কলকাতার ঝাঁ চকচকে রাতে, আকাশ জুড়ে তারার ঝলমলে আলপনা, আর তার নীচে, বিশাল জাদুঘরটা নিঃশব্দ নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকারে নিমজ্জমান। ভিতরে, একমাত্র আলোর রেখাটা ছিল অপূর্ব সেনের হাতের টর্চের আলো। রাতের শিফটে তিনিই ছিলেন জাদুঘরের একমাত্র প্রহরী, প্রতি রাতে এই বিশাল জায়গাটা পরিষ্কার করার দায়িত্ব তার। একঘেয়ে এই কাজে আজ আর একঘণ্টা কাটিয়ে দিয়ে, একটু বিশ্রাম নিতে অপূর্ব জ্যামিতিক আকারের প্রাচীন মমিটের কাছে এসে দাঁড়ালেন।
শীতল পাথরে হেলান দিয়ে একটু চোখ বুজে নিলেন তিনি। মনের মধ্যে ভেসে উঠল আজকের দিনের ঘটনা। সকালে জাদুঘরে ঢোকার সময়, প্রবেশদ্বারের কাছে দেখেছিলেন এক টিনেজার ছেলে, মুখে অবাক চাউনি। ছেলেটির হাতে একটি ছোট্ট, অদ্ভুত আকৃতির পাথর ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল কোনো মহাকাশযানের অংশ। অপূর্ব ছেলেটিকে জাদুঘরের নিয়ম মেনে পাথরটি জমা দিতে বলেছিলেন, কিন্তু ছেলেটি জোর দিয়েছিল এটা তার পরিবারের প্রতীক, দাদু এনেছিলেন অনেক দূর থেকে। অনেক কথাকাটাকা ও ছেলেটির চোখের জল দেখে অপূর্ব একটু নরম হয়ে গিয়েছিলেন। ছেলেটটির কাছ থেকে পাথরটি নেয়ার পরিবর্তে, জাদুঘরের ইতিহাস সম্পর্কে একটা বই উপহার দিয়েছিলেন।
টর্চের আলোয় ফিরে এলেন বর্তমানে। হঠাৎ, পাশেই থাকা প্রাচীন ঘড়ির কাচের আবরণটা কাঁপতে শুরু করল। অপূর্ব চমকে উঠে টর্চ জ্বালিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালেন। কাঁটা দুটো ঠিক আগের জায়গাতেই ছিল, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কাঁচের আবরণটা এখনো কাপছিল। ঘরটা নিঃশব্দ, কোনো বাতাস নেই। তাহলে কীভাবে? মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি বাসা বাঁধতে শুরু করল।
এই ঘটনার দু’দিন পরে, রাতের শিফটে অপূর্ব আবার সেই টিনেজার ছেলেটিকে দেখলেন। ছেলেটি এবারও একই পাথর নিয়ে এসেছিল। কিন্তু, আজ অপূর্ব আর নরম হলেন না। জাদুঘরের নিরাপত্তার কথা বলে জোর করে ছেলেটির কাছ থেকে পাথরটা নিয়ে নিলেন।
পাথরটা হাতে নিতে এক অদ্ভুত ঠান্ডা অনুভব করলেন অপূর্ব। আর সেই মুহূর্তেই, জাদুঘরের আলো নিভে গেল। চারপাশে অন্ধকার। অপূর্ব টর্চ জ্বালাতে গেলেন, কিন্তু টর্চও জ্বলে না। চারপাশে হাতড়াতে থাকলেন তিনি, কিন্তু আর কিছু দেখতে পেলেন না। হঠাৎ, পাথরের দিক থেকে একটা মৃদু আলো বের হতে শুরু করল। আলোটা বাড়তে বাড়তে একটা বড় গোলকের আকার ধারণ করল, ঠিক যেন একটা আকাশকুসুম। অপূর্ব পাথরটা ফেলে দিতে চাইলেন, কিন্তু হাত যেন জড়িয়ে গেছে। আলোর গোলকটা আরো বড় হতে লাগল, ঘিরে ফেলল তাকে। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন অপূর্ব, মৃত্যুর আশঙ্কা তার বুকে জমাট বাঁধছে।
কিন্তু মৃত্যু এল না। কিছুক্ষণ পরে আলো কমতে শুরু করল। চোখ খুললেন অপূর্ব। তিনি আর জাদুঘরে ছিলেন না। তার চারপাশে ছিল এক অপরূপ দৃশ্য। বিশাল গাছগুলো ঝলমলে সবু পাতায় ছেয়ে আছে, আকাশে দুটো সূর্য একসাথে জ্বলজ্বল করছে। পাশেই দেখলেন সেই টিনেজার ছেলেটিকে।
ছেলেটি হাসল, “আপনাকে স্বাগত জানাই নিঃসীমের দ্বারে!”
“এটা কোথায়?” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন অপূর্ব।
“এটা মহাবিশ্বের অন্য কোনো এক কোণ,” ছেলেটি উত্তর দিল, “এই পাথরটা একটা টেলিপোর্টেশন ডিভাইস। আমার পরিবার এই গ্রহের অধিবাসী।”
ছেলেটি নিজেকে পরিচয় দিল, নাম তার অভিযান। সে জানালো, তারা পৃথিবীর কাছাকাছি থাকা এই গ্রহটিতে বাস করে, কিন্তু তাদের সভ্যতা অনেক এগিয়ে। পৃথিবী সম্পর্কে জানতে তারা গবেষণা করছিল, তখনই অভিযানের দাদু এই পাথরটি পৃথিবী থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু পাথরটির কাজ বুঝতে না পেরে, তারা এটি পৃথিবীতে ফেরত দিতে চেয়েছিল।
অপূর্ব অভিযানের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। তার মাথার মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু কথা বলার আগেই অভিযান তাকে হাত ধরে নিয়ে গেল একটা বিশাল স্বচ্ছ গম্বুজের নিচে। তার ভিতরে কয়েকজন মানুষ, যাদের চেহারা অনেকটা মানুষের মতোই, কিন্তু তাদের চোখগুলো ছিল সোনালি।
অভিযান তাদের পরিচয় করিয়ে দিল। তারা হলেন এই গ্রহের প্রধান বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা অপূর্বকে সাদরে বরণ করলেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলেন। অপূর্ব যা জানেন, তা তিনি তাদের ব্যাখ্যা করলেন। কিন্তু সবচেয়ে চমকে লাগলেন, যখন বিজ্ঞানীরা জানালেন, তারা পৃথিবীর পরিবেশের অবনতির বিষয়ে উদ্বিগ্ন।
কয়েকদিন অভিযানের গ্রহে কাটিয়ে অপূর্ব অনেক কিছু শিখলেন। সেখানকার উন্নত প্রযুক্তি তাকে মুগ্ধ করে দিল। কিন্তু তার মন কেবল পৃথিবীতেই ছিল। স্বপ্নের মতো জীবন কাটালেও, রাতে তারার আকাশের নিচে একা একা বসে, কলকাতার ঝাঁ চকচকে রাতের কথা ভাবতেন। একদিন অভিযানকে তার ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে জানালেন।
অভিযান একটু চিন্তিত হল, “আপনি কি জানেন ফিরে যাবার পর আপনি আবার সেই একই জায়গায়, সেই একই সময়ে ফিরতে পারবেন না? সময়ের ধারা হয়তো অনেকটা এগিয়ে গিয়ে থাকতে পারে।”
অপূর্ব চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, বন্ধুবান, পরিচিত জীবন – সবকিছুই কি আর পুরনো থাকবে? কিন্তু পৃথিবী, তার নিজের গ্রহ, তার দায়িত্ব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপূর্ব জানালেন, “যা-ই হোক, আমাকে ফিরে যেতে হবে।”
অভিযান তার সিদ্ধান্তের সম্মান জানালো। বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষায় কিভাবে সাহায্য করতে পারে, সে বিষয়ে অপূর্বকে কিছু তথ্য দিলেন। তারপরে, সেই অদ্ভুত পাথরটি আবার সক্রিয় হল। আলোর ঝলকানির মাঝে অপূর্ব চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালেন।
চোখ খুলতেই, আবার সেই পরিচিত জাদুঘরের অন্ধকার। টর্চ জ্বালিয়ে দেখলেন, পাশেই প্রাচীন ঘড়িটা আগের মতোই ঝুলছে। কিন্তু ঘড়ির কাঁচের আবরণটা এখনো কাঁপছিল। অপূর্ব জানতেন, এই কাঁপা এখন তারই অন্তরের কাঁপার সাথে মিশে আছে।
অপূর্ব জাদুঘরের বাইরে এসে দেখলেন, সকাল হয়ে গেছে। রাস্তায় মানুষের চালাচল শুরু হয়েছে। কিন্তু তার চোখে পড়ল না সেই ঝাঁ চকচকে আলো, সেই চেনা কলকাতা। সবকিছুই একটু অন্যরকম মনে হল।
জাদুঘরের কাছের চায়ের দোকানটাও বন্ধ। জিজ্ঞাসা করায় জানতে পারলেন, সেই দোকানটা দশ বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। অপূর্বের মাথা ঘুরে গেল। সেই কিশোর ছেলেটির কথা, অভিযানের গ্রহ, সবকিছুই কি স্বপ্ন ছিল?
না, তার হাতে টিনের ঠান্ডা অনুভূতি, আর পকেটে থাকা বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য বলছিল, এ স্বপ্ন নয়, বাস্তব। কিন্তু এই দশ বছর কীভাবে কেটে গেল?
অপূর্ব জানতেন, ফিরে আসার মূল্যটা তাকে দিতে হয়েছে। হয়তো সে তার পরিবার, বন্ধুদের হারিয়েছেন, কিন্তু তার অভিজ্ঞতা তাকে পৃথিবীর জন্যে কিছু করার দায়িত্ব দিয়েছে। পকেট থেকে তথ্য নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন অপূর্ব। এখন তাকে পরিবেশ রক্ষার লড়াইয়ে নামতে হবে, এক নতুন পৃথিবীতে, এক নতুন যুগে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে অপূর্ব কাজ চলল তথ্য নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে। বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য ছিল অত্যাধুনিক, কিন্তু পৃথিবীর বর্তমান প্রযুক্তিতে এগুলো বাস্তবায়িত করা কঠিন ব্যাপার। হাল না ছেড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের সাথে যোগাযোগ করলেন তিনি। প্রথমে সবাই তাঁর কথা অবিশ্বাস করলেও, অপূর্বের আন্তরিকতা আর নেওয়া তথ্যের গভীরতা তাদের মন জয় করল। ধীরে ধীরে গড়ে উঠল এক বিশাল গবেষণা দল।
বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রমে অপূর্ব আর গবেষণা দলের সদস্যরা কিছু কিছু প্রযুক্তি বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হলেন। তার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছিল বাতাস থেকে জল সংগ্রহের নতুন পদ্ধতি এবং নতুন প্রজন্মের সৌর কোষ যা আগের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর। ধীরে ধীরে পৃথিবীর পরিবেশের অবনতির হার কমতে শুরু করল।
এই সাফল্যের পিছনে অপূর্বের অবদান সবারই স্বীকৃত। তিনি আর জাদুঘরের সেই অজানা প্রহরী নন, এখন তিনি পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষার একজন পথিকৃৎ। কিন্তু তার মনের কোণে একটা অসুখ থাকলই। দশ বছরে তার পরিবার, বন্ধুরা কোথায়? একদিন গবেষণা চলাকালীন হঠাৎ করেই খবর পেলেন একটি পুরনো সময়ক্যাপসুল উদ্ধার হয়েছে। সময়ক্যাপসুলটি দশ বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল।
অপূর্ব উত্তেজিত হয়ে সেই সময়ক্যাপসুল খুললেন। ভিতরে পেলেন একটি ভিডিও রেকর্ডিং। রেকর্ডিংয়ে দেখলেন তার স্ত্রীকে, ছেলেমেয়েকে। তারা জানালেন, অপূর্ব নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর কতটা কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু তারা জানতেন, অপূর্ব নিশ্চয়ই কোনো ভালো কাজেই নিযুক্ত আছেন। তারা অপূর্বের ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন।
ভিডিও শেষ হতেই অপূর্বের চোখে জল এসে গেল। দশ বছর পরে হলেও তার পরিবারের কথা শুনতে পেরে তিনি অভিভূত। তিনি জানতেন, হয়তো আর তিনি তার পুরনো জীবনে ফিরতে পারবেন না, কিন্তু নতুন পৃথিবীতে নতুন পরিবার তৈরি করবেন – গবেষণা দলের সদস্যদের, আর এই সবু পৃথিবীর।
নিঃসীমের দ্বার খুলে গিয়েছিল অপূর্বের জন্য, কিন্তু সেই দ্বারে ঢুকেই তিনি আরো অনেক দ্বার খুলে ফেললেন – পৃথিবীকে বাঁচানোর দ্বার, নতুন জীবনের দ্বার। আর এই নতুন দায়িত্ব, নতুন স্বপ্ন নিয়েই এগিয়ে চললেন অপূর্ব, এক অজানা ভবিষ্যতের পথে।