ঠিক বিকেলের দিকে, ছাদে টুক করে ইট ভাঙার শব্দ কানে এল। নিচে কাগজপত্র নিয়ে বসে বিরক্ত লাগলো খুব। ওপরে উঠে দেখি, আমার বাবা, সত্তর তিন বছর বয়স হয়েছে, একা একা ইট ভাঙছেন। আর আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের পোষা কবুতরগুলো।
“রোজা রেখে এত রোদে ইট ভাঙছো কেন?” জিজ্ঞেস করলাম।
বাবা একটা হাসি দিয়ে বললেন, “এমনিই। এই ইটগুলো অনেকদিন ধরে পড়ে আছে। ভাবলাম ভেঙে ফেলি।”
খানিকটা সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবাকে সারাজীবন এমনই ‘এমনিই’ কাজ করতে দেখেছি। দুটো হাতে ভারী বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আসছেন, পাঞ্জাবিটা ভিজে চুপচুপ করছে। অনেকবার বলেছি, “রিক্সা ঠিক দশ টাকা, এত কষ্ট করে হাঁটতে আসো কেন?”
বাবা মিনমিন করে বলবেন, “এমনিই। একটু হাঁটা চললো। হাঁটাহাঁটি তো আর হয় না।”
বাড়িতে একটু মেরামতের কাজে দুইজন মিস্ত্রি লাগবে, বাবা একজন ঠিক করে বাকিটা নিজেই সামলে নিলেন। মাথায় করে বালি আনা, ইট আনা। জিজ্ঞেস করলে, ধমকের সুরে বললেন, “শরীরটা ভালো থাকে জানিস! কাজ করলে।”
কিন্তু আমি জানি, আসল কথা এসব না। কথা হলো টাকা। রিক্সায় না এসে দশ টাকা বাঁচানো, একদিনের মিস্ত্রির খরচ, তিনশো টাকা বাঁচানো। সারা জীবন এভাবেই সামলে চললেন। ছোট্ট একটা সরকারি চাকরি করে, আমাদের ছেলেমানুষ করলেন। বাড়ি করলেন। এইভাবে, একশ টাকা, দুশো টাকা জমিয়ে জমিয়ে। কিন্তু নিজের জন্য এক ফোঁটা খরচ করেননি। একটা পাঞ্জাবি পরেছেন বছরের পর বছর। আমি নতুন নিয়ে এনে হয়তো কিছুদিন পরে ফেলে দেব, বাবা সেই পাঞ্জাবিটাই কেচে, ধুয়ে, ইস্তিরি দিয়ে বারবার পরবেন। ঈদের সময় নতুন পাঞ্জাবি দেওয়ার কথা বললে, ধমক শুরু।
“এত টাকা খরচ কেন করলি! আমার কি কম আছে! টাকা থাকলেই খরচ করতে হবে নাকি? আজ্ঞা, তোদের একটুও আক্কেল নেই!”
আসলেই আক্কেল হয় না। সন্তানদের হয়তো হয় না।
মানুষটার বয়স বাড়ার সাথে সাথে একটা আজব গোঁড়ামি ধরেছে। বলি, “বাইরে একটু যাও না। তোমার কত বন্ধু আছে, তাদের সাথে আড্ডা দাও। মন ভালো লাগবে।”
যাবেন না বাবা। ইচ্ছে করে না নাকি। আসলে ব্যাপারটা হলো, বাইরে গেলে খরচ। সেই খরচ বাঁচাতে চান। আমাদের জন্য রেখে যেতে চান। তাঁর নিজের কোন শখ নেই, কোন শখের কথা বলতে গেলে, পনেরো বছর আগে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড মোটরসাইকেল কিনেছিলেন। একবার চালিয়ে তিনবার গামছা দিয়ে মুছে ফেলেছিলেন। এখনো সেই মোটরসাইকেল ঝকঝকে চকচকে করে। মাঝেমধ্যে ঘরের ভেতর একটা গুরুম গুরুম শব্দ শোনা যায়। পরে বুঝি, বাবা স্টার্ট দিচ্ছেন। কিন্তু কিছুদিন পরপর স্টার্ট না দিলে নাকি ড্যাম হয়ে যায়। তেলের দামের জন্য এখন আর চালানোও হয় না। আমার সেই কলেজ লাইফের ভাঙাচোরা ফিনিক্স সাইকেলটা মাঝেমধ্যে নিয়ে বের হন।
আমি যখন লাল গাড়িটা নিয়ে বেড়াই, সেরা রেস্টুরেন্টে খাই, দেশবিদেশ ঘুরে বেড়াই, তখন এই সব আনন্দ মাঝখানেও একটা অস্বস্তি, একটা দোষের বোঝা চেপে ধরে। চুপচাপ হয়ে যাই। মনের এক কোণে বাবা থাকে। এই মানুষটা, যে জীবনে কোনদিন বিলাসিতা ছুঁয়ে দেখেনি, আর আমি… কতটা স্বার্থপরের মতো লাল গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াই।
একদিন সন্ধ্যায় ছাদে বসে বাবার সাথে গল্প করছিলাম। বাবা হঠাৎ বললেন, “জানিস, ছেলে, আমার একটা ইচ্ছে ছিল।”
কান খাড়া করে মন দিলাম। এত বছরে বাবাকে কখনো নিজের ইচ্ছের কথা বলতে শুনিনি।
“কী ইচ্ছে, বাবা?”
“আমি একবার দার্জিলিং যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু…”
বাবার কথা থেমে গেল। বুঝতে পারলাম, টাকার জন্যই ইচ্ছেটা পূরণ হয়নি। আমার বুকটা জ্বালা করে উঠল। কতটা নিঃस्वार्थ ছিলেন বাবা সারা জীবন! আমার জন্য, আমার বোনের জন্য, সবকিছু জোগাড় করেছেন। নিজের কোন সুখের কথা ভাবেননি।
“চলো, বাবা,” উত্তেজনা ঢাকাতে পারলাম না, “আগামী মাসেই দার্জিলিং যাব।”
বাবা একটু থমকে গেলেন। তারপর মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল।
“না, ছেলে। এত টাকা খরচ হবে কেন? তুমি তোমার বউ আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাও।”
“না, বাবা। তুমি না গেলে আমি যাব না।”
এবার বাবা আর না বলতে পারলেন। পরের মাসেই আমরা বাবার সঙ্গে দার্জিলিং গেলাম। পাহাড়ের উপর থেকে মেঘের সাথে ছেঁকাছেঁকি খেলা, চায়ের বাগানের বসে গল্প করা, ট্রয় ট্রেনে চড়ে ছোটবেলার স্মৃতি মনে করা – এই সব কিছু দেখে বাবার চোখে একটা আনন্দ দেখলাম, যেটা আগে কখনো দেখিনি।
দার্জিলিং থেকে ফিরে এসে বাবা আর আগের মতো থাকলেন না। মাঝেমধ্যে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যেতে লাগলেন। নতুন পাঞ্জাবিও পরলেন ঈদে। বড়ো ব্যাপারটা ঘটলো সেই পুরনো সাইকেল নিয়ে। এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, বাবা নেই। খুঁজে বের করলাম, তিনি সেই সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেলে চেপে রাস্তায় নেমেছেন। চেঁচামেচি করতে যাব, কিন্তু দেখি বাবা মুখে একটা ছেলেমানুষের হাসি হাসছেন। হাতটা বাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানালেন।
মনে মনে ভাবলাম, এই হাসিটাই তো এতদিন খুঁজছিলাম। বাবার নিজের আনন্দটাই তো এতদিন ভুলে গিয়েছিলাম।
সেদিন থেকে আর বাবাকে আটকানো হয়নি। মাঝেমধ্যে শুনতাম, তিনি বন্ধুদের সাথে সাইকেলে চষা খেয়ে বেড়াচ্ছেন। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, “কী বাবা, কেমন লাগে সাইকেলটা?”
বাবা একটা চাপ দিয়ে হাসলেন। “খারাপ না। কিন্তু একটা সমস্যা আছে।”
“কী সমস্যা?”
“একটা সিটই আছে। তোর বোনের ছেলেকে নিয়ে যাওয়া যায় না। ওকেও নিয়ে একটা সাইকেল কিনতে হবে।”
বাবার কথায় হেসে ফেললাম। বুঝলাম, বাবা বদলেছেন। এখন আর নিজের সুখের কথা চেপে রাখছেন না। আর আমিও বুঝতে পেরেছি, সন্তানদের সুখের জন্য সব জমানোর চেয়ে, মাঝেমধ্যে নিজের আনন্দে ভাগ করে নেওয়াটাও জরুরি। বাবার চোখের সেই আনন্দ, সেই ছেলেমানুষের মতো হাসিই হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড়ো ধন, কোনো টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না।