সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত এক রহস্যময় বাংলা ছোট গল্প—বিষাক্ত সূচে যুবরাজের মৃত্যু, ভাইয়ের ষড়যন্ত্র, আর এক বিজ্ঞানভিত্তিক খুনের ইতিহাস যা আপনাকে শিহরিত করে তুলবে।

বাংলা ছোট গল্প

Home » বাংলা ছোট গল্প » জীবাণু দিয়ে হত্যা

জীবাণু দিয়ে হত্যা

সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত এক রহস্যময় বাংলা ছোট গল্প—বিষাক্ত সূচে যুবরাজের মৃত্যু, ভাইয়ের ষড়যন্ত্র, আর এক বিজ্ঞানভিত্তিক খুনের ইতিহাস যা আপনাকে শিহরিত করে তুলবে।

আমাদের WA চ্যানেল জয়েন করুন

এই মাসের সেরা হাড়হিম করা ভৌতিক বাংলা ছোট গল্প পড়ুন ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করুন – পেঁতিজ্বলা মাঠের সেই রাত

রচনা - সুরজিৎ রায়   ||   গল্পপাঠে - কৌশিক   ||   শব্দগ্রহন ও পরিচালনায় - মিহান'স প্রোডাকশন হাউস 

অধ্যায় ১: রাজবাড়ির অন্দরমহলে — ষড়যন্ত্রের বীজ

সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত বাংলা ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।

পাকুড়। আজকের ঝাড়খণ্ড, আর তখনকার ব্রিটিশ ভারতের এক রাজকীয় প্রিন্সলি স্টেট। পাহাড় ঘেরা শান্ত শহর, আর তার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এক গর্বিত রাজপ্রাসাদ—যেখানে সময় থেমে থাকে, আর আবেগগুলো সোনার খাঁচায় বন্দি হয়ে যায়। এই রাজবাড়িতেই শুরু হয়েছিল এক ভয়ঙ্কর কাহিনি, যার শেষ ছিল এক ইতিহাসগড়া খুনের মাঝে।

রাজপরিবারের কর্তা ছিলেন প্রতাপেন্দ্র চন্দ্র পাণ্ডে—এক প্রভাবশালী জমিদার, যিনি শুধু ঐশ্বর্য নয়, প্রভাব, প্রতিপত্তি আর ভয় দিয়েও রাজ্য শাসন করতেন। তার প্রথম স্ত্রী কননবালা, এক সুশীল, সংযত নারী, আর তার গর্ভেই জন্ম নিয়েছিল ছোট ছেলে অমরেন্দ্র। দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন বলোবালা, যার গর্ভে জন্ম নেয় বিনয়েন্দ্র, প্রতাপেন্দ্রর বড় ছেলে।

এই দুই ভাই—বিনয়েন্দ্র আর অমরেন্দ্র, বয়সে ছিল প্রায় এক যুগের ফারাক। কিন্তু রক্তের সম্পর্কের থেকেও বেশি ছিল পারিবারিক জটিলতা, মান-অভিমান, এবং উত্তরাধিকার নিয়ে চাপা উত্তেজনা।

১৯২৯ সালে প্রতাপেন্দ্র চন্দ্র পাণ্ডে মারা গেলে, সম্পত্তির বিষয়টি হয়ে ওঠে জটিল ও স্পর্শকাতর। মৃত্যুর আগে তিনি তার দুটি পুত্রের মধ্যে সমানভাবে সম্পত্তি ভাগ করে দেন—যেখানে ছিল কয়লা ও পাথরের খনি, বিস্তীর্ণ জমিজমা, এবং হাজার হাজার টাকার ব্যবসা। তবে এক শর্ত ছিল—ছোট ছেলে অমরেন্দ্র তখনও নাবালক, তাই বড় ভাই বিনয়েন্দ্র তার সম্পত্তির তত্ত্বাবধানে থাকবেন যতক্ষণ না অমরেন্দ্র ১৮ বছরে পৌঁছান।

এই সিদ্ধান্ত যেন বিনয়েন্দ্রর মনে চিরস্থায়ী আগুন জ্বেলে দিল।

বিনয়েন্দ্র ছোটবেলা থেকেই ছিলেন আত্মকেন্দ্রিক, একরোখা এবং প্রবল অহংকারে পরিপূর্ণ। বাবার মৃত্যুর পর তিনিই রাজপ্রাসাদের মূল কর্তা হয়ে ওঠেন। লোকচক্ষুর সামনে ভ্রাতৃত্বের মুখোশ পরে থাকলেও, ভিতরে ভিতরে অমরেন্দ্রর প্রতি ক্রমাগত বিরক্তি, বিদ্বেষ আর হিংস্রতা জমতে থাকে।

অন্যদিকে, অমরেন্দ্র ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত—ভদ্র, মেধাবী, পরিশীলিত এবং সকলের প্রিয়। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলেন, সাহিত্য আর সমাজনীতি নিয়ে আগ্রহ ছিল তার। প্রজারা তাকে ভালোবাসতেন, কারণ তিনি অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছিলেন কঠোর। এই জনপ্রিয়তা যেন বিনয়েন্দ্রর অহংকারে বড় আঘাত হানে।

সময় গড়িয়ে চলে। ১৯৩৩ সালে অমরেন্দ্র ১৮ বছর পূর্ণ করেন এবং আইনগতভাবে নিজের সম্পত্তির দাবি জানান। এই দাবিতে বিনয়েন্দ্রর ভেতরে যেন আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ে অভিমান ও হিংসা। তিনি মনে করতে থাকেন—ছোট ভাই তার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, তার প্রাসাদ, তার ক্ষমতা, তার গৌরব।

এই সময়ই রাজবাড়িতে বদলে যেতে থাকে পরিবেশ। অমরেন্দ্র বাড়ি এলে তাকে স্বাগত জানানো হয় ঠিকই, কিন্তু সেই আতিথেয়তার মধ্যে ছিল ঠান্ডা ব্যঙ্গ, চোখে চোখ রেখে চেপে রাখা রাগ, আর মাঝে মাঝে নিরব উপহাস। একসময় বিনয়েন্দ্র মুখে বলে ফেলেন, “এই রাজবাড়ি তো আমারই থাকবে, কেড়ে নেওয়ার সাহস কেউ রাখে না।”

প্রাসাদের অন্দরমহলেও বাতাস ঘন হয়ে ওঠে। রান্নাঘর, চাকরদের ঘর, এমনকি মন্দির ঘরের পুরোহিতও জানত—কিছু একটা ভয়ঙ্কর ঘটতে চলেছে। ভেতরের দাসীরা কানে কানে বলত, “ছোট ঠাকুরের প্রতি বড় ঠাকুরের রাগ খুবই বেশি।” কেউ কেউ বলত, বিনয়েন্দ্র নাকি তন্ত্রসাধকদের দ্বারস্থ হয়েছেন ছোট ভাইকে সরানোর উপায় খুঁজতে।

এদিকে, অমরেন্দ্র এইসব ষড়যন্ত্র টের পেলেও চুপ থাকেন। হয়তো ভাইয়ের প্রতি বিশ্বাস ছিল, বা হয়তো অহংকার ছিল না বলেই সব মেনে নিতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু সত্যি হলো—এই চুপ থাকা, এই বিশ্বাস, হয়তো তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল।

ঠিক তখনই রাজবাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করে আরেকটি চরিত্র—তারানাথ ভট্টাচার্য। বাইরে থেকে সাধারণ ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট মনে হলেও, বাস্তবে তিনি ছিলেন এক বিপজ্জনক মানুষ। তাঁর জীবাণুবিজ্ঞানের ওপর গভীর জ্ঞান ছিল। টিটেনাস, প্লেগ, কলেরা—সব জীবাণুর প্রভাব তিনি জানতেন নিখুঁতভাবে। বিনয়েন্দ্রর চোখে তিনি হয়ে ওঠেন এক “অস্ত্রধারী”—অস্ত্র, যার গুলি নেই, নেই বারুদের শব্দ—কিন্তু রয়েছে নিঃশব্দ মৃত্যু।

অদম্য মায়া - অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প: অদম্য সাহস ও আত্মবিশ্বাসের অনুপ্রেরণায় ভরা একটি মোটিভেশনাল বাংলা ছোট গল্প—যেখানে হার মানে না জীবনের ঢেউ, বরং জাগে নতুন করে বাঁচার সাহস ও স্বপ্ন। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।

অধ্যায় ২: বিষাক্ত উপহার — মৃত্যুর ছায়ায় প্রথম আঘাত

সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত বাংলা ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।

১৯৩২ সালের এক দুপুর। পাহাড়ি বাতাসে গাছপালা দুলছে, দূর থেকে ভেসে আসছে ঝর্ণার শব্দ। শান্ত পরিবেশ, নিস্তব্ধ প্রকৃতি—সব মিলিয়ে যেন ছবির মতো এক দৃশ্য। এই দৃশ্যের মাঝে দাঁড়িয়ে অমরেন্দ্র, তখন এক তরুণ, যার মুখে ভবিষ্যতের স্বপ্ন, চোখে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি। সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক অমরেন্দ্র তখন পারিবারিক ব্যবসা ও সম্পত্তি বুঝে নিতে প্রস্তুত। তাঁর হাতে ছিল রাজবাড়ির ভবিষ্যৎ, আর মাথার ওপর ছিল বাবার স্মৃতির ছায়া।

এমন সময় একদিন তাঁর বড় ভাই বিনয়েন্দ্র তাঁকে উপহার দিলেন একজোড়া দামি চশমা। বিলিতি স্টাইল, চকচকে ফ্রেম, আর চোখে লাগাতেই যেন একটা রাজকীয় ভাব। অমরেন্দ্র হাসিমুখে বলেছিলেন, “ভাইয়ের উপহার, আর কিছু না হোক, ভালোবাসা তো আছে।”

কিন্তু কে জানত, এই উপহারের ফ্রেমেই লুকিয়ে ছিল মৃত্যুর ছায়া?

চশমাটি পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অমরেন্দ্রর নাকে একটি কাটা লাগে। তিনি প্রথমে গুরুত্ব দেননি। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পেরোতেই তাঁর শরীরে দেখা দিলো অদ্ভুত পরিবর্তন—মাংসপেশিতে টান, তীব্র জ্বর, আর অসহ্য ব্যথা। স্থানীয় ডাক্তাররা এসে পরীক্ষা করে জানালেন, এটা সাধারণ সংক্রমণ নয়—এটা টিটেনাস, এক মারাত্মক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ, যা সঠিক সময়ে প্রতিরোধ না করলে মৃত্যু অবধারিত।

অমরেন্দ্রর দেহে দ্রুতভাবে টিটেনাসের লক্ষণ ছড়িয়ে পড়ে। মুখ শক্ত হয়ে যাচ্ছে, পেশি সংকুচিত হচ্ছে, আর ব্যথা যেন শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে চেপে বসেছে। পরিবারের সবাই আতঙ্কে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, বড় ভাই বিনয়েন্দ্র ছিলেন শান্ত—অস্বাভাবিকভাবে শান্ত।

এই সংকটজনক সময়ে বিনয়েন্দ্র অমরেন্দ্রর কাছে তিনজন চিকিৎসক পাঠালেন। তাঁদের পরিচয় দেওয়া হলো ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক’ হিসেবে, কিন্তু পরে জানা যায়—তাদের কেউই প্রকৃত অর্থে ডাক্তার ছিলেন না।

তাদের মধ্যে একজন ছিলেন তারানাথ ভট্টাচার্য—কলকাতার এক গবেষণাগারে কর্মরত, একজন সাধারণ ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট। যদিও তার পেশাগত যোগ্যতা ছিল না, কিন্তু জীবাণু সংক্রমণ ও তার ফলাফল সম্পর্কে তার ছিল গভীর জ্ঞান।

এই তারানাথ-ই ভুল ইনজেকশন দেন অমরেন্দ্রর শরীরে—যে ইনজেকশন রোগ সারানোর বদলে রোগকে আরও জটিল করে তোলে। আরেক চিকিৎসক যখন সঠিক চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করেন, বিনয়েন্দ্র তখন জোরপূর্বক সেই চিকিৎসককে সরিয়ে দেন এবং আবার একজন নতুন ‘চিকিৎসক’—ডাঃ শ্রীপাদ নামের একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে নিয়ে আসেন।

কিন্তু অমরেন্দ্রর ভাগ্যে তখনও মৃত্যু লেখা ছিল না।

অমরেন্দ্রর অসুস্থতা একসময় স্থিতিশীল হয়। প্রকৃত চিকিৎসায় তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকেন। কিন্তু এই ঘটনায় তাঁর পরিবার চিন্তিত হয়ে পড়ে। একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ব্রিটিশ সরকারের অধীন ডি. পি. ল্যাম্বার্ট, বিষয়টি খতিয়ে দেখেন। তিনি পরীক্ষা করে জানালেন—চশমার ফ্রেমে টিটেনাস ব্যাসিলাস পাওয়া গেছে। স্পষ্ট হয়ে যায়, এটি কোনও দুর্ঘটনা নয়—এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাচেষ্টা।

তাঁর রিপোর্টে বলা হয়—“এটি একটি সচেতন প্রয়াস, যা অত্যন্ত জ্ঞানসম্পন্ন কারও দ্বারাই ঘটানো সম্ভব। এই ধরনের সংক্রমণ তৈরি করা সহজ নয়।”

ডি. পি. ল্যাম্বার্টের রিপোর্ট পুলিশের হাতে পৌঁছানোর পর বিষয়টি তদন্তের মোড় নেয়।

অমরেন্দ্রর সুস্থ হওয়ার পরে, তিনি কিছুটা চুপচাপ হয়ে পড়েন। হয়তো বুঝেছিলেন, শত্রু ঘরের মধ্যেই বাস করে। তাঁর ছোট বোন বলোবালা তাঁর পাশে ছায়ার মতো ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বড় ভাইয়ের মধ্যে কোনও স্বাভাবিকতার ছাপ নেই। তাঁর চোখে, হাঁটাচলায়, এমনকি কথাবার্তায়ও যেন লুকিয়ে ছিল একটা অন্যরকম উন্মাদনা।

অমরেন্দ্র চেয়েছিলেন বিষয়টি থামিয়ে দিতে। মামলা না করে, পুলিশের কাছে না গিয়ে, শান্তিপূর্ণভাবে জীবন শুরু করতে। তিনি হয়তো বিশ্বাস করতে চেয়েছিলেন, ভাই বলে কথা—এটা ভুল হতে পারে। হয়তো দুঃস্বপ্ন। হয়তো অন্য কেউ…

কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দ্বিতীয় সুযোগ সবসময় মেলে না।

একদিন তারানাথ ভট্টাচার্য নিজেই স্বীকার করেন—চশমার ফ্রেমে ব্যাকটেরিয়া তিনিই দিয়েছেন, বিনয়েন্দ্রর অনুরোধে। তাঁর ভাষায়, “আমার কাজ ছিল একটা পরীক্ষামূলক হত্যাচেষ্টা চালানো। টিটেনাস এমন একটি রোগ যা নিঃশব্দে মেরে ফেলতে পারে, এবং অনেক সময় ডাক্তাররাও ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না।”

এই বক্তব্যের পর তারানাথের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু বিনয়েন্দ্র, তাঁর ক্ষমতা ও টাকা দিয়ে সবকিছু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। স্থানীয় প্রশাসনের অনেকেই তখন তাঁর কথায় চলতেন। তবে পুলিশের সন্দেহ গভীর হতে থাকে।

তদন্তকারীরা বুঝতে পারেন—এই হত্যাচেষ্টা ছিল শুধুমাত্র শুরু। কিছু একটা আরও বড় কিছু আসছে। একটা নিখুঁত, অদৃশ্য মৃত্যুর পরিকল্পনা রচনা করা হচ্ছে।

যদিও অমরেন্দ্র সেইবার মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান, কিন্তু তাঁর শরীর, মন এবং জীবনের ভেতর ঢুকে পড়ে এক অজানা আশঙ্কা। রাজপ্রাসাদের প্রতিটি করিডোরে যেন কানাঘুষা—”ছোট ঠাকুরের জীবনে অমঙ্গল আসছে”, “রাজা মরবে রাজাইয়ের হাতে”, কিংবা “এই রাজবাড়ির ইতিহাস বদলাবে রক্ত দিয়ে”।

তাঁর জীবন তখন এক যুদ্ধক্ষেত্র—যেখানে তিনি জানেন না কার ওপর ভরসা করবেন। ভাই, চিকিৎসক, সহচর—সবাই যেন ধোঁয়াশায় মেশা একরকম মুখোশধারী।

কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল এই সত্যটি—ষড়যন্ত্র থামেনি, বরং আরও জটিল ও প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।

অধ্যায় ৩: মৃত্যুর স্টেশন — ষড়যন্ত্রের ট্র্যাকজুড়ে রক্তবর্ণ ছায়া

সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত বাংলা ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।

১৯৩৩ সালের ২৬ নভেম্বর। হাওড়া স্টেশন ভোরের আলোয় ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। কুয়াশায় মোড়া প্ল্যাটফর্মে ভেসে বেড়াচ্ছে ভাড়াটে কুলিদের হাঁকডাক, চায়ের কেটলির শিস, আর দূর থেকে আসা একটি ট্রেনের ধাতব চিৎকার। যাত্রীদের ভিড়ে হালকা বিশৃঙ্খলা, অথচ খুব স্বাভাবিক।

এই ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজপুত্র অমরেন্দ্র নারায়ণ পাকুড়। তাঁর মুখে হালকা উদ্বেগের রেখা, এক হাতে চামড়ার সুটকেস, অন্য হাতে পাসপোর্ট আর টিকিট। তিনি যাচ্ছিলেন পুরুলিয়া, কিছু পারিবারিক কাজ ও ব্যবসার তদারকির উদ্দেশ্যে। সাথে ছিলেন এক ভৃত্য ও তাঁর দেহরক্ষী।

সব ঠিকঠাকই চলছিল—যতক্ষণ না এক অজানা লোক হঠাৎ করে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ও ঠাকুর, কেমন আছেন?”

সেই অজানা লোকটি পরনের ময়লা ধুতি আর পাতলা চাদরে ঢাকা। সে যেন চেনা, আবার অচেনা। চট করে এক ঝাঁকুনিতে অমরেন্দ্রকে বুকে টেনে নেয়, আর ঠিক সেই সময়েই…

চমকে উঠলেন অমরেন্দ্র। “আমায় কেউ খুঁচিয়ে দিল!”—চিৎকার করলেন তিনি।

তাঁর বাহুতে এক ক্ষুদ্র সুঁচের চিহ্ন। যন্ত্রণাটা প্রথমে তেমন নয়, কেবল একটু জ্বালা। কিন্তু যেটা অমরেন্দ্রর দৃষ্টি আকর্ষণ করল, তা হলো তাঁর জামার কলারে লেগে থাকা রঙহীন, স্বচ্ছ এক তরল। গন্ধহীন। স্পর্শহীন। কিন্তু প্রাণঘাতী।

লোকটি এর মধ্যেই ভিড়ের মাঝে মিলিয়ে গেছে। দেহরক্ষী ছুটে গেলেও আর পাওয়া গেল না তাকে।

ঘটনার পরপরই প্ল্যাটফর্মে হৈচৈ শুরু হয়। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। স্টেশন মাস্টার এসে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, কিন্তু বিনয়েন্দ্র—অমরেন্দ্রর বড় ভাই, যিনি কিছুক্ষণ আগে তাঁকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন—বিষয়টিকে “সামান্য আচড়” বলে উড়িয়ে দেন।

“কোনো দস্যু হবে। হয়তো চুরি করতে এসেছিল,”—বললেন বিনয়েন্দ্র, মুখে একপ্রকার বিরক্তির ছায়া। “এত কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।”

কিন্তু অমরেন্দ্রর মনে তখন থেকে জন্ম নিচ্ছে এক ভয়ানক সন্দেহ। তাঁর চোখের সামনে ফিরে আসছে আগের বছরের চশমা-ঘটনা, ভুল ইনজেকশন, আর সেই নিখুঁত, গোপন হত্যাচেষ্টার স্মৃতি।

ট্রেনে উঠে কিছুক্ষণ পরেই অমরেন্দ্রর শরীরে দেখা দিল অদ্ভুত লক্ষণ। প্রথমে হালকা মাথাব্যথা। তারপর শরীর ঝিমঝিম করা শুরু করল। তাঁর জিহ্বা ভারী হয়ে গেল, মুখের চারপাশ শক্ত হয়ে এলো, শরীর নিস্তেজ হতে শুরু করল। এক সময় কাঁপুনি দিয়ে উঠল সারা গায়ে।

সঙ্গে থাকা ভৃত্য তখনও বিষয়টিকে হালকাভাবে নিয়েছিল। কিন্তু রাত ঘনাতেই দেখা গেল—অমরেন্দ্রর মুখ বেঁকে গেছে, পেশিতে টান পড়েছে, এবং তাঁর শরীর জ্বরায়িত।

তিনি শুধু ফিসফিস করে বললেন—“ওই লোকটা… ও আমাকে খুন করবে।”

হাওড়া স্টেশনের সেই রহস্যময় ঘটনার ঠিক পরদিনই, রাজপুত্র অমরেন্দ্র নারায়ণ পাকুড় রওনা হন পাকুড়ের রাজবাড়ির দিকে। তাঁর শরীরে তখনও সুঁচের খোঁচা থেকে তৈরি হালকা ব্যথা, তবে সেটাই যে মৃত্যুর ডাক হয়ে উঠবে, তখনও তা কেউ জানত না।

ট্রেন ছুটে চলেছিল ধানক্ষেত, পাথরঘেরা টিলা আর জনশূন্য স্টেশন পেরিয়ে। রাজপুত্রের চোখে ছিল ক্লান্তির ছায়া, ঠোঁট শুকনো, শ্বাস যেন ঘন ঘন হয়ে আসছিল। দেহরক্ষী ও ভৃত্য বুঝতে পারছিল—শরীরে কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটছে।

অধ্যায় ৪: রোগের ছায়ায় — মৃত্যুর আস্ত ছায়ায় ঢাকা রাজপুত্র

সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত বাংলা ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।

পাকুড়ে পৌঁছেই শুরু হয় নতুন অধ্যায়। সেদিন বিকেলেই তাঁর হাত ফুলে ওঠে, রঙ লালচে বেগুনি। শরীর জ্বরে পুড়তে থাকে। শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী, যেন বুকের ভেতর জমে আছে কিছু একটা। চোখেমুখে দেখা দেয় অবসাদ আর অজানা ভয়ের ছাপ।

রাজবাড়ির পুরনো চিকিৎসক প্রথমে ভাবলেন এলার্জি বা সংক্রমণ, কিন্তু রাত গড়াতে বুঝতে পারলেন—এটা সাধারণ জ্বর নয়, এটা কিছু মারাত্মক।

একসময় অমরেন্দ্র ফিসফিস করে বললেন, “ওরা থামবে না। আমি জানি, আমার শরীরেই তারা দখল নিচ্ছে।”

পরদিনই সিদ্ধান্ত হয়—তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে। ঘোড়ার গাড়ি, তারপর স্টেশন থেকে ট্রেন—সব যেন এক ভয়াল সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিল। রাজপরিবারের বিশ্বস্ত চালক বলেছিলেন:

“ওনার চোখ তখন এমন এক ভয় দেখাচ্ছিল—যেটা রোগের ছিল না, ছিল বিশ্বাসঘাতকতার। যেন তিনি জানতেন কে করেছে, কিন্তু বলার শক্তিটুকুও নেই।”

কলকাতার মল্লিকবাজারের বাসভবনে তাঁকে নিয়ে আসা হয়, আর সেখানেই ডাকা হয় শহরের অন্যতম খ্যাতনামা চিকিৎসক—ডাক্তার নলিনী রঞ্জন সেন গুপ্ত

ডাঃ সেন গুপ্ত পরীক্ষা করলেন, তাঁর অভিজ্ঞ চোখ ঝুঁকে পড়ল অমরেন্দ্রর ফুলে ওঠা হাতে, হাই পার ফিভারে জ্বলতে থাকা কপালে, আর বারে বারে কেঁপে ওঠা বুকে। প্রথমেই তিনি বুঝলেন—নিউমোনিয়া নয়, এটা অন্য কিছু।

ব্লাড রিপোর্টে দেখা গেল সাদা রক্ত কণিকার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, রক্তের pH স্তর নেমে যাচ্ছে, স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাঁর একটি মন্তব্য সে রাতেই ডায়েরিতে লেখা ছিল:

“এই রোগ যেন অদৃশ্য। ছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ছে। আমি যত পরীক্ষা করছি, ততই মনে হচ্ছে—শরীরের নিজস্ব যুদ্ধ সে হেরে যাচ্ছে। কে জানে, শরীরের বাইরে থেকেই কেউ সেই যুদ্ধ শুরু করিয়ে দিয়েছে কি না!”

চিকিৎসা চলছিল—আইস প্যাক, অক্সিজেন, অ্যান্টিবায়োটিক। কিন্তু অমরেন্দ্রর শরীর যেন কোনো ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দিচ্ছিল না।

৩ ডিসেম্বরের রাতে প্রথম কোমার লক্ষণ দেখা যায়। তিনি আর চোখ খুললেন না। চুপচাপ পড়ে রইলেন, শ্বাসের শব্দ ভারী হয়ে উঠল, ধীরে ধীরে স্তব্ধ।

৪ ডিসেম্বর সকাল ৬টা ১৭ মিনিটে, ডঃ সেন গুপ্ত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঘোষণা করলেন—

“প্রিন্স অমরেন্দ্র নারায়ণ আর নেই।”

সার্টিফিকেটে লেখা হলো—কারণ: নিউমোনিয়া এবং সেপটিক শক

কিন্তু যারা অমরেন্দ্রর শেষ কয়েক দিন পাশে ছিলেন, তারা কেউ এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়নি। রাজবাড়ির পুরাতন সেবিকা কুন্তলা দেবী বলেছিলেন:

“ওঁর শরীরে যেমন ফুলে গিয়েছিল, তেমনটা সাধারণ নিউমোনিয়ায় হয় না। আমি ৪০ বছরের চাকরিজীবনে এমন মৃত্যু দেখিনি।”

অনেকে বলতে শুরু করল—চিকিৎসার ভুল নয়, রোগ নয়, এটা পরিকল্পিত হত্যা।

ঘটনার পর বিনয়েন্দ্র নারায়ণ রাজপুরী ছিলেন সম্পূর্ণ চুপ। ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল—“ভাগ্যের খেলা। ওর শরীর সবসময়ই দুর্বল ছিল।”

তবে পরিবারের অন্য সদস্যরা জানতেন, অমরেন্দ্রর শরীর দুর্বল ছিল না—বরং সাহসী, ধৈর্যশীল এবং শারীরিকভাবে শক্তিশালী একজন পুরুষ ছিলেন তিনি।

তাঁর মৃত্যু ঘিরে তৈরি হলো নানা জল্পনা:

  • কি ছিল সেই ইনজেকশনের মধ্যে?
  • স্টেশনে সেই লোক কে ছিল?
  • ডাক্তারের ওষুধ কাজ করেনি, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল?
  • আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—এই মৃত্যুর উপকারভোগী কে?

বিনয়েন্দ্রর চরিত্রে তখন জমতে থাকে সন্দেহের কুয়াশা। তিনি উত্তর না দিয়ে, রাজ্য পরিচালনায় মন দিলেন। পুরো রাজবাড়ির সম্পত্তি ও খনিজ খনির নিয়ন্ত্রণ একাই নিলেন হাতে।

অনেকে বলেন, অমরেন্দ্রর মৃত্যু তার জন্য সুবিধাজনক ছিল—রাজ্য ভাগ হওয়ার পরও, অমরেন্দ্র আলাদা অংশ নিয়েছিলেন যা খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। অমরেন্দ্রের সন্তান ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর সেই অংশ সরাসরি বিনয়েন্দ্রর আওতায় চলে আসে।

অমরেন্দ্রর মৃত্যুর পর তাঁর ঘরের আলমারি থেকে মেলে একটি ডায়েরি। শেষ পাতায় লেখা:

“আমার শরীরে বিষ ঢুকেছে, আমি নিশ্চিত। কারা করেছে, তা আমি জানি—কিন্তু প্রমাণ নেই। যদি আমি না বাঁচি, দয়া করে সত্য খুঁজে বের করো। মৃত্যু হোক, কিন্তু ন্যায়বিচার যেন জাগে।”

এই লেখা শোনার পর গোটা রাজবাড়ি যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাতাস ভারী হয়েছিল চোখের জলে নয়, অজানা ভয়ের ছায়ায়।

অধ্যায় ৫: রক্তে ছড়িয়ে মৃত্যু

সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত বাংলা ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।

৪ ডিসেম্বর, ১৯৩৩—সকালটা যেন কুয়াশায় মোড়া শবযাত্রা।

কলকাতার রাজবাড়ির ভেতরে রাজপুত্র অমরেন্দ্র নারায়ণের দেহ শুয়ে আছে নিস্তব্ধতায়, যেন মৃত্যুর মধ্যেও সে বলে চলেছে এক অলিখিত গল্প। রাজপরিবারের সদস্য, বিশ্বস্ত কর্মচারী আর কিছু মাত্র মানুষ কাঁধে নিলেন তাঁর দেহ। কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল এক অভাবনীয় ঘটনা—রক্তের রিপোর্ট হাতে এল।

রিপোর্ট দেখে ডাক্তার নলিনী রঞ্জন সেন গুপ্ত চমকে উঠলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে রাজপরিবারের দরজা খুলে ঢুকে পড়ল কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন ও স্বাস্থ্য বিভাগ। কারণ, রিপোর্টে লেখা ছিল একটি ভয়ংকর শব্দ—Yersinia pestis

Yersinia pestis—মানে বিউবোনিক প্লেগের জীবাণু। ইউরোপের ‘ব্ল্যাক ডেথ’-এর জন্য দায়ী যে জীবাণু, সেই একই নাম।

কিন্তু প্রশ্ন উঠল—কীভাবে?

কলকাতায় গত তিন বছরে কোথাও প্লেগের নামগন্ধ ছিল না। সরকারি রেকর্ড ছিল একেবারে পরিষ্কার। কোনো এলাকা, কোনো হাসপাতাল বা দারিদ্র্যপীড়িত জনপদে এমন সংক্রমণ হয়নি।

তাহলে, এক রাজপুত্রের শরীরে এই ভয়ানক রোগ এল কোথা থেকে?

অমরেন্দ্রর দেহ দাহ করার প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু ঠিক তার আগেই রাজবাড়িতে হাজির হন কলকাতা কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কমিশনার এবং পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ। তাঁরা নির্দেশ দেন—

“এই দেহ দাহ করা যাবে না। আগে ফরেনসিক টেস্ট হবে। কারণ এটা একটা পাবলিক হেলথ থ্রেট।”

রাজপরিবার চমকে ওঠে। বিনয়েন্দ্র নারায়ণ, বড় ভাই, প্রবল আপত্তি তোলেন। বলেন, “আমার ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে পাবলিক শো বানানোর কোনো প্রয়োজন নেই।” কিন্তু আইন তখন স্বাস্থ্য ও জননিরাপত্তার দিকে ঝুঁকে।

কয়েকটি টেস্ট টিউবে অমরেন্দ্রর রক্ত, তাঁর ব্যবহৃত পাঞ্জাবি ও মাথার চুল পাঠানো হয় আলিপুর প্যাথলজিকাল ল্যাবরেটরিতে। রিপোর্ট আসে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই—রক্তে স্পষ্ট চিহ্ন Yersinia pestis-এর। তবে এটি ছিল এক অদ্ভুত স্ট্রেন, অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত এবং অপ্রাকৃতিক রকম সক্রিয়।

ডঃ সেন গুপ্ত বলেন,

“এই প্লেগ জীবাণু বাহ্যিক উৎস থেকে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করেছে বলেই মনে হচ্ছে। এটা স্বাভাবিক সংক্রমণ নয়।”

এই বক্তব্যটি ছিল ঘটনার মোড় ঘোরানো মুহূর্ত।

প্লেগের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করতে পারে:

  1. বাহকের কামড়ে (যেমন পোকা বা ইঁদুর)
  2. বাতাসের মাধ্যমে সংক্রমণ
  3. বা সরাসরি ইনজেকশনের মাধ্যমে রক্তে প্রবেশ

যেহেতু অমরেন্দ্র ছিলেন উচ্চবর্গের মানুষ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকতেন এবং কলকাতায় প্লেগ ছিল না, তখন তদন্তকারীরা প্রশ্ন তোলেন—

“এটা কি ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল?”

আর তখনই, সকলের মনে পড়ে যায় সেই ২৬ নভেম্বর, হাওড়া স্টেশনের ঘটনা।

“আমায় কেউ খুঁচিয়ে দিল!” — সেই ভয়াল শব্দের প্রতিধ্বনি

হাওড়া স্টেশনে অমরেন্দ্র বলেছিলেন, “আমায় কেউ খুঁচিয়ে দিল।” একজন অচেনা লোক তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিল এবং সুঁই ফুটিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল।

প্রথমে বিষয়টি ধরা হয় ছোটখাটো চোট বলে। এমনকি বড় ভাই বিনয়েন্দ্রও তখন বলেছিলেন, “একটা আচড় মাত্র।”

কিন্তু এখন সেই খুঁচিয়ে দেওয়া জায়গাতেই দেখা গিয়েছে হাত ফুলে গিয়েছিল, আর সেখান থেকেই শরীরে প্রবেশ করেছে প্লেগের জীবাণু।

তদন্তকারীরা দৃঢ়ভাবে বললেন—
“এটি ছিল পরিকল্পিত ইনজেকশন। এবং এটি ছিল প্রাণঘাতী অস্ত্র।”

কলকাতা পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে হাওড়া স্টেশন এলাকার সমস্ত রেকর্ড, সিসিটিভি না থাকলেও পুরনো ফটোগ্রাফারদের ছবিগুলি, প্ল্যাটফর্মের ফুড ভেন্ডর ও কুলি—সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।

এক কুলি জানায়,

“একজন স্যুট পরা ভদ্রলোককে দেখেছিলাম রাজপুত্রকে আলিঙ্গন করতে। ভাবলাম হয়তো পরিচিত। কিন্তু পরে দেখি সেই লোক দৌড়ে প্ল্যাটফর্ম ফেলে পালাল।”

কিন্তু ততদিনে সেই অচেনা লোক বেপাত্তা। নাম-পরিচয়, এমনকি গেট দিয়ে বেরোনোর সময় কোনো নজির নেই।

এমন একটি মারাত্মক বিষ শরীরে ঢোকানোর মতো সাহস কাদের থাকে? সাধারণ অপরাধী নয়, এ কাজ পরিকল্পিত, সূক্ষ্ম এবং ক্ষমতাসম্পন্ন কেউ করেছে। প্রশ্ন জাগে—

  • রাজপরিবারের অভ্যন্তরে কেউ এর সঙ্গে যুক্ত?
  • পাকুড়ের সম্পত্তি নিয়ে যেহেতু দ্বন্দ্ব ছিল, বিনয়েন্দ্র কি সুবিধাভোগী?
  • নাকি রাজপরিবারের বাইরের কেউ, যাদের কাছে এই রাজা ছিল বাধা?

পুলিশ এখন দৃষ্টি দেয় অমরেন্দ্রের পূর্বের শত্রুদের দিকে। সেই পুরোনো বিষাক্ত চশমার ঘটনা, ভুয়া ডাক্তারদের দ্বারা ইনজেকশন দেওয়া—সবই একসূত্রে গাঁথা হয়ে যায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্লেগ বিশেষজ্ঞ ডঃ গোবিন্দলাল ভট্টাচার্য বলেছিলেন:

“প্লেগ এইভাবে শরীরে ঢুকলে, এক থেকে তিন দিনের মধ্যেই লক্ষণ প্রকাশ পায়—ঠিক যেমন অমরেন্দ্রর হয়েছিল। ফুলে যাওয়া, উচ্চ জ্বর, শ্বাসকষ্ট—সব ছিল ক্লাসিক কেস। তবে সবচেয়ে বড় বিষয়—এত নিখুঁতভাবে কেউ প্লেগ ইনজেক্ট করেছে—এটা অসাধারণভাবে বিপজ্জনক দক্ষতা।”

এ মন্তব্যের পর মিডিয়া রিপোর্টে হেডলাইন হয়:

“রাজার মৃত্যুতে ঘুরছে বায়োলজিক্যাল অ্যাসাসিনের ছায়া।”

অমরেন্দ্র নারায়ণের মৃত্যু এখন আর শুধুই ভাইয়ের প্রতি ঈর্ষার কাহিনি নয়। এখন এটা হয়ে উঠেছে বায়োলজিক্যাল অ্যাসাসিনেশন-এর একটি বিরল উদাহরণ।

স্বাস্থ্য দপ্তর সতর্কতা জারি করে। অমরেন্দ্রর সঙ্গে যোগাযোগ করা অন্তত ১৭ জনকে কোয়ারান্টিনে রাখা হয়। রাজবাড়ি জীবাণুনাশক দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়।

প্লেগের রিপোর্ট যেন অমরেন্দ্রর মৃত্যুকে এক নতুন আলোয় এনে দাঁড় করাল। এটা আর শুধুই “ভাগ্যের খেলা” নয়, এটা পরিকল্পিত, নির্বিকার, শীতল এক হত্যার রূপরেখা।

প্লেগের জীবাণু রক্তে প্রবেশ করেছিল—তবে তার আগে প্রবেশ করেছিল বিশ্বাসঘাতকতা, ঈর্ষা, আর ক্ষমতার তৃষ্ণা।

আর তাই অমরেন্দ্রর মৃত্যু ছিল না কেবল এক মানুষের নিঃশেষ—এটা ছিল সততার পতন, ভালোবাসার বিশ্বাসচ্যুতি, আর রাজপরিবারের অন্তঃকলহের এক ভয়াল পরিণতি।

প্রেমের নতুন ঠিকানা - বাংলা রোমান্টিক ছোট গল্প: অসম্পূর্ণ ভালোবাসা, বৃষ্টি ভেজা স্মৃতি আর জীবনের নতুন মানে খোঁজার আবেগঘন রোমান্টিক বাংলা ছোট গল্প। মেঘলা ও শান্তনুর হৃদয়ের যাত্রা পাঠককে ছুঁয়ে যাবে গভীরভাবে। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।

অধ্যায় ৬: হাফকিন ইনস্টিটিউটের ছায়ায়

সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত বাংলা ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।

কলকাতার রাজপুত্র অমরেন্দ্র নারায়ণের রহস্যময় মৃত্যু এখন আর শুধুই পারিবারিক শোক নয়, তা রূপ নিয়েছে এক বিস্ময়কর অপরাধ তদন্তে।

১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরের শীত, চারদিকে কুয়াশা—আর সেই কুয়াশার আড়ালেই ঘনিয়ে উঠছে ষড়যন্ত্রের কালো ছায়া।

প্লেগ জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে অমরেন্দ্রের মৃত্যু—এই তথ্য সামনে আসতেই কাঁপে প্রশাসন, কেঁপে ওঠে সংবাদপত্রের হেডলাইন। কিন্তু প্রশ্ন একটাই—

“এই জীবাণু এল কোথা থেকে?”

প্লেগ জীবাণু সাধারণত খোলা বাজারে মেলে না। তখন ভারতে মাত্র একটিই জায়গা ছিল যেখানে এই ব্যাকটেরিয়া সংরক্ষিত ও গবেষণা করা হতো—মুম্বাইয়ের ‘হাফকিন ইনস্টিটিউট’।

এই প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছিল প্লেগ ও কলেরার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য। ব্রিটিশ সরকারের অধীন, উচ্চ নিরাপত্তার এই প্রতিষ্ঠান ছিল দেশের সবচেয়ে সংরক্ষিত গবেষণাগারগুলোর একটি। বাইরে থেকে কেউ ঢুকতে পারত না, আর ভেতরের কোনো জীবাণু বাইরে নিয়ে যাওয়াও প্রায় অসম্ভব ছিল।

তদন্তকারীরা তাই প্রথমেই দৃষ্টি দেন হাফকিন ইনস্টিটিউটের দিকে।

ডিরেক্টর ডঃ উইলিয়াম সিগ্রেভস বলেন—

“আমাদের গবেষণাগারে প্লেগ ব্যাকটেরিয়া রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার ওপর কড়া নজর রাখা হয়। বহির্জগতের সঙ্গে কোনো সংযোগই সম্ভব নয়। কারা এই ব্যাকটেরিয়া চুরি করতে পারে—তা ভাবতেই ভয় হয়।”

অমরেন্দ্রের ভাই বিনয়েন্দ্র নারায়ণ ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী তারানাথ গাঙ্গুলী—দুজনেরই একটি বম্বে সফরের ইতিহাস উঠে আসে তদন্তে।

১৯৩৩ সালের জুন মাসে তাঁরা মুম্বাই গিয়েছিলেন “ব্যবসায়িক বৈঠক” ও “বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সাক্ষাতের” অজুহাতে। তাদের থাকার জায়গা ছিল একটি অভিজাত হোটেলে, নিয়মিত পার্টি, রেসকোর্স ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে লাঞ্চে মেতে ছিলেন তাঁরা।

কিন্তু তদন্তকারীরা খোঁজ নিতে গিয়ে পায় অদ্ভুত মিল—হাফকিন ইনস্টিটিউটের দুজন জুনিয়র টেকনিশিয়ানও সেই সময় হোটেলটিতে এসেছিলেন এক “বিশেষ মিটিং”-এ।

তদন্তে প্রকাশ পায়—বিনয়েন্দ্র ও তারানাথ মুম্বাইয়ে পরিচিত হন হাফকিন ইনস্টিটিউটের এক গবেষক, সিদ্ধেশ্বর দত্ত-র সঙ্গে। সিদ্ধেশ্বর তখন চাকরিতে অসন্তুষ্ট, বেতন কম, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

তারা সিদ্ধেশ্বরকে প্রস্তাব দেন—“কিছু মাত্রায় প্লেগ ব্যাকটেরিয়া চাই। পরীক্ষার জন্য। নাম প্রকাশ হবে না। বিনিময়ে ৫০০০ টাকা।”

তখনকার দিনে পাঁচ হাজার টাকা মানে প্রায় একটা ছোট রাজ্যের মাসিক বাজেট। সিদ্ধেশ্বর রাজি হন, তবে সরাসরি জীবাণু না দিয়ে ল্যাবের এক ব্যাকআপ স্যাম্পল তাঁদের হাতে তুলে দেন, ছোট এক কাঁচের শিশিতে।

এই চুক্তির সাক্ষী ছিলেন তারানাথ গাঙ্গুলী। সেই সময়কার হোটেলের রেজিস্টার বইতে তিনজনের নাম পাওয়া যায় একসাথে।

কলকাতায় ফিরে এসে বিনয়েন্দ্র সেই শিশি গোপনে রেখে দেন রাজবাড়ির পুরনো ওষুধের আলমারিতে। এই কাজ এতটাই নিখুঁতভাবে করা হয়েছিল যে, রাজবাড়ির কেউ জানতেই পারেনি।

তারপর আসে সেই পরিকল্পনা—“প্লেগ ইনজেকশনের মাধ্যমে অমরেন্দ্রকে সরিয়ে দেওয়া হবে।”

তখনই নিয়োগ করা হয় সেই অজানা ঘাতককে, যিনি হাওড়া স্টেশনে সুঁই ফুটিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান।

ঘটনাটি নিখুঁত। এতটাই নিখুঁত যে, কেউ ভাবতেও পারেনি এ কাজ এক ভাইয়ের পরিকল্পিত হত্যার অংশ হতে পারে।

তদন্তকারীরা তারানাথ গাঙ্গুলীর বাড়ি তল্লাশি করে এক পুরনো ডায়েরি পায়। সেখানেই ছিল এক ছেঁড়া কাগজের টুকরো, যাতে লেখা ছিল:

“S.D. – delivered glass at Taj. BN satisfied. Payment in two halves.”

S.D. মানে সিদ্ধেশ্বর দত্ত, Taj মানে তাজ হোটেল—সবটুকু মিলে যায়।

এরপর আরও চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসে—সিদ্ধেশ্বর ইনস্টিটিউট থেকে এক মাসের ছুটি নিয়েছিলেন ঠিক সেই সময়, যখন জীবাণু চুরির ঘটনা ঘটে।

হাফকিন ইনস্টিটিউটের রেজিস্টারেও ছিল “স্যাম্পল রেকর্ড” এর একটা গ্যাপ—যেটা ল্যাবের সুপারভাইজরও প্রথমে খেয়াল করেননি।

মুম্বাই পুলিশ সিদ্ধেশ্বরকে গ্রেফতার করে। প্রথমে তিনি চুপ ছিলেন, পরে তদন্তকারীরা দেখান তার বাড়ির ফ্রিজে রাখা সেই একই রকমের আরেকটি শিশি।

তখন সিদ্ধেশ্বর ভেঙে পড়েন। বলেন—

“আমি টাকা নিয়েছিলাম। বলেছিল, শুধুই পরীক্ষার জন্য। জানতাম না এইটা দিয়ে মানুষ মারা যাবে…”

তাঁর স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তারানাথ ও বিনয়েন্দ্রর নামে কলকাতা পুলিশের একটি বিশেষ মামলা রুজু হয়।

খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই রাজবাড়িতে ঝড়। অমরেন্দ্রর মা দেবী সৌম্যবালা দেবী সংবাদমাধ্যমকে বলেন—

“আমি বিশ্বাস করতে পারিনি, নিজের রক্ত এমনভাবে অন্য রক্তকে শেষ করতে পারে।”

বিনয়েন্দ্র চুপ থাকেন, কোনও বিবৃতি দেন না। তবে তাঁর আইনজীবী বলেন—”এটা ষড়যন্ত্র, রাজপরিবারকে অপমান করার জন্য বানানো গল্প।”

কিন্তু জনগণ, সংবাদমাধ্যম, এমনকি অনেক প্রভাবশালী রাজন্যবর্গও তখন একটাই কথা বলতে থাকেন—

“প্লেগ একটি অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে—আর সেই অস্ত্র কিনেছে, ব্যবহার করেছে রাজা নিজেই।”

তদন্তের শেষে পুলিশ রিপোর্টে লেখা হয়:

“হাওড়া স্টেশনে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অংশ হিসেবে। প্লেগ জীবাণু সরবরাহ করেছিল হাফকিন ইনস্টিটিউটের এক অসন্তুষ্ট কর্মচারী। আর অর্থ ও প্ররোচনায় যুক্ত ছিলেন রাজা বিনয়েন্দ্র নারায়ণ ও তারানাথ গাঙ্গুলী।”

মামলা শুরু হয় ১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে। কলকাতা কোর্ট চত্বরে সাংবাদিকদের ভিড়, প্রহরীদের কড়া পাহারা।

রাজপরিবার ভেঙে পড়ে—বিশ্বাস, মর্যাদা, সম্মান সব কিছুর অন্তিম অধ্যায় যেন শুরু হয়ে যায়।

অধ্যায় ৭: বিজ্ঞানী না খুনি?

সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত বাংলা ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।

সাধারণ চোখে তারানাথ ভট্টাচার্য ছিলেন একজন শান্ত-স্বভাবের, নম্র ও বইপাগল গবেষণা সহকারী। উচ্চশিক্ষিত, বিজ্ঞানের প্রতি অগাধ আগ্রহ। কোনো চিকিৎসক নন, কিন্তু জীবাণুবিদ্যা নিয়ে তাঁর ছিল গভীর জ্ঞান—বিশেষত প্লেগ, টিটেনাস এবং ব্যাকটেরিয়া-আধারিত অস্ত্র তৈরির অপ্রচলিত কৌশল।

কিন্তু ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে যখন কলকাতা পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে, তখন তাঁর এই পরিচয় প্রশ্নের মুখে পড়ে।

তখন শহরের একটাই প্রশ্ন—
“তারানাথ একজন নিখাদ গবেষক, না ঠাণ্ডা মাথার সিরিয়াল কিলার?”

তদন্তের সময় পুলিশের হাতে আসে তারানাথের এক ব্যক্তিগত নোটবুক। সেখানে অমরেন্দ্র নারায়ণের মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই বিস্ময়কর সব তথ্য লিখে রাখা ছিল—প্লেগ ব্যাকটেরিয়ার সংরক্ষণ পদ্ধতি, মানবদেহে প্রবেশের পর তার প্রতিক্রিয়া, ইনজেকশনের সঠিক ঘনমাত্রা।

নোটবুকের একটি পাতায় লেখা ছিল:

“মাত্র ০.১ সিসি লিকুইড ইনজেকশন যথেষ্ট। রক্তে গেলে দ্রুত বিস্তার। শরীর জ্বরাক্রান্ত হবে, ৩ দিনের মাথায় মৃত্যু অনিবার্য।”

এমন নির্লিপ্ত, গাণিতিক ভাবে মৃত্যুর পরিকল্পনা—এটা কি শুধুই গবেষণা, নাকি নিষ্ঠুর অপরাধের নীলনকশা?

পুলিশের কাছে তখন সোজাসুজি স্বীকারোক্তি আসে তারানাথের মুখ থেকে:

“আমি ইনজেকশনটা প্রস্তুত করেছিলাম। প্লেগ ব্যাকটেরিয়া দিয়েই। আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।”

জিজ্ঞাসাবাদে তারানাথ জানান—১৯৩৩ সালের আগস্ট মাসে বিনয়েন্দ্র তাঁর সঙ্গে একান্তে কথা বলেন।

বিনয়েন্দ্রর কথা ছিল পরিষ্কার:
“আমার ভাইকে সরাতে হবে। কিন্তু এমনভাবে, যাতে কেউ সন্দেহ না করে। চিকিৎসা করাতে করাতে যেন মারা যায়। তুমি কি এটা করতে পারবে?”

প্রথমে তারানাথ অস্বীকার করেন। কিন্তু পরে টাকার অঙ্ক শুনে, এবং বিনয়েন্দ্রর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাকে রাজপরিবারের ‘স্বাস্থ্য পরামর্শদাতা’ হিসেবে নিযুক্ত করা হবে—এই আশায় তিনি রাজি হয়ে যান।

তারানাথের কাজ ছিল—বিনয়েন্দ্র মুম্বাই থেকে এনে দেওয়া প্লেগ ব্যাকটেরিয়া দিয়ে একটি ইনজেকশন প্রস্তুত করা। সে ইনজেকশন যেন ক্ষুদ্র, দেহে ঢোকার সময় বোঝা না যায়, অথচ প্রাণঘাতী হয়—সেই অনুপাতে তরল তৈরি করেন তিনি।

তিনি বলেন—

“আমি জানতাম এটা অনৈতিক। কিন্তু বিজ্ঞানের জটিলতা নিয়ে খেলতে আমার সবসময়ই একটা মোহ ছিল। এটা যেন এক পরীক্ষা—কাজ করবে কিনা…”

তবে তারানাথ নিজে ইনজেকশন দেননি। তিনি বলেন, একজন ভাড়াটে খুনি-কে নিয়োগ দেওয়া হয় এই কাজের জন্য।
একজন সুঠাম গঠনের যুবক, পরিচিত মুখ নয়, কলকাতার বাইরে থেকে আনা হয়েছিল।

এই খুনির হাতে একটি বিশেষ সুচযুক্ত ছিপি দেওয়া হয়—তাতে ইনজেকশনের তরল ছিল ভেতরে সিল করা অবস্থায়। কাজটা ছিল মুহূর্তের—একটা জড়িয়ে ধরা অভিনয়, আর সঙ্গে সঙ্গে সুঁই ফুটিয়ে পালিয়ে যাওয়া।

ঘটনা ঘটে ১৯৩৩ সালের ২৬ নভেম্বর, হাওড়া স্টেশনে।
বিকেলে ট্রেন থেকে নামার পর অমরেন্দ্র তাঁর একজন পরিচিতের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখনই আসে সেই লোকটি—চাদরে মুখ ঢেকে, আচমকা এসে অমরেন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে বলে, “বাবু, কেমন আছেন?” —এরপরেই দ্রুত সুঁই ফুটিয়ে সটকে পড়ে।

অমরেন্দ্র তখনই চিৎকার করেন—“আমাকে কেউ খুঁচিয়ে দিল!”

তাঁর সঙ্গে থাকা লোকেরা প্রথমে বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু ওই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয় শরীরের অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া।

পুলিশ বহু চেষ্টা করেও সেই অজ্ঞাত ঘাতককে আর খুঁজে পায়নি। সিসিটিভি তখন ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শীরাও বলছিলেন, “চাদর ঢাকা, গায়ের রং মাঝারি, কথা কম বলেছে”—এমন অস্পষ্ট বর্ণনা দিয়ে কাউকে ধরা সম্ভব ছিল না।

ধারণা করা হয়, সেই ঘাতক কাজ শেষ করেই ট্রেন ধরেছিল— হয়তো বিহার বা ওড়িশার দিকে চলে যায়।
তারানাথ নিজেও সেই ব্যক্তির নাম বা ঠিকানা জানতেন না। পুরো কাজটাই হয়েছিল বিনয়েন্দ্রর মাধ্যমে।

এটাই সেই ষড়যন্ত্রের গভীরতা—যেখানে প্রত্যেক স্তরে ছিল পরিকল্পনা, কিন্তু কোনো কড়ি খুঁজে পেলেও মালা গাঁথা যেত না।

মনোবিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, তারানাথ ছিলেন একধরনের “অ্যামোরাল ইন্টেলেকচুয়াল”—যাঁরা ভালো-মন্দের বিচার নয়, বরং পরীক্ষার সাফল্যই তাদের কাছে সবকিছু।

তিনি প্রতিটি তদন্তে বারবার বলতেন—

“আমি কোনোদিন হত্যা করিনি। আমি শুধু একটি ইনজেকশন তৈরি করেছি। খুনটা তো অন্য কেউ করেছে।”

এটি একধরনের আত্ম-প্রতারণা। নিজের কাজকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা বলে চালিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা।
আসলে, তাঁর মধ্যে ছিল এক নির্দয় নিয়ন্ত্রণের আনন্দ—একজন মানুষের জীবন তাঁর তৈরি ব্যাকটেরিয়ায় থেমে যাবে—এই ভাবনাই ছিল তাঁর ‘গর্ব’।

তারানাথের বিরুদ্ধে আদালতে উপস্থাপন করা হয়:

  • ল্যাব রেকর্ড—যেখানে তাঁর তৈরি ইনজেকশনের উপাদানের তথ্য ছিল।
  • চিঠিপত্র ও ডায়েরি—যাতে ‘টেস্ট সাবজেক্ট’, ‘টক্সিন মাত্রা’, এমনকি ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃদু জ্বর’ ইত্যাদি লেখা ছিল।
  • সাক্ষ্য—হোটেল কর্মী, ইনস্টিটিউটের এক সাবেক সহকারী, এবং হোটেল রেজিস্টারে তাঁর নাম বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে।

তবে বিনয়েন্দ্রর বিরুদ্ধে যথেষ্ট সরাসরি প্রমাণ না থাকায়, তারানাথই হয়ে ওঠেন বিচার ব্যবস্থার মুখ্য আসামী।

১৯৩৪ সালের শেষ দিকে কলকাতা হাইকোর্টে রায় ঘোষণা হয়—
তারানাথ ভট্টাচার্য দোষী সাব্যস্ত হন ‘manslaughter by scientific conspiracy’-এর অপরাধে।

তাঁকে দেওয়া হয় আজীবন দ্বীপান্তর। আন্দামান পাঠানো হয়, যেখানে তিনি শেষ জীবন কাটান বিজ্ঞান বই আর নীরবতার মাঝে।

কিন্তু অনেকের মনেই প্রশ্ন থেকে যায়—তিনি কি সত্যিই একা দায়ী?
নাকি বড় রাজনীতির দাবার ছকে, সে ছিল শুধু এক ‘বিজ্ঞানী মোহর’—যার ওপর দোষ চাপিয়ে রাজপরিবারের রক্তকে রক্ষা করা হয়েছিল?

ডি. বি. কুপার হাইজ্যাকিং - সত্য ঘটনা: ডি.বি. কুপার: এক রহস্যময় সত্য ঘটনা। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে অমীমাংসিত এক হাইজ্যাকিংয়ের রোমাঞ্চকর গল্প। তার নিখোঁজ হওয়ার পরের কাহিনী জানুন। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।

অধ্যায় ৮: বিচারের কাঠগড়ায়

সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত বাংলা ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।

সেই অন্ধকার ষড়যন্ত্র, ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব, এবং বিজ্ঞানকে অস্ত্র বানানোর অবিশ্বাস্য গল্প—এবার তার চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। অমরেন্দ্রর মৃত্যু আর হাওড়া স্টেশনের সেই সুঁই ফুটিয়ে দেওয়া ঘটনার পরে, তদন্তকারীরা ছিন্ন ছিন্ন করে জড়ো করতে থাকেন প্রমাণের কণা। একে একে সমস্ত টুকরো মিলে যায় এক ভয়াবহ সত্যের ছবিতে।

এবার সেই ছবিটি উন্মোচিত হয়—বিচারের কাঠগড়ায়।

তদন্তের ফাইলে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক প্রমাণ:

  • চিঠিপত্র: বিনয়েন্দ্রর ব্যক্তিগত নোট ও তারানাথের হাতে লেখা কয়েকটি চিঠি, যেখানে গবেষণার নামে ‘special injection’ তৈরির নির্দেশ রয়েছে।
  • হাফকিন ইনস্টিটিউট থেকে চুরি যাওয়া জীবাণুর তথ্য, ও প্লেগ ব্যবহারের পরিকল্পনার বিবরণ।
  • মুম্বাইয়ের হোটেল রসিদ: ১৯৩৩ সালের অক্টোবর মাসে বিনয়েন্দ্র ও তারানাথ মিলে যে হোটেলে উঠেছিলেন, তার রেজিস্টার বই, যেখানে তাঁদের নামে ঘর বুকিং রয়েছে।
  • প্রস্তুতির প্রমাণ: প্লেগ ইনজেকশনের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য তাঁরা একটি ল্যাব থেকে ইঁদুর কিনেছিলেন—সেই দোকানের রসিদসহ, দোকানদারের সাক্ষ্য মেলে।
  • ল্যাব মেসেজ: তারানাথের গবেষণা নোটবুক ও নমুনা পাঠানো বার্তাগুলি—যা থেকে বোঝা যায়, ইনজেকশনটি মানুষে প্রয়োগের পূর্বেই ‘পশুতে সফল’ হয়েছে।

এইসব প্রমাণ আদালতে পেশ হতেই, পুরো আদালতকক্ষ নিস্তব্ধ হয়ে যায়।

পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এই প্রথমবার—একটি রাজপরিবারের সদস্য এবং একজন বিজ্ঞান সহকারী যৌথভাবে পরিকল্পনা করে জৈবিক খুন করেছেন—এমন মামলা বিচারাধীন।

কলকাতার জেলা ও দায়রা আদালতে মামলা শুরু হয় ১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে। বিচারক ছিলেন বিখ্যাত বিচারপতি সুবীর মুখার্জি। চারপাশে সাংবাদিক, সাদা কাগজে নোট নিতে থাকা তরুণ লেখক, রাজপরিবারের দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়েরা—ঘটনাটি যেন এক রাজনাটক।

আসামীপক্ষের প্রথম কৌশল ছিল—সব দায় চাপানো তারানাথের ঘাড়ে।
বিনয়েন্দ্রর আইনজীবী বলেন:

“আমার মক্কেল কোনোদিন কোনো ইনজেকশন তৈরির নির্দেশ দেননি। তিনি একমাত্র তার ভাইয়ের চিকিৎসার দুশ্চিন্তায় তারানাথকে পরামর্শ দেন।”

কিন্তু অভিযোগপক্ষ পাল্টা বলে:

“একজন রাজপুত্র, যিনি কোটি টাকার সম্পত্তি বণ্টনে অসন্তুষ্ট, যিনি ভাইয়ের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার পাবেন—তিনি নিজেকে নির্দোষ বলে চালাতে পারেন না। তিনি এই হত্যার মাস্টারমাইন্ড।”

মামলার সবচেয়ে বড় মুহূর্ত আসে তারানাথ ভট্টাচার্যর মুখে স্বীকারোক্তিতে। আদালতে চোখ মেলে তাকিয়ে তিনি বলেন:

“আমি ইনজেকশন তৈরি করেছি। প্লেগের জীবাণু ব্যবহার করেছি। কিন্তু আমি একা করিনি। বিনয়েন্দ্র বাবু আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যদি কাজ সফল হয়, আমায় পাকুড়ের প্রধান চিকিৎসক করা হবে।”

এই কথার সঙ্গে সঙ্গে আদালতজুড়ে চাঞ্চল্য।
প্রথমবার, এক স্পষ্ট গলায়, অপরাধের খুঁটিনাটি তুলে ধরলেন অপরাধীরাই।

তারানাথ আরও বলেন—

“আমার জীবনে কোনো রোগীকে আমি খুন করিনি। কিন্তু এইবার, আমি নিজেই ব্যাকটেরিয়ার গোলাম হয়ে গিয়েছিলাম। বিজ্ঞান দিয়ে খেলতে গিয়ে, মানুষ হারিয়ে ফেলেছিলাম।”

তাঁর গলায় অনুশোচনার সুর ছিল না—ছিল শুধুই ঠান্ডা যুক্তি। যেন এক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করছেন।

১৯৩৪ সালের অক্টোবর মাসে, দীর্ঘ নয় মাস শুনানি শেষে, আদালত রায় দেয়—

বিনয়েন্দ্র নারায়ণ এবং তারানাথ ভট্টাচার্য—উভয়েই দোষী।
অপরাধ: পূর্বপরিকল্পিতভাবে জৈবিক অস্ত্র প্রয়োগ করে হত্যাকাণ্ড ঘটানো।
শাস্তি: মৃত্যুদণ্ড।

আদালতে এই ঘোষণা শোনামাত্র, বিনয়েন্দ্র মাথা নিচু করে থাকেন। তারানাথ চোখ বন্ধ করে ফেলেন—একবারও আপত্তি জানান না।

কিন্তু এই রায় নিয়ে দেশজুড়ে শুরু হয় বিতর্ক। রাজপরিবারের আইনজীবীরা দ্রুত উচ্চ আদালতে আপিল করেন।

কলকাতা হাইকোর্টে মামলাটি যায় ১৯৩৫ সালে। সেখানে প্রশ্ন ওঠে—এত জটিল ব্যাকটেরিয়াল প্রমাণ, কতটা নির্ভরযোগ্য? কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়, এই ইনজেকশনেই মৃত্যু হয়েছে?

উচ্চ আদালত তখন নিম্ন আদালতের রায় আংশিক বদলে দেয়। বিচারপতি রায় ঘোষণায় বলেন—

“এই মামলায় গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ আছে। তবে সম্পূর্ণ নিশ্চিতভাবে ইনজেকশনই মৃত্যুর কারণ, তা নিঃসন্দেহে বলা কঠিন।”

অতএব, মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে ‘আজীবন দ্বীপান্তর’ করা হয়।

বিনয়েন্দ্র ও তারানাথ—দুজনকেই পাঠানো হয় আন্দামানের সেলুলার জেলে।

সেলুলার জেলের অন্ধকার কোঠায়, দুটি আলাদা ঘরে—দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত মানুষ।

একজন রাজপুত্র, যার শিরায় রক্তের সঙ্গে চলত ক্ষমতার মোহ।
অপরজন গবেষণা-আসক্ত, যুক্তি-ভিত্তিক মানুষ—যিনি ভালো ও মন্দের রেখাটি মুছে ফেলেছিলেন।

জেলের রেজিস্টারে লেখা আছে—বিনয়েন্দ্র বন্দী নম্বর ৬২৩, কোনো আত্মীয় কোনোদিন তাঁকে দেখতে আসেননি।
তারানাথ লিখতেন প্রতি রাতেই—একটি খাতায়, যার নাম ছিল “রোগ ও মন”। সেলুলার জেলের লাইব্রেরিতে সেই খাতা আজও রাখা আছে।

এই মামলার পর দেশের নানা পত্রিকায় একটাই প্রশ্ন উঠেছিল—

“বিজ্ঞান যখন খুনের হাতিয়ার হয়, তখন তার বিচারের রাস্তাটা কি সাধারণ আদালতের মধ্যেই সীমিত থাকা উচিত?”

কেউ বলেছিলেন—এই মামলায় ন্যায় হয়েছে
আবার কেউ বলেছিলেন—প্রমাণ দুর্বল ছিল, রায় ছিল রাজনৈতিক।

তবে একটি জিনিস নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিল না—
প্লেগ, চশমার ফ্রেমে টিটেনাস, ইনজেকশনের সূচ—সবই এক ঠান্ডা মাথার ভাইয়ের ঘৃণার প্রতীক হয়ে রয়ে গেছে।

অধ্যায় ৯: পরিণতির ছায়া

সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত বাংলা ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।

সমাপ্তির আগমুহূর্তে এসে এই গল্প আর নিছক একটি খুনের রহস্য নয়—এটি হয়ে ওঠে মনুষ্যত্বের পতনের, ক্ষমতার নেশায় অন্ধ হয়ে যাওয়া আত্মার, আর এক নিষ্ঠুর বিজ্ঞানের হাত ধরে ইতিহাসে গেঁথে যাওয়া এক অভিশপ্ত ভাই-হত্যার মহাকাব্য

রাজবাড়ির অন্দরমহল থেকে শুরু হওয়া ষড়যন্ত্র, এক ভাইয়ের মৃত্যুর স্টেশন, ব্যাকটেরিয়ার ছায়ায় নির্মিত হত্যার ফাঁদ, আদালতের কাঠগড়া পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছায় শেষ অধ্যায়ে—পরিণতির ছায়া।

১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীনতা লাভ করে, তৎকালীন সরকার একটি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বহু রাজবন্দি ও দ্বীপান্তরিত কয়েদির জন্য। এই তালিকায় নাম ছিল বিনয়েন্দ্র নারায়ণ এবং তারানাথ ভট্টাচার্য—দুজনেই প্রায় ১৩ বছর ধরে আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দি।

একদিনের সকালে, বৃষ্টিস্নাত বন্দরঘাটে পা রাখলেন বিনয়েন্দ্র—চুল পাকা, চোখ গাঢ়, মুখে জিজ্ঞাসা ও আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব।

কিন্তু এই ফিরে আসা কোনো বিজয়ীর প্রত্যাবর্তন নয়। রাজ্য নয়, রাজত্ব নয়—তিনি ফিরে পেলেন কেবল এক ভগ্ন রাজপ্রাসাদ, আর স্মৃতি-বোঝাই নিঃসঙ্গতা

পাকুড়ে সেই রাজবাড়ি, যেখানে ষড়যন্ত্রের বীজ বোনা হয়েছিল—সেই রাজপ্রাসাদ তখন ধ্বংসের পথে। অমরেন্দ্রর মৃত্যুর পর তার পরিবারের লোকেরা আলাদা জায়গায় সরে গিয়েছেন। জমি বিক্রি হয়েছে, খনির অধিকার গেছে সরকারের হাতে।

বিনয়েন্দ্র এসে দাঁড়ালেন সেই পুরনো পাথরের চাতালে—যেখানে একসময় তিনি খেলতেন, দালান ধরে দৌড়াতেন, আর যেখানে প্রথম জন্ম নিয়েছিল ঈর্ষার বিষ।

প্রথম ক’দিন গ্রামের লোকজন তাকে দেখতে ভিড় করত—“খুনি রাজা ফিরেছেন!”—এই কৌতূহলেই। তারপর একদিন সকলেই চলে গেল।

আর যেটা রয়ে গেল, তা হল—এক নিঃসঙ্গ রাজা, নিজের রাজ্যহীন মনের গভীরে বন্দি।

বিনয়েন্দ্রর মধ্যে ধীরে ধীরে দেখা দেয় মানসিক বিকার। রাজবাড়ির ভগ্ন কক্ষে একা বসে তিনি রাতভর কথা বলতেন—অমরেন্দ্রর সঙ্গে, তারানাথের সঙ্গে, এমনকি প্লেগের ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গেও।

স্থানীয়রা বলতেন—“তিনি পাগল হয়ে গেছেন।”

কেউ বলতেন, পাপের ভার নিয়ে ফিরে আসা যায় না। রাজা ফিরলেও মন আর ফিরল না।

একদিন এক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে—বিনয়েন্দ্র, যিনি নিজের ঘরে আগ্নেয়াস্ত্র জমা করে রেখেছিলেন, হঠাৎ করেই পরিবারের এক সদস্যের উপর বন্দুক তুলে ধরেন।

চিৎকার, কান্না, আতঙ্ক—রাজবাড়ি আবার রক্তের গন্ধে জেগে ওঠে।

স্থানীয় প্রশাসন খবর পেয়ে পাকুড় রাজবাড়িতে পৌঁছায়। পুলিশের একজন কর্মকর্তা কাকডাকা ভোরে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন—
“বিনয়েন্দ্র বাবু, অনুগ্রহ করে অস্ত্র নামিয়ে আসুন।”

কিন্তু জবাব আসে না।

হঠাৎ, একটি গুলির শব্দ—তারপর আরও দুইটি।
পুলিশ বাধ্য হয়ে গুলি চালায়।

রাজপ্রাসাদের এক কোণে লুটিয়ে পড়ে এক সময়ের যুবরাজ, যিনি নিজের রক্তের ভাইকে বৈজ্ঞানিক হত্যার মাধ্যমে মুছে ফেলেছিলেন—এবার নিজেই হারিয়ে গেলেন আইনের গুলিতে

বিনয়েন্দ্রের মৃত্যু কোনো রাজকীয় অন্ত্যেষ্টি নয়—তাকে দাহ করা হয় স্থানীয় শ্মশানে, রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মান ছাড়াই। সেই মৃত্যু যেন এক অভিশপ্ত পরিণতির সিলমোহর।

আর তারানাথ ভট্টাচার্য?
তার গল্প আর তত স্পষ্ট নয়।

কেউ বলেন, আন্দামান থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে তিনি কলকাতায় ফিরে মানসিক ভারসাম্য হারান।
কেউ বলেন—তিনি সন্ন্যাস নেন, হিমালয়ের কোনো গ্রামে আত্মগোপন করেন।
আরও কেউ বলেন—তিনি প্লেগের ব্যবহার নিয়ে গোপনে বই লেখেন, যা পরে ধ্বংস করা হয়।

কিন্তু বাস্তব?
তারানাথ ভট্টাচার্য হয়ে যান—এক বিজ্ঞানীর ছায়া, যিনি অন্ধকারে মিলিয়ে যান।

কোনো মৃত্যু নেই, কোনো কবর নেই—শুধু ইতিহাসের ফাঁকে ফাঁকে তাঁর নামে কানাকানি।

এই হত্যাকাণ্ড কেবল এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা নয়—এটি ভারতের ইতিহাসে প্রথম বায়োলজিক্যাল কিলিং, যেখানে বিজ্ঞান হয় অস্ত্র, পরিবার হয় শত্রু, রাজত্ব হয় অভিশাপ।

এরপর বহু দশক কেটে গেছে।
পাকুড়ের সেই রাজবাড়ি আজ ভেঙে পড়েছে।
যেখানে প্লেগ-ইনজেকশন প্রস্তুত হয়েছিল, সেই হাফকিন ইনস্টিটিউটে আজ গবেষণা চলছে নতুন রোগ প্রতিরোধে।

কিন্তু ইতিহাসের পাতায়, যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন—
সেখানে এক অধ্যায় লেখা আছে রক্ত ও ব্যাকটেরিয়ার অদ্ভুত জোটে।

অমরেন্দ্র আজ নেই, তার চোখে ছুঁইয়ে দেওয়া সেই বিষাক্ত সূচও নেই।
বিনয়েন্দ্র নেই, তার গর্জন করা ক্ষমতার নেশাও আজ নিরব।
তারানাথ নেই, তার কলমে বিজ্ঞান নয়, শুধু ইতিহাসের দাগ।

কিন্তু রয়ে গেছে গল্প—
এক অভিজাত পরিবার, যেখানে পিতার মৃত্যুর পর ভাইয়েরা যুদ্ধ শুরু করে,
যেখানে চশমা হয়ে ওঠে মৃত্যুর উপহার,
স্টেশন হয়ে ওঠে খুনের মঞ্চ,
আর বিজ্ঞান হয়ে ওঠে কসাইয়ের ছুরি।

এই গল্প আজও বলে যায়—

ক্ষমতা যখন ভালোবাসাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন ইতিহাসে শুধু রক্তের ছাপই থেকে যায়।

এই রকম মনমুগ্ধকর অডিও স্টোরির সহযোগে বাংলা ছোট গল্প -এর আপডেট পেতে আমাদের WhatsApp চ্যানেল জয়েন করুন।

আমরা কারা

নতুন বাংলা ছোট গল্প

বরফ-হাঁসের উপহার

বরফের দেশে মিশা ও তার বন্ধুদের সাহসী অভিযানে উপহার উদ্ধারের জাদুকরী কাহিনি। ছোটদের গল্প ও রূপকথার গল্প ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও উৎসবের আনন্দে ভরপুর।

বরফের দেশে মিশা ও তার বন্ধুদের সাহসী অভিযানে উপহার উদ্ধারের জাদুকরী কাহিনি। ছোটদের গল্প ও রূপকথার গল্প ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও উৎসবের আনন্দে ভরপুর।

সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়ুন: বরফ-হাঁসের উপহার

জীবাণু দিয়ে হত্যা

সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত এক রহস্যময় বাংলা ছোট গল্প—বিষাক্ত সূচে যুবরাজের মৃত্যু, ভাইয়ের ষড়যন্ত্র, আর এক বিজ্ঞানভিত্তিক খুনের ইতিহাস যা আপনাকে শিহরিত করে তুলবে।

সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত এক রহস্যময় বাংলা ছোট গল্প—বিষাক্ত সূচে যুবরাজের মৃত্যু, ভাইয়ের ষড়যন্ত্র, আর এক বিজ্ঞানভিত্তিক খুনের ইতিহাস যা আপনাকে শিহরিত করে তুলবে।

সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়ুন: জীবাণু দিয়ে হত্যা

অদম্য মায়া

অদম্য সাহস ও আত্মবিশ্বাসের অনুপ্রেরণায় ভরা একটি মোটিভেশনাল বাংলা ছোট গল্প—যেখানে হার মানে না জীবনের ঢেউ, বরং জাগে নতুন করে বাঁচার সাহস ও স্বপ্ন।

অদম্য সাহস ও আত্মবিশ্বাসের অনুপ্রেরণায় ভরা একটি মোটিভেশনাল বাংলা ছোট গল্প—যেখানে হার মানে না জীবনের ঢেউ, বরং জাগে নতুন করে বাঁচার সাহস ও স্বপ্ন।

সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়ুন: অদম্য মায়া

Leave a Comment

অনুলিপি নিষিদ্ধ!

🔔 সাবস্ক্রাইব করুন! রিয়েল টাইমে মন্ত্রমুগ্ধকর অডিও স্টোরি সহযোগে নতুন নতুন বাংলা ছোট গল্পের আপডেট পেতে এখনই সাবস্ক্রাইব করুন! সাবস্ক্রাইব
অন্ধকার থেকে আলো – অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প শেষ ঠিকানা – রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প আবছা পা – ভুতের বাংলা ছোট গল্প সোনালি পালক – ছোটদের রূপকথার গল্প প্রেমের পথচলা – বাংলা রোমান্টিক ছোট গল্প