কলকাতার বাতাসে এক অশান্তির সুর ঝঙ্কার দিচ্ছিল। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা, যেন এক কালো মেঘ ছেয়ে ফেলেছিল শহরের সৌন্দর্য। রাস্তায় চলতে পারা যাচ্ছিল না, চারিদিকে শুধু চিৎকার আর অগ্নিসংযোগের আলো। কিন্তু রায় পরিবারের ক্ষীণ আলোয় ঝলমল করা ঘরে শান্তির এক টুকরো ছিল।
মহেন্দ্রনাথ, পরিবারের অভিভাবক, হাত দিয়ে টেবিলের উপর থাকা মাটির প্রদীপটি ঠিক করে দিলেন। তার চোখে এক চিন্তার ছায়া ছিল, কিন্তু তিনি স্ত্রী সাবিত্রী আর ছেলেমেয়েদের সামনে তা প্রকাশ করতে চাইলেন না। আজ রাতে খাবারের আগে তিনি আরও একটু মনোযোগ দিয়ে প্রার্থনা করলেন।
“হে ভগবান, এই অশান্তিতে আমাদের রক্ষা করো। আমাদের পরিবারকে, আমাদের প্রতিবেশীদের, আমাদের শহরকে নিরাপদ রাখো।”
সাবিত্রী মাথা নীচু করে প্রার্থনায় শামিল হলেন। তার চোখে জল ছিল, কিন্তু তিনি সাহস হারাননি। তিনি জানতেন তাঁর স্বামী ও সন্তানদের সামনে দুর্বলতা দেখানো যাবে না।
খাবার টেবিলে বসলেন সবাই। মহেন্দ্রনাথের পাশে বসলেন সাবিত্রী। বিপিন, তাদের বড় ছেলে, মায়ের পাশে বসল। গীতা, তাদের মেয়ে, বিপিনের পাশে আর ছোট্ট রতন টেবিলে বসার আগে মাকে জড়িয়ে ধরল।
রাতের খাবার ছিল সাধাসিদে, একটু ডাল, একটু শাক, আর এক টুকরো রুটি। কিন্তু পরিবারের আড্ডায় সেই সাধারণ খাবারও মধুর মনে হচ্ছিল। বিপিন কলেজের কথা বলতে লাগল, কিভাবে রাস্তায় দাঙ্গা দেখে তাকে আর বন্ধুদের বাড়ি ফিরতে কতটা কষ্ট হয়েছিল। গীতা তার স্কুলের খবর শোনাল, কিভাবে শিক্ষিকা তাদের সান্ত্বনা দিয়েছিলেন এই পরিস্থিতিতে।
রতন, সবচেয়ে ছোট্ট সদস্য, মায়ের কোলে বসে খাবার খাচ্ছিল। মাঝে মাঝে সে জিজ্ঞেস করছিল, “বাবা, এই দাঙ্গা কবে থামবে?”
মহেন্দ্রনাথ ছেলের মাথা স্পর্শ করে আশ্বাস দিলেন, “থামবে রতন, খুব তাড়াতাড়ি থামবে। শান্তি আসবে, আবার সেই আগের মতো সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কিন্তু মহেন্দ্রনাথের মনে ছিল একটা অনিশ্চয়তা। এই দাঙ্গার কারণ ছিল ধর্মীয় বিভাজন, কিন্তু তিনি জানতেন এর পেছনে আরও অনেক কিছু কাজ করছে। লোকজনকে দাঙ্গায় উসকে দেওয়া হচ্ছে, ঘৃণা আর সহিংসতা ছড়ানো হচ্ছে। এই অবস্থা আর কতদিন চলবে, তা ভাবতেই তার মন খারাপ হয়ে গেল।
সাবিত্রী তার মনের অবস্থা বুঝলেন। তিনি মহেন্দ্রনাথের হাত ধরলেন, তার চোখে সাহসের দৃষ্টি দিয়ে তাকালেন। “আমরা থামব না মহেন্দ্র, আমাদের ঐক্য দেখিয়ে দেব। আমাদের প্রতিবেশীদের সাহায্য করব, এই অশান্তির বিরুদ্ধে লড়াই করব।”
মহেন্দ্রনাথ স্ত্রীর হাত চেপে ধরলেন। সাবিত্রীর কথায় তার মনের অন্ধকার একটু কমল। তিনি জানতেন, সাবিত্রী ঠিকই বলছেন। এই সময় তাদের ঐক্যই হচ্ছে শক্তি।
খাওয়ার পর, বিপিন জানাল সে প্রতিবেশীদের বাড়ি খোঁজ নিতে যাবে।
“না বিপিন,” মহেন্দ্রনাথ বললেন, “এই অবস্থায় তুমি একা যেতে পার না। আমিও যাচ্ছি।”
বিপিন আপত্তি করতে চাইল, কিন্তু মহেন্দ্রনাথ তাকে থামিয়ে দিলেন। জানতেন ছেলেকে রাতে একা যেতে দেওয়া ঠিক হবে না।
সাবিত্রী তাদের জন্য চাদর নিয়ে এলেন। বাইরে রাস্তায় অন্ধকার আর চিৎকার ছিল, কিন্তু পরিবার দুজনে দুজনে হাঁটা শুরু করল ঐক্যের শক্তিতে, প্রতিবেশীদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
রাস্তায় কিছু লোককে দেখা গেল, কাঁধে লাঠি নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছিল। মহেন্দ্রনাথ ও বিপিন তাদের এড়িয়ে চলল। দূর থেকে ধোঁয়া ও আগুনের ঝলকানি দেখা যাচ্ছিল।
অবশেষে তারা তাদের প্রতিবেশী মিঃ সেনের বাড়ির কাছে পৌঁছল। বাড়ির দরজা বন্ধ ছিল। বিপিন জোরে জোরে ডাকতে শুরু করল, “মিঃ সেন, দরজা খুলুন।”
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর, দরজা একটু খুলল। ভিতরে থেকে মিঃ সেনের চিন্তিত মুখ দেখা গেল।
“কে?”
“আমি বিপিন, আর ইনি আমার বাবা। আমরা দেখতে এলাম আপনি ঠিক আছেন কিনা।”
মিঃ সেন দরজা একটু বেশি খুললেন। তিনি চিন্তিত ছিলেন, কিন্তু মহেন্দ্রনাথ ও বিপিনকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলেন। তিনি তাদের বাড়িতে ডেকে নিলেন।
বাড়ির ভিতরে ছিলেন মিঃ সেনের স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে। তারা সবাই ভীত ছিলেন। মহেন্দ্রনাথ ও বিপিন তাদের আশ্বাস দিলেন। মিঃ সেন জানালেন কিছুক্ষণ আগে কিছু লোক তাদের বাড়িতে এসেছিল কিন্তু প্রতিবেশীদের চিৎকার শুনে তারা পালিয়ে গিয়েছিল।
“আমরা কয়েকজন প্রতিবেশী মিলে একটা দল গড়েছি,” মহেন্দ্রনাথ বললেন, “আপনারাও কি আমাদের সাথে থাকতে চান?”
মিঃ সেন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “হ্যাঁ, অবশ্যই। এই অবস্থায় ঐক্যই আমাদের রক্ষা করতে পারবে।”
এই কথায় মহেন্দ্রনাথের মুখে একটা স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল। তিনি জানতেন এই ঐক্যই এই অশান্তির বিরুদ্ধে তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
রাত বাড়তে থাকল। দূর থেকে মাঝে মাঝে চিৎকারের শব্দ আসছিল। মহেন্দ্রনাথ, বিপিন, মিঃ সেন আর তাঁর ছেলে সবাই বাড়ির ছাদে উঠলেন, চোখ রাখলেন রাস্তায়। প্রতিবেশীদের বাড়িও তারা দেখছিলেন।
কিছুক্ষণ পর, দূরে একটা বড় দল লোককে দেখা গেল। তারা লাঠি ও অস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসছিল। মহেন্দ্রনাথ সতর্ক হয়ে গেলেন। এই দলটা তাদের এলাকায় আসবে কি না বোঝা যাচ্ছিল না।
মিঃ সেনের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা বাড়ির ভিতরে ভীত হয়ে আশ্রয় নিলেন। মহেন্দ্রনাথ, বিপিন আর মিঃ সেন একে অপরের দিকে চাইলেন। তাদের চোখে ছিল দৃঢ়তা, এই অশান্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রত্যয়।
সেদিন রাতটা কাটল অস্বস্তিতে। দলটা তাদের এলাকা দিয়েই চলে গেল, কিন্তু পরিবারগুলো জানত না কখন আবার কোনো সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবু, তারা আশা ছাড়ল না।
এই দাঙ্গার মধ্যে তারা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকল, প্রতিবেশদের সাহায্য করল, ঐক্যের শক্তিতে প্রমাণ করল যে, ঘৃণা আর সহিংসতা একদিন শেষ হবেই, শান্তি আবার ফিরে আসবে।
সূর্যের আলো ফুটতেই রাস্তায় নেমে এল মহেন্দ্রনাথ ও বিপিন। আশপাশটা এলোমেলো লাগছিল। কিছু বাড়ির জানালা ভাঙা, কিছু জায়গায় পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্র। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, আগের রাতের মতো চিৎকার আর অশান্তি ছিল না।
মিঃ সেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা করলেন তারা। সকলেই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মিঃ সেন জানালেন, রাতে তাদের এলাকা দিয়ে যাওয়া দলটা অন্য জায়গায় গিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে বলে খবর এসেছে।
দিন যত এগোল, তত খবর আসতে লাগল শহরের বিভিন্ন প্রান্তে পরিস্থিতি ক্রমশ শান্ত হচ্ছে। মহেন্দ্রনাথ ও বিপিন তাদের প্রতিবেশীদের নিয়ে আবার একটা সভা ডাকলেন। সবার মিলিত সিদ্ধান্ত হল ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করা। কেউ বাড়ি মেরামতের কাজে সাহায্য করলেন, কেউ আবার খাদ্য সংগ্রহে সাহায্য করলেন। এই দুর্যোগের মধ্যেও মানবিকতা ফুটে উঠল।
এক সপ্তাহ পর, মহেন্দ্রনাথদের বাড়িতে আবার সবাই জমায়েত হল। এবারের আড্ডায় ছিল আশার আলো। প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপ, গান, আর গল্পে ভরে উঠল রাত। রাতের বাতাসে আর কোনো অশান্তির সুর ছিল না, বরং ছিল শান্তির স্বর্গীয় সুর।
সেদিন রাতে ছাদে বসে চাঁদ আকাশের মুখ চুমছিল। কয়েকদিন আগে মেঘে ঢাকা থাকলেও, আজ সে আবার পূর্ণ ঔজ্জ্বল্যে ছাপিয়ে উঠেছিল। ঠিক যেন এই শহর, এই মানুষ, এই পরিবার – সবাই মিলে অন্ধকারকে দূর করে আবার আলোয় ফিরে এসেছে।