতা থামলেন না। তিনি আরও বেশি লেখালেখি শুরু করলেন। সামাজিক কুসংস্কার, নারীর অধিকার, শিক্ষার গুরুত্ব – এই সব বিষয় নিয়ে তিনি ঝড়ের মতো লিখে চললেন। তাঁর লেখায় ছিল রঘুর চিন্তাধারার ছাপ, কিন্তু এবার সেই সাথে যুক্ত হলো নিজের অভিজ্ঞতা আর দৃঢ়তা।
কয়েক বছর পরে, অমৃতা এক অসাধারণ কাজ করলেন। তিনি রঘুর সাথে লেখা সবকয়টা লেখা একত্রিত করে একটি বই প্রকাশ করলেন। বইটির নাম দিলেন “দুই মনের সুর”। এই বইটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক মাইলস্টোন হয়ে রইল। এটি দেখালো কিভাবে দুইজন মানুষ, ভালোবাসা আর আদর্শের বন্ধনে বাঁধা, একসাথে সমাজ বদলে দিতে পারে।
অমৃতা বুড়ো হলেন, কিন্তু লেখালেখি ছেড়ে দিলেন না। তিনি যুব প্রজন্মকে অনুপ্রেরিত করতে লেখালেখি চালিয়ে গেলেন। তাঁর জীবন এক জ্বলন্ত দীপের মতো জ্বলে উঠলো, বাংলার নবজাগরণের আলো ছড়িয়ে।