রচনা - সুরজিৎ রায় || গল্পপাঠে - মৌমিতা সাহা || শব্দগ্রহন - বুবাই সাহা || সম্পুর্ন্য কারিগরি পরিচালনায় - মিহান'স প্রোডাকশন হাউস
অধ্যায় ১: তরঙ্গের মেয়ে
বাংলা মোটিভেশনাল ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
হাওয়াইয়ের উত্তর উপকূলের ছোট্ট শহর হানালেই যেন এক স্বপ্নপুরী। আকাশে সারাক্ষণ ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘ, নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে আসে নোনতা বাতাস, আর দূরে সমুদ্রের বুকে রোজ সকালে ভাঙে সোনালি রঙের ঢেউ। এখানেই ১৪ বছরের মায়া বেড়ে উঠেছে—সাগরের সন্তান হয়ে।
সে সকালবেলা সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠে বাবার তৈরি করা কাঠের সার্ফবোর্ড কাঁধে তুলে নেয়। সেই বোর্ডটা সাধারণ নয়—বাবা মারা যাওয়ার আগে নিজের হাতে খোদাই করে বানিয়েছিলেন, মাঝখানে খচিত ছিল একটি ছোট্ট পাখি—’মানু’। পাখিটা নাকি ভয়কে জিতে উড়ে যায় সবসময়, বাবা বলতেন।
প্রতিদিন মায়া নির্দিষ্ট জায়গায়—’তিনটি পাথর’ নামে পরিচিত একটা চিহ্নিত জায়গায় গিয়ে প্রশিক্ষণ করত। লাফ, ভারসাম্য, টার্ন—সব কিছুই একদম নিখুঁত করার চেষ্টা চলছিল। কারণ সামনে আসছিল হাওয়াই ন্যাশনাল সার্ফিং চ্যাম্পিয়নশিপ—যেখানে অংশগ্রহণের স্বপ্ন সে ছোট থেকেই দেখে আসছিল।
মায়ার দিদিমা, নালু কাহালা, ছিলেন এক সময়ের নামজাদা হুলা নৃত্যশিল্পী। তার গল্প আর ছবি ঘিরেই মায়ার শৈশব গড়া। দিদিমার মুখে বারবার শুনেছে—“কোনও নারী যদি নিজের ছায়াকেও হার মানাতে চায়, তাকে প্রথমে নিজের ভয়কে জিততে হবে।”
মায়ার চোখে ছিল সেই আগুন, সেই চেতনা। সমুদ্রের প্রতিটা ঢেউ তার কাছে যেন ছিল একেকটা প্রতিদ্বন্দ্বী, যাকে হারিয়ে তাকে পৌঁছাতে হবে তার গন্তব্যে।
কিন্তু একদিন সব পাল্টে যায়।
সেদিন ছিল এক অদ্ভুত সকাল। আকাশ ছিল মেঘলা, বাতাসে ছিল অস্বস্তিকর কিছুর আভাস। তবুও মায়া বোর্ড নিয়ে জলে নেমেছিল। শুরুতে সব স্বাভাবিকই ছিল, কিন্তু হঠাৎই একটা অস্বাভাবিক চাপ অনুভব করল সে—মাথার নিচে জলের গতি বদলে গেছে।
তারপর হঠাৎ এক ঝাঁকুনি, তারপর অসহ্য এক যন্ত্রণা—বাঁ হাতের ঠিক নিচে।
চোখ খুলে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না—শুধু লাল রঙের জল, আর সমুদ্রের তলদেশে কালো একটা ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। চারপাশ থেকে কোলাহল, কেউ চিৎকার করছে, কেউ জলে ঝাঁপাচ্ছে। অচেতন হওয়ার আগে মায়ার মনে হয়েছিল—সে হয়তো আর কখনও ঢেউয়ের ওপরে উঠবে না।
হাসপাতালের বিছানায় চোখ খুলে সে প্রথম অনুভব করল, তার বাঁ হাত নেই। বাঁদিকটা হালকা, অসংবেদী। পাশে দিদিমা বসে, চোখে জল। মায়া বোঝে, তার শরীরের সঙ্গে সঙ্গে যেন হারিয়েছে তার একটি জীবন—সার্ফিং, স্বাধীনতা, স্বপ্ন।
সেই রাতটা নিঃশব্দে কেটে যায়। ঘরের দেয়ালে টাঙানো সার্ফ প্রতিযোগিতার পোস্টারটা তার দিকে চেয়ে ছিল—ঠিক যেন উপহাস করে বলছে, “তুমি তো আর পারবে না।”
সে রাতেই প্রথমবার, মায়া অনুভব করেছিল—ভবিষ্যৎটা আর আগের মতো হবে না।
প্রেমের নতুন ঠিকানা - বাংলা রোমান্টিক ছোট গল্প: অসম্পূর্ণ ভালোবাসা, বৃষ্টি ভেজা স্মৃতি আর জীবনের নতুন মানে খোঁজার আবেগঘন রোমান্টিক বাংলা ছোট গল্প। মেঘলা ও শান্তনুর হৃদয়ের যাত্রা পাঠককে ছুঁয়ে যাবে গভীরভাবে। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ২: ভাঙা আয়না
বাংলা মোটিভেশনাল ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার দিনটা যেন এক নিঃশব্দ মৃত্যুবার্ষিকী। চারদিকের মানুষজন মায়ার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। কেউ কিছু বলে না, কিন্তু তাদের চোখে সে দেখতে পায় করুণা—একধরনের দুঃখ, যেন সে আর আগের মতো কেউ নেই। বাড়ির দরজা পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হয়, যেন সে কোনো অন্য মানুষ হয়ে ফিরছে—একটা অসম্পূর্ণ শরীর নিয়ে, অসম্পূর্ণ পরিচয় নিয়ে।
মায়া আগের মতো আর সার্ফার নয়। অন্তত সেটাই সবাই মনে করে। প্রতিবেশীরা চুপিচুপি ফিসফাস করে, “এই তো, সেই মেয়ে… একহাত কাটা গেছে। কীভাবে বাঁচবে এখন?” দোকানে গেলে দোকানদার মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছিস, মা?”—তেমন করে যে আগে বলত না।
সবকিছু বদলে গেছে।
ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমবার সে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে ভালো করে তাকায়। আগের মায়া আর নেই—চোখের নিচে কালি, চুল এলোমেলো, মুখের মধ্যে আতঙ্ক আর ক্লান্তি। তার বাঁ কাঁধ ফাঁকা, সেখানে কেবল ব্যান্ডেজের দাগ। কিন্তু সবথেকে ভয়ের ছিল চোখ—সেই চোখে ছিল এক অচেনা শূন্যতা।
একসময় যারা “সার্ফার গার্ল” বলে ডাকত, এখন তারা ফোন করেও না। স্কুলে যেতে তার ভয় লাগে। প্রথম দিন যখন সে স্কুলে ফিরে যায়, বন্ধুদের চোখে দেখা যায় ভ্রু কুঁচকে যাওয়া কৌতূহল। কেউ কেউ হাসিমুখে আসে, কিন্তু কথার মাঝেই একরকম দ্বিধা মিশে থাকে। “তুই ঠিক আছিস তো?”, “এখন কী করবি সার্ফিং ছাড়া?”—এইসব প্রশ্ন তার বুকের ভেতর খোঁচা দেয় বারবার।
টিফিনে একা বসে থাকে মায়া। সবার হাসাহাসি, গল্প, খুনসুটি এখন যেন আর তার জগৎ নয়। কেউ আর তাকে প্রতিযোগিতা নিয়ে জিজ্ঞেস করে না, কেউ আর সার্ফিং নিয়ে কথা বলে না। তার নিজেরও আর ইচ্ছে হয় না কিছু বলতে।
সন্ধ্যায় দিদিমা চুপ করে এসে পাশে বসেন। তার হাতে থাকে মায়ার প্রিয় গরম কোকোনাট চা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “জীবন হারালে নয়, থেমে গেলে হারে। চলতে হবে, মায়া। সমুদ্র তো আজও ডাকছে তোকে।”
মায়া কিছু বলে না। তার দৃষ্টিতে তখন অন্ধকার।
সার্ফবোর্ডটা আগের মতোই বারান্দার কোণে দাঁড়িয়ে থাকে—বাবার হাতের তৈরি সেই বোর্ড। এখন আর সে তাকে ছুঁয়েও দেখে না। সার্ফিং মানেই এখন তার কাছে যন্ত্রণা, মনে করিয়ে দেওয়া তার ভাঙা শরীর আর অপূর্ণতা।
রাতে ঘুম আসে না। ছাদের পাখার শব্দে ডুবে সে ভাবে—“যদি আমি কখনও সমুদ্রে না ফিরি? যদি আমি সার্ফার না হই, তবে আমি কে?” এই প্রশ্নটা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আগে তার পরিচয় ছিল তরঙ্গের মেয়ে, সমুদ্রের সৈনিক। এখন সে যেন এক টুকরো ভাঙা আয়না, যেটা নিজের ছায়াকেও চিনতে পারে না।
দিন কেটে যায়। সপ্তাহ পেরোয়। ধীরে ধীরে সে আরও চুপ হয়ে পড়ে। দিদিমা তার প্রিয় গান চালিয়ে দেন, গল্প বলেন, পুরোনো নাচের কথা শোনান। তবুও মায়া যেন কোলাহলভরা পৃথিবীর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একা এক মানুষ।
সে সার্ফিং থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে নেয়। শুধু শরীর নয়, মনে মনে সে যেন বিশ্বাস করতে শুরু করে—সে আর পারবে না, আর ফিরবে না। স্বপ্ন, আত্মবিশ্বাস, আর পরিচয়—সবকিছু যেন একসঙ্গে তাকে ছেড়ে চলে গেছে।
অধ্যায় ৩: স্মৃতির ঢেউ
বাংলা মোটিভেশনাল ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
সকালটা ছিল অন্যরকম। মায়া তখনও জানত না, দিদিমা তার জীবনের গতিপথের একটা মোড় ঘোরাতে চলেছেন। দিদিমা তার হাত ধরে বললেন, “চল, আজ তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই।”
গন্তব্য ছিল শহরের এক কোণে পড়ে থাকা পুরোনো এক ভবন—দিদিমার পুরোনো হুলা স্টুডিও। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছিল, যেন বহুদিন কেউ পা রাখেনি সেখানে। কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই বাতাসে ভেসে এল নারিকেলের তেলের গন্ধ, পুরোনো কাঠের মেঝে কাঁপল মায়ার পায়ের নিচে, আর চারপাশে ছিল দেয়ালে টাঙানো ছবি, মেডেল আর বাঁধানো পায়ের ছাপ—যেন এক নীরব সাক্ষ্য দিচ্ছে এক নারীর সংগ্রামের ইতিহাস।
মায়া কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
— “তুমি কি কখনও ভয় পেয়েছিলে?”
দিদিমা একটুখানি হাসলেন। চোখে জ্বলে উঠল এক পুরোনো অগ্নিশিখা।
— “আমি যখন প্রথম হুলা নাচ শিখতে গিয়েছিলাম, সবাই বলেছিল—এই নাচ শুধু পুরুষদের জন্য। মেয়েরা পারবে না, বা উচিত নয়। আমি ভয় পেয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু থামিনি। কারণ আমি জানতাম, যদি আমি নিজেকে মানতে না পারি, তাহলে কেউই আমাকে মানবে না।”
মায়া চুপচাপ শুনছিল। মনে মনে ভাবছিল—দিদিমা তো একদিনও হার মানেননি। সমাজ, কটাক্ষ, সীমাবদ্ধতা—সব কিছুর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি নাচ থামাননি।
স্টুডিওর এক কোণে ছিল দিদিমার প্রিয় বেতের ঝুড়ি, যার ভিতরে ছিল তার প্রথম নাচের চুড়ি। মায়া সেটা হাতে তুলে নিল। নরম কাপড়ের মাঝে একটা ছোট্ট পাথরের টুকরো, যাতে খোদাই করা ছিল এক হুলা পোজ।
হঠাৎই মায়ার চোখে জ্বলে উঠল একটা ছবি—বাবার তৈরি সেই সার্ফবোর্ড, যার মাঝখানে খচিত ছিল ‘মানু’—ওড়া পাখি। তার মনে পড়ল, হাত হারানোর পরদিন সেই বোর্ডটা সে নিজের হাতে বালির নিচে পুঁতে দিয়েছিল, যেন নিজের একটা অধ্যায়কে চিরতরে মাটি চাপা দিতে চেয়েছিল।
সে ফিরে তাকাল দিদিমার দিকে। চোখে ছিল দ্বিধা, কিন্তু ঠোঁটে ধরা পড়ল এক ক্ষীণ আগ্রহ—
— “আমি সেই বোর্ডটা আবার দেখতে চাই, দিদিমা।”
দিদিমার মুখে তখন নিঃশব্দ হাসি। তিনি কিছু বলেননি, শুধু মায়ার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, “ভয় থেকে পালিয়ে নয়, ভয়কে দেখে তবেই জেতা যায়।”
সেই রাতেই, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, মায়া ধীরে ধীরে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। চারদিক নিঃশব্দ, শুধু দূরের ঢেউয়ের গর্জন শোনা যায়।
চাঁদের আলোয় হাওয়াইয়ের সমুদ্রতট যেন রূপোর চাদরে মোড়া। সেই পুরোনো জায়গায়—’তিনটি পাথর’—যেখানে সে প্রতিদিন সার্ফ করত, সে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছায়। বালির নিচে হাত চালিয়ে খোঁজে বোর্ডটা। পাথরের নিচ থেকে উঠে আসে কাঠের খণ্ড। সেই মানু পাখির চোখ যেন আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
মায়া বোর্ডের ওপর হাত রাখে। বাঁ হাত নেই, কিন্তু ডান হাতে সে বোর্ডটাকে জড়িয়ে ধরে—হৃদয়ের গহীন থেকে উঠে আসে স্মৃতি, সাহস আর একটা হারানো পরিচয়ের ঢেউ।
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে সে প্রথমবার ভয় না পেয়ে বলে,
— “আমি আবার ফিরব।”
ডি. বি. কুপার হাইজ্যাকিং - সত্য ঘটনা: ডি.বি. কুপার: এক রহস্যময় সত্য ঘটনা। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে অমীমাংসিত এক হাইজ্যাকিংয়ের রোমাঞ্চকর গল্প। তার নিখোঁজ হওয়ার পরের কাহিনী জানুন। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৪: নতুন শরীর, নতুন ছন্দ
বাংলা মোটিভেশনাল ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
ভোরবেলা সমুদ্রতটে কেউ থাকে না। ঠিক তখনই শুরু হয় মায়ার নতুন যাত্রা। এক হাতে সার্ফিং—সেটা কখনো তার কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু এখন এই অসম্ভবকেই সম্ভব করতে হবে। দিদিমার পুরোনো কথাগুলো যেন মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে—”ভয় থেকে পেছাবে না, ভয়কে সঙ্গে নিয়ে সামনে যাবি।”
প্রথম দিনই বোর্ডে উঠতে গিয়ে পড়ে যায়। ঢেউয়ের আঘাতে মুখে লেগে যায় লবণজল, বুক ফেটে আসে হালকা কান্না। কিন্তু সে থামে না। পরদিন আবার আসে—বোর্ডের ভারসাম্য ঠিক করতে শেখে, এক হাতে কীভাবে প্যাডল করতে হয়, সেই কৌশল বারবার চেষ্টা করে।
মাসখানেক কেটে যায়। গোপনে, নীরবে সে নিজের শরীরকে নতুন করে চেনে। কাঁধের পেশি ব্যথায় কেঁপে ওঠে, আঙুল কেটে যায় বোর্ডের রাশিতে, তবুও সে দমে না। প্রতিটি পড়ে যাওয়া যেন একেকটা নতুন ওঠা শেখায়। এখন আর সে আগের মতো ভয় পায় না ঢেউ দেখে—বরং চ্যালেঞ্জ খোঁজে।
একদিন ভোরে যখন সে সৈকতের এক কোণে অনুশীলন করছিল, তখনই দেখা হয় কাই-এর সঙ্গে। পাতলা গড়ন, মাথায় টুপি, হাতে একটা খাতা। প্রথমে কাই কিছু বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে মায়ার বোর্ডে উঠে আবার পড়ে যাওয়া দেখে। কিছুক্ষণ পরে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
— “তুমি আবার শিখছো?”
মায়া এক মুহূর্ত দ্বিধা করে, তারপর মাথা নাড়ে।
— “হ্যাঁ, এক হাতে শেখাটা সহজ নয়।”
কাই হাসে, চোখে ছিল মায়া-চেনা একরকম বেদনার আলো।
— “আমি দৌড়াতে পারি না। পায়ের হাড়ে ক্যান্সার। কিন্তু আমি গল্প লিখি। হঠাৎ তোমায় দেখে মনে হলো—তোমার গল্প লিখতে ইচ্ছে করছে।”
মায়া অবাক হয়ে তাকায়। একসঙ্গে যেন দুটো অসম্পূর্ণ জীবন পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। এরপর থেকে কাই প্রায় প্রতিদিনই আসে। বসে বসে দেখে মায়ার অনুশীলন, তারপর খাতায় কিছু লেখে। মাঝে মাঝে বলে, “আজ তুমি একটু বেশিক্ষণ টিকতে পারলে বোর্ডে।” অথবা, “তোমার ভয়টা আজ একটু কম দেখালো।”
একদিন কাই বলে,
— “তুমি যদি আবার সার্ফিং করো, তাহলে আমি তোমার গল্প লিখব। একজন লড়াকু মেয়ের গল্প। আমি জানি, সেটাই আমার গল্পও হবে।”
মায়া প্রথমবার নিজেকে শক্তিশালী মনে করে। সে বুঝতে পারে, তার লড়াই শুধু নিজের জন্য নয়, কাই-এর মতো আরও অনেকের জন্য, যারা জীবনকে নতুন করে গড়তে চায়।
দিদিমা একদিন বলে ওঠেন,
— “তুই যেন আবার তোর ছন্দ ফিরে পাচ্ছিস, মা। নতুন শরীর, কিন্তু পুরোনো জেদটা আবার চোখে ফিরছে।”
মায়া আয়নায় তাকিয়ে এখন আর শুধু হারানো হাতটাই দেখে না—দেখে নিজের দৃঢ় চোখ, পেশির টান, আর কাঁধের ঘামে তৈরি নতুন ছন্দ। সে জানে, এই শরীরটা সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু তার সাহসটা আগের থেকেও বেশি পরিপূর্ণ।
অধ্যায় ৫: চ্যালেঞ্জের ঢেউ
বাংলা মোটিভেশনাল ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
সমুদ্রতটে এক সকালে ঘোষণা ঝংকার তুলল—এই বছর আবার ফিরে আসছে ‘মাকাহা লেজেন্ড কাপ’, হাওয়াইয়ের প্রাচীনতম সার্ফ প্রতিযোগিতা। এটা কেবল একখানা খেলা নয়—এটা এক ঐতিহ্য, এক শ্রদ্ধার প্রতীক। জয়ের মানে শুধুই ট্রফি নয়, গর্ব, আত্মপরিচয় আর জায়গার ইতিহাসের প্রতি এক প্রণতি।
খবরটা শুনে মায়ার বুক কাঁপে। এতদিন গোপনে অনুশীলন করে সে জানে—এটাই তার নিজের কাছে ফেরার সুযোগ। একরকম আবেগ আর অজানা ভয় নিয়ে সে তার কোচের কাছে যায়।
কোচ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলে,
— “মায়া, আমি জানি তুই সাহসী, কিন্তু এই প্রতিযোগিতা খুব কঠিন। তোর শরীর এখনও পুরোপুরি তৈরি নয়।”
মায়ার কণ্ঠ নরম কিন্তু স্থির,
— “আমার শরীর না, আমার মন লড়বে।”
কোচ নিরুত্তর। মায়া ঘুরে চলে আসে, কিন্তু জানে, এই যুদ্ধ তার একার।
তবে চ্যালেঞ্জ শুধু সমুদ্র নয়। সমুদ্রের বাইরে অপেক্ষা করে এক পুরোনো ছায়া—লেইলা, তার প্রাক্তন প্রতিদ্বন্দ্বী, এক সময়কার বন্ধু। লেইলা প্রতিযোগিতার লিস্টে মায়ার নাম দেখে ঠোঁটে টিপে হাসে।
সে বলে,
— “এক হাতে ঢেউ জিতবি? সেটা তো ঢেউয়েরই অপমান।”
চারপাশে কয়েকজন কিশোর-তরুণ হেসে ওঠে।
মায়া কোনো উত্তর দেয় না। চুপচাপ চলে যায়, কিন্তু ভেতরে আগুন জ্বলে ওঠে।
সন্ধ্যায় দিদিমা তার পাশে বসে। নীরবতার মাঝে বলে,
— “তোর শরীর যা খুইয়েছে, তোর মন তা ফিরিয়ে আনবে। জয় মানে শুধু প্রথম হওয়া নয়, ভয়কে জিতিয়ে এগিয়ে চলা।”
মায়া বলে না কিছু, শুধু দিদিমার হাতটা ধরে রাখে।
রাত গভীর হলে কাই চুপিচুপি আসে। হাতে তার সেই খাতাটা, আর কাঁধে একটা ব্যাগ। মায়ার বোর্ডটা বের করে আনে সে। তারপর ব্যাগ থেকে বের করে এক কালো মার্কার পেন।
বোর্ডের মাঝখানে লিখে দেয়, স্পষ্ট অক্ষরে—
“তুমি ভয় নও, তুমি ঝড়।”
মায়ার গলা বুজে আসে। এক ফোঁটা জল চোখের কোণ ছুঁয়ে পড়ে বোর্ডের কাঠে। সে বোর্ডটাকে নিজের বুকে টেনে নেয়, যেন শক্তি টেনে নেয় সেই শব্দ থেকে।
সেই রাতের চাঁদ ছিল শান্ত, কিন্তু মায়ার ভিতরে তৈরি হচ্ছিল এক ঘূর্ণিঝড়। সে জানত, প্রতিপক্ষ শুধু লেইলা বা ঢেউ নয়—প্রতিপক্ষ ছিল নিজেকে হারানোর ভয়, হেরে যাওয়ার শঙ্কা।
কিন্তু এবার তার পাশে আছে দিদিমার আর্শীবাদ, কাই-এর বিশ্বাস, আর নিজের ভিতরের রূপান্তর।
তাকে কেউ এখন “এক হাতে সার্ফার” বলে না। সে নিজেকে ডাকে—
“ঝড়ের মেয়ে।”
ললিপপের জন্য লড়াই - ছোটদের রূপকথার গল্প: একটি মনোমুগ্ধকর ছোটদের গল্প যেখানে পিঁপড়ে, মাছি আর মাকড়শার মধ্যে খাবার ভাগাভাগি নিয়ে রূপকথার গল্পের মতো মজার লড়াই ঘটে। মায়াবী বনের অভিযানে আনন্দ আর শিক্ষা মিশে আছে। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৬: ঢেউয়ের ঊর্ধ্বে
বাংলা মোটিভেশনাল ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
সকাল থেকেই সমুদ্র উত্তাল। আকাশে রোদের ঝিলিক থাকলেও ঢেউগুলো যেন রূঢ় আর বিশাল, ঠিক যেমন মায়ার বুকের ভিতর জমে থাকা ভয়। প্রতিযোগিতার মাঠ সাজানো—তাঁবু, জুরি বোর্ড, স্থানীয় সংবাদপত্রের ক্যামেরা, আর সারি সারি দর্শক। কিন্তু মায়ার চোখ শুধু খোঁজে সেই পুরোনো জায়গাটা—যেখান থেকে সে প্রথম সার্ফিং শিখেছিল, যেখানে একদিন সে হাঙরের সঙ্গে লড়েছিল।
কান ফাটানো ঘোষণার শব্দ ভেসে আসে—“পরবর্তী প্রতিযোগী, মায়া কেলোনি।”
ভিড় হঠাৎ নীরব হয়ে আসে। কেউ কেউ ফিসফিস করে—“ওই মেয়েটাই না? যার হাত নেই?”
আবার কেউ বিস্ময়ে বলে—“এক হাতে কীভাবে করবে?”
কিন্তু মায়ার কান সেসব শব্দে আটকে না। তার চোখে তখন শুধু সমুদ্র, আর হাতের নিচে অনুভব করে সেই কাঠের বোর্ড—বাবার হাতের ছাপ যেন আজও রয়ে গেছে।
সে জলে নামল। প্রথমেই একটা ঢেউ তার বোর্ডকে কাত করে দেয়। ঠান্ডা জলে তার শরীর কেঁপে ওঠে, ভেজা চুল চোখে পড়ে যায়। তবুও সে উঠে দাঁড়ায়। ঠোঁট কামড়ে বোর্ডে আবার উঠে বসে। মনে পড়ে, কাই-এর লেখা সেই লাইন—“তুমি ভয় নও, তুমি ঝড়।”
দ্বিতীয় ঢেউয়ের দিকে এগোয় সে। এবার এক হাতে ভারসাম্য রক্ষা করে, পায়ে বোর্ডের গ্রিপ টানে, আর শরীরটাকে সামনের দিকে ছুঁড়ে দেয় ঠিক সময়মতো। আর এবার… সে দাঁড়িয়ে যায়!
সমুদ্রের বুক চিরে যায় এক সরু রেখার মতো—মায়া আর তার বোর্ড। ঢেউয়ের ঢালে দাঁড়িয়ে তার শরীর বাঁকা, চুল উড়ছে বাতাসে, চোখে স্থিরতা। তার প্রতিটি গতিবিধি যেন কোনো শিল্প। শুধু শক্তি নয়—বিশ্বাস, মনোযোগ, আর আত্মার নীরব এক সুর।
দর্শকেরা নীরব হয়ে তাকিয়ে থাকে। কোনো চিৎকার নেই, কোনো করুণা নয়। শুধু নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখা—একটা মেয়ে, যার এক হাতে আছে সাহসের সমুদ্র।
শেষ ঢেউয়ের পর সে যখন তীরে ফিরে আসে, তখনই ঘোষণা শোনা যায়—
“মায়া কেলোনি, সেমিফাইনাল অতিক্রম করেছে!”
কিছু লোক তখন চিৎকার করে উঠল, কেউ হাততালি দেয়। লেইলা দূরে দাঁড়িয়ে, চোখে এক অদ্ভুত মিশ্র অভিব্যক্তি—অবিশ্বাস, ঈর্ষা, আর সম্মান।
কিন্তু মায়ার কাছে জয় মানে সেমিফাইনাল নয়। সে জানে, আজ সে জয় করেছে নিজের ভেতরের এক কাঁপনকে।
সে দিদিমার দিকে তাকায়। বৃদ্ধ চোখে জল, কিন্তু ঠোঁটে হাসি।
দিদিমা বলে,
— “আজ তুই শুধু ঢেউয়ের উপর দাঁড়াসনি মা, তুই নিজেকে জিতেছিস।”
মায়া হেসে। চোখে সমুদ্রের নীল আর কণ্ঠে নিশ্চিন্ত আত্মবিশ্বাস।
তার হাত নেই, কিন্তু তার ডানায় আজ ভয় নেই।
অধ্যায় ৭: অদম্য তুমি
বাংলা মোটিভেশনাল ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
সকাল গড়িয়ে বিকেল। প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত রাউন্ড শুরু হয়েছে। সমুদ্রের ঢেউ যেন আজ নিজের সেরা রূপে হাজির—গর্জন, ছুটে চলা, আর প্রতিটি তরঙ্গে একেকটি পরীক্ষা। মায়া প্রস্তুত। তার চারপাশে প্রচণ্ড চাপ, ক্যামেরা, দর্শকের উত্তেজনা—তবে তার ভিতরটা শান্ত।
সে জানে, আজ জিতলে ভালো, না জিতলেও ক্ষতি নেই। কারণ সে ইতিমধ্যেই জিতেছে—ভয়কে, হেরে যাওয়ার আশঙ্কাকে, নিজের প্রতি সন্দেহকে।
তার পারফর্মেন্স ছিল মন কাড়া। সে যেভাবে ভারসাম্য রাখে, ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে যায়, বোঝা যায়—সে ঢেউয়ের বিরুদ্ধে নয়, তার সঙ্গেই একাত্ম।
প্রতিযোগিতা শেষে ঘোষিত হয় ফলাফল—মায়া দ্বিতীয় হয়েছে। লেইলা প্রথম।
এক মুহূর্তের জন্য মায়া স্থির থাকে। তারপর চারপাশে গর্জে ওঠে করতালি। এই তালি কেবল দ্বিতীয় স্থানের জন্য নয়—এটা তার সাহসের জন্য, প্রত্যাবর্তনের জন্য, তার আত্মার অদম্যতা’র জন্য।
লেইলা মঞ্চে এসে কাছে আসে, চোখে থাকে বদলে যাওয়া এক দৃষ্টি। মায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
— “তুই শুধু সার্ফার না, তুই আমাদের প্রেরণা।”
মায়া লেইলার চোখে দেখে—সেখানে আর হিংসা নেই, আছে শ্রদ্ধা।
কোচ পাশে এসে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে বলেন,
— “তুই আমাকে ভুল প্রমাণ করেছিস, মায়া। আমি গর্বিত।”
পিছন থেকে কাই উঠে আসে। হাতে একটা ছোট কাগজ। তার লেখা গল্প। সে পড়ে—
— “মায়া, সমুদ্রের মেয়ে, যিনি ভয়কে জিতেছে। সে এক হাত হারিয়েও হৃদয় ধরে রেখেছে, সে শুধু ঢেউয়ের উপরে নয়, আমাদের সবার হৃদয়ের উপরে রাজত্ব করে।”
দিদিমা চোখ মুছে মায়ার কপালে চুমু খেয়ে বলেন,
— “তুই আমার থেকেও বড় নর্তকী হয়েছিস মা—তুই জীবনের ছন্দে নেচেছিস।”
মায়ার চোখ ভিজে যায়। কিন্তু আজ তার চোখে কান্না নেই, আছে জ্যোতি।
সে আকাশের দিকে তাকায়। মনে পড়ে বাবার কথা, তার তৈরি বোর্ডের কথা, তার স্বপ্নের কথা। সে বোঝে—শরীর একটা বাহন, কিন্তু আত্মা… আত্মা যদি অদম্য হয়, তবে কোনো ঢেউ তাকে থামাতে পারে না।
তার চোখে তখন নতুন স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি—সে কেবল সার্ফার নয়, সে এক গল্প, এক আলোকবর্তিকা।
সে হেঁটে যায় সমুদ্রের দিকে, সূর্যাস্তের রঙ তার গায়ে পড়ে। ঢেউয়ের ধ্বনি যেন বলে—“তুমি ভয় নও, তুমি ঝড়।”






