লন্ডনের আকাশটা ধূসর মেঘে ঢাকা। ঠান্ডা বাতাস কাঁপিয়ে যাচ্ছে শিউরে শিউরে। বছরখানেক আগেও তো এমন ছিল না। তখন রোদের ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যেত, আর গরম বাতাসে ঘেমে যেত শরীর। কিন্তু এই যুদ্ধের কালো ছায়া সবকিছু বদলে দিয়েছে। ১৯৪০ সাল। জার্মানি দখল করে ফেলেছে বেলজিয়াম সহ আরও কয়েকটা দেশ। হাজার হাজার মানুষ হারিয়ে ঘরছাড়া হয়ে পালিয়ে এসেছে ইংল্যান্ডে। তাদের মধ্যে একজন হলেন শিপ্রা দাস।
শিপ্রা ছিলেন বেলজিয়ামের একটি ছোট্ট শহরে ট্রাম চালানোর এক মাসি। যুদ্ধের থাবা পড়তেই সবকিছু উল্টে-পাল্টে হয়ে গেল। বোমার আওয়াজ, চারপাশে চিৎকার, আর ছোট্ট শহরটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া – শিপ্রা সবকিছুই চোখের সামনে দেখেছেন। প্রাণ বাঁচাতে জাহাজে করে পালিয়ে এসেছেন লন্ডনে। কিন্তু লন্ডনে এসেও শান্তি মেলেনি। শরণার্থী হিসেবে তাঁকে নানা রকম ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। খাবারের জোগাড়, থাকার জায়গা – সবকিছুই অনিশ্চিত।
যেনকেনভাবে একটা ছোট্ট আস্তানা জোগাড় করলেন শিপ্রা। লন্ডনের বাইরে একটা গ্রামে থাকতে লাগলেন একটা বৃদ্ধ দম্পতির সঙ্গে। কিন্তু ঘরে বসে থাকতে পারবেন না তিনি। কাজ খুঁজতে লাগলেন। একদিন একটা খবর পেলেন – লন্ডনের বাসগুলোতে নারী কন্ডাক্টর নেওয়া হচ্ছে। খুশিতে উল্লম্ব হয়ে গেলেন শিপ্রা। ট্রাম চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। নিশ্চয়ই পাবে কাজটা।
খুব কষ্ট করে সাক্ষাৎ পেলেন। এক কড়া মুখের ইংরেজ ভদ্রলোক তাঁর সাক্ষাৎ নিলেন। ইংরেজি খুব একটা জানতেন না শিপ্রা। কিন্তু ট্রাম চালানোর ইশারায় কিছু বোঝাতে পারলেন। ভদ্রলোক একটু চিন্তা করে বললেন, “ঠিক আছে। এক সপ্তাহের ট্রায়াল দিয়ে দেখুন।”
খুব মন দিয়ে কাজ করলেন শিপ্রা। ইংরেজি না জানলেও রাস্তা চিনতে পারতেন মানুষের হাতের ইশারায়। টিকিট দেওয়া, বাস থামানো – সবকিছু ম্যানেজ করলেন দক্ষতার সঙ্গে। সপ্তাহ শেষে শিপ্রার কাজটা পাকাপাকি হয়ে গেল। একটা নতুন জীবন শুরুর আশা জাগল।
কিন্তু সেই আশা বেশিদিন টেকেনি। দুই মাস পরে একদিন সকালে বাস ডিপোতে গিয়ে দেখেন একদল লোক জড়ো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ইউনিফর্ম পরা। কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলেন শিপ্রা, “কী ব্যাপার?”
একজন উত্তর দিলেন, “সৈন্যরা ফিরছেন। তাদেরই এখন থেকে বাস চালাবেন।”
শিপ্রার পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে যাওয়ার মতো লাগল। কী যে বলবেন ভাষা আসছে না। কয়েক মিনিট পরে এক যুবক এসে দাঁড়ালেন তাঁর সামনে। বয়স খুব বেশি নয়, কিন্তু চোখে একটা ক্লান্তির ছাপ।
“আপনি কি শিপ্রা দাস?” জিজ্ঞাসা করলেন যুবকটি।
শিপ্রা মাথা নীচু করে বললেন, “হ্যাঁ।”
“আমি ডেভিড।” যুবকটি নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, “আমি এখন থেকে এই বাসটা চালাব।”
শিপ্রা চুপ করে থাকলেন। মনের মধ্যে জ্বালা আর হতাশা দুটো ঝড়ের মতো উথাল-পাথাল করছিল। এত কষ্টে পাওয়া কাজটা হারানোর এই ব্যাথা, বোঝাতে পারা যায় না। কিন্তু যুদ্ধের এই নিষ্ঠুর খেলায় কারো কিছুই করার নেই।
ডেভিড একটু দ্বিধার পরে বললেন, “আপনার অসুবিধা হচ্ছে বুঝতে পারছি। কিন্তু যুদ্ধের পরে অনেক সৈন্য বেকার হয়ে পড়েছে। তাদেরই আবার কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে সরকার।”
শিপ্রা জানতেন এটাই স্বাভাবিক। যুদ্ধের জন্য দেশের ছেলেরা জীবন দিয়েছে, ফিরে এসেছে অসুস্থ হয়ে। তাদেরই আগে কাজ দেওয়াটা ঠিকই। কিন্তু নিজের এই অসহায় অবস্থাটাও তো কম যন্ত্রণার না।
একটু থেমে শিপ্রা বললেন, “আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি কী করব?”
ডেভid একটু চিন্তা করে বললেন, “আপনি যদি চান, তাহলে আমার সঙ্গে ট্রেনে টিকিট দেওয়ার কাজটা করতে পারেন।”
শিপ্রার মুখে একটু আশা ফুটে উঠল। টিকিট দেওয়ার কাজটা তিনি জানেন। তাছাড়া, ডেভিডের সঙ্গে কাজ করলে একটু ইংরেজিও শিখতে পারবেন, সেটা ভাবলেন তিনি।
“ঠিক আছে, আমি রাজি।” সম্মতি জানালেন শিপ্রা।
এভাবেই শুরু হল শিপ্রা আর ডেভিডের এক অদ্ভুত সম্পর্ক। দু’জনই যুদ্ধের বিধ্বস্ততা নিয়ে এসেছিল লন্ডনে। শিপ্রা হারিয়েছিল নিজের দেশ, নিজের কাজ। আর ডেভিড ফিরে এসেছিল যুদ্ধের ভয়ঙ্কর স্মৃতি নিয়ে। কাজের সূত্রে দু’জনের দেখা হলেও, তাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের বীজ জন্ম নিল।
ডেভিড ইংরেজি শেখালেন শিপ্রাকে। আর শিপ্রা তাঁকে বললেন বেলজিয়ামের গল্প, সেখানকার রাস্তাঘাট, খাবারদাবার – সবকিছু। দু’জনেই যেন একে অপরের অতীতের সুখস্মৃতির সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিলেন এই বিদেশী শহরে। কিন্তু অতীতের স্মৃতি যেমন তাদের মধ্যে একটা আন্তরিকতা গড়ে দিয়েছিল, তেমনি যুদ্ধের ক্ষতও মাঝে মাঝে মাথা চাড়া দিত। ডেভিডের চোখে কখনো কখনো দেখা যেত যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়ঙ্কর দৃশ্যের ছায়া। আর শিপ্রার মনে ভেসে উঠতো বোমাবর্ষণের রাত্রি, ছোট্ট শহরটির ধ্বংসাবশেষ।
একদিন কাজের ফাঁকে ডেভিড শিপ্রাকে বললেন, “এই শহরে একটা বেলজিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে। চলো, একদিন সেখানে যাই।”
শিপ্রার চোখ জ্বলে উঠল। নিজের দেশের খাবারের কথা শুনে কার না মন খারাপ হয়? দু’জনে ছুটির দিনে গেলেন সেই রেস্টুরেন্টে। ঢুকেই শিপ্রার চোখ ভিজে এল। চারপাশে বেলজিয়ামের ছবি, পরিচিত সুরের গান – মনে হলো যেন নিজের দেশেই ফিরে এসেছে সে।
খাবারের টেবিলে বসে শিপ্রা ডেভিডকে বললেন, “এই গন্ধ, এই স্বাদ… কতদিন পর!”
ডেভিড তাঁর হাত চেপে ধরে বললেন, “আমরা নিশ্চয়ই ফিরব। যুদ্ধ শেষ হলে আমরা ফিরব নিজেদের দেশে।”
শিপ্রা একটু হাসলেন, “কবে যে সেদিন আসবে…”
ডেভিড চুপ করে রইলেন। ভবিষ্যত অনিশ্চিত ছিল। কিন্তু এই বিদেশী শহরে দু’জন অপরিচিত মানুষের মধ্যে যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, তা তাদেরকে আশা জোগাতো। যুদ্ধের এই অন্ধকারে একটা আলোর কিরণের মতো
…জ্বলে উঠল সেই বন্ধুত্ব। দিন যত গড়াতো, শিপ্রা আর ডেভিডের বন্ধুত্ব ততই গভীর হতে থাকল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তারা একে অপরের সাথে কথা বলত। যুদ্ধের গল্প, নিজেদের দেশের স্মৃতি, আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন – সবকিছুই ভাগ করে নিত।
একদিন শিপ্রা ডেভিডকে বললেন, “আমি একটা চিঠি লিখতে চাই, কিন্তু ইংরেজি জানি না বলে লিখতে পারছি না।”
ডেভিড জানতে চাইলেন, “কেমন চিঠি?”
“মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার মা হয়তো বেঁচে আছে।” বললেন শিপ্রা, “যুদ্ধের সময় আমরা আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু জানি না, সে কোথায় আছে, বেঁচে আছে কিনা।”
ডেভিডের চোখে সহানুভূতি ফুটে উঠল। তিনি বললেন, “চিঠি লিখতে আমি আপনাকে সাহায্য করব।”
শিপ্রা তাঁর মায়ের কথা, যুদ্ধের সময় হারিয়ে যাওয়ার গল্প – সবকিছুই ডেভিডকে বললেন। ডেভিড মন দিয়ে শুনলেন, তারপর ইংরেজিতে চিঠি লিখে ফেললেন।
চিঠিটা ঠিকানা দিতে পারলেন না শিপ্রা। তবে আশা ছিল, হয়তো কোনো না কোনোভাবে তাঁর মায়ের কাছে পৌঁছে যাবে এই চিঠি।
এর মধ্যে ইউরোপের যুদ্ধের মোড় ঘুরতে শুরু করল। মিত্রপক্ষেরা জার্মানির বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে লাগল। লন্ডনের আকাশেও যুদ্ধের বিমান আর দেখা যাচ্ছিল না। শান্তির আশা জাগল সবার মনে।
একদিন ডেভিড খুশির খবর নিয়ে এলেন। “যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, শিপ্রা!”
শিপ্রার চোখে আনন্দাশ্রু জমে উঠল। এতদিনের অপেক্ষা, এতদিনের দুঃখের পরে মুক্তির আশ্বাস।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগল। শিপ্রা জানতে পারলেন, বেলজিয়ামে ফিরে যাওয়ার জন্য সরকার কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। তিনিও ফিরে যাওয়ার আবেদন জানালেন।
দিন যত এগিয়ে এল, বিচ্ছেদের বেদনাও বাড়তে লাগল। ডেভিডের সঙ্গে এতদিনের সম্পর্ক, লন্ডনের এই বিদেশী শহরে একে অপরের মানুষ হয়ে ওঠা – সবকিছুই ছেড়ে যেতে হবে ভাবতেই মন খারাপ হচ্ছিল শিপ্রার।
বিদায়ের দিন এল। বন্দরে দাঁড়িয়ে শিপ্রা ডেভিডকে জড়িয়ে ধরলেন। দু’জনের চোখেই জল।
“আমি ফিরব,” শিপ্রা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “যুদ্ধ শেষ হলে নিশ্চয়ই ফিরব।”
ডেভিড তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললেন, “আমি অপেক্ষা করব।”
জাহাজটা যখন দূরে সরে যেতে লাগল, শিপ্রা দেখলেন ডেভিড একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। হাত নাড়িয়ে তিনি শেষবারের মতো বিদায় জানালেন। লন্ডনের মেঘলা আকাশটা যেন তাঁর মনের মতোই কালো হয়ে উঠেছিল।
দীর্ঘ সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে শেষমেশ শিপ্রা নিজের দেশের মাটিতে পা দিলেন। বেলজিয়ামের চেনা গন্ধ, পরিচিত রাস্তাঘাট – সবকিছুই তাঁকে অভিভূত করল। কিন্তু চারপাশে যুদ্ধের ধ্বংসের ছাপ। নিজের শহরে ফিরে দেখলেন, তাঁর বাড়িটাও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মনের মধ্যে একটা অসহ্য যন্ত্রণা জাগল।
কয়েকদিন খোঁজাখুঁজির পর খবর পেলেন তাঁর মা একটা আশ্রয় কেন্দ্রে আছেন। ছুটে গেলেন সেখানে। ভিড়ের মধ্যে এক মুখ খুঁজে পেলেন। চোখে জল এসে গেল। ছোটবেলার সেই সুস্থ, সবল মায়ের সঙ্গে এই ক্ষীণ, দুর্বল নারীটিকে মেলাতে কষ্ট হচ্ছিল।
মা-মেয়ের মিলন হলো। কান্নায় ভেজা এক আলিঙ্গনে মিশে গেল যুদ্ধের বিচ্ছেদের বেদনা।
এরপর শুরু হলো নতুন এক সংগ্রাম। ধ্বংসস্তূপ থেকে নিজের জীবন গড়ে তোলার লড়াই। শিপ্রা দমে যাননি। ধীরে ধীরে বাড়িটা আবার ঠিক করলেন। মা ও নিজের জন্য রোজগারের চিন্তা করতে লাগলেন।
একদিন কাজের ফিরে বাড়ি ঢোকার মুখে দেখলেন ডাক এসেছে। চিঠিটা খুলে পড়তেই চোখ দিয়ে অঝোরে জল চলতে লাগল। চিঠিটা ছিল ডেভিডের।
চিঠিতে লিখেছিল, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সেও বেলজিয়াম ফিরে এসেছে। নিজের শহরে ফিরে শিপ্রার ঠিকানা খুঁজে পেতে পারেনি। কিন্তু সে আশা ছাড়েনি। শেষমেশ তাঁর লেখা চিঠিটা কোনোভাবেই একটা সংবাদপত্রে ছাপা হয়। সেই চিঠিই পড়ে শিপ্রার ঠিকানা জানতে পারে সে।
চিঠিতে ডেভিড লিখেছিল, সে শিপ্রাকে দেখতে আসবে। শিপ্রা চিঠিটা বুকে চেপে ধরলেন। যুদ্ধের ঝড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দু’টি মানুষের, দু’টি জীবনের পুনর্মিলনের আশায় আকাশটা যেন একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল। লন্ডনের মেঘলা দিনগুলোর স্মৃতি মিশে নতুন এক সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলেন শিপ্রা।