অধ্যায় ১: নতুন আলোক রক্ষক
হাবড়া থেকে দীঘার দিকে চলতে চলতে শীতল বাতাসে আমার শরীর কেঁপে উঠছিল। রাতের আকাশ তারার আলোয় আলোকিত হলেও, চারপাশের কুয়াশা যেন এক রহস্যময় চাদরের মতো চারদিককে ঢেকে রেখেছিল। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে, আমি অনুভব করছিলাম এক অদ্ভুত টান, যা আমাকে এই নিঃসঙ্গ সমুদ্রতীরের দিকে নিয়ে আসছিল। দীঘার সমুদ্র বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছায়ামিনার—সাগর সন্ধ্যা—আমার চোখে ভেসে উঠছিল। ছোটবেলা থেকেই এই বাতিঘরের গল্প শুনেছি। লোকেরা বলত, সাগর সন্ধ্যা শুধু পথ দেখায় না, তার মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো এক গভীর অজানা রহস্য।
বাতিঘরের নতুন আলোক রক্ষক হিসেবে আমার প্রথম দায়িত্ব শুরু হলো এই জায়গায়। সন্ধ্যায় যখন আমি পৌঁছালাম, বাতিঘরের দিকে তাকিয়ে আমার শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী হয়ে উঠল। বিশাল, নীরব, অথচ বিরাট এক অনুভূতি নিয়ে সে যেন আমাকে চুপিসারে স্বাগত জানাচ্ছিল। বাতিঘরের কালো আকৃতি, ঘন কুয়াশার মধ্যে থেকে যেন এক দৈত্যের মতো উঁকি দিচ্ছিল।
আমি লোহার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলাম। সিঁড়ির ধাতব ধাতব শব্দ কানে এসে যেন একধরনের অস্বস্তি এনে দিচ্ছিল। প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে উপরের দিকে উঠছিলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করছিলাম একটা অদ্ভুত শীতলতার আভাস। মনে হচ্ছিল, বাতাসটা কেবল শীতল নয়, যেন কোনো এক অদৃশ্য উপস্থিতি আমাকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। দেওয়ালগুলোতে হাত ছুঁইয়ে আমি যেন একটা তীক্ষ্ণ কম্পন অনুভব করলাম। মনে হচ্ছিল, এই দেয়ালের মধ্যে লুকিয়ে আছে অতীতের কোনো গভীর রহস্য, যা আমাকে সজোরে তার দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে।
উপরে পৌঁছে ঘরে ঢুকে আমি থমকে গেলাম। ঘরের পরিবেশ ভারী, যেন বাতাসের ওজনটাই এখানে বেশি। দেওয়ালে টাঙানো পুরোনো ছবিগুলো আমাকে ক্রমাগত দেখছিল। কাঠের খোদাই করা অদ্ভুত চিহ্নগুলো দেখে আমার মনে হলো, এগুলো কোনো এক বিশেষ উদ্দেশ্যে খোদাই করা হয়েছে। জানালা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ঢেউগুলো যেন অস্বাভাবিক জোরে পাথরে আছড়ে পড়ছে। মনে হচ্ছিল, সমুদ্র নিজেই কোনো বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করছে।
রাতে আমার ঘুম এল না। কেবল সাগরের গর্জন কানে আসছিল, যেন সেটা কিছু বলতে চায়। বাতাসের স্রোত দরজা-জানালায় ধাক্কা দিচ্ছিল। আমি জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি, বাতিঘরের নিচের পাথরে একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে ভেবেছিলাম সেটা কোনো ভ্রম, হয়তো আলো-ছায়ার খেলা। কিন্তু ভালো করে তাকাতেই বুঝলাম, সেটি কিছুই নয়, বরং কারো উপস্থিতি।
ছায়াটা বেশ অস্পষ্ট, তবু তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সেই চোখে ছিল গভীর এক দৃষ্টি, যা আমার আত্মা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। কয়েক মুহূর্ত পরেই ছায়াটা ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল। আমার শরীর ঘামে ভিজে গেল, অথচ বাতাসটা শীতল ছিল। আমার মন বলছিল, এটা শুধুই মনের ভুল। কিন্তু হৃদয়ের কোথাও একটা অজানা আতঙ্ক বাসা বেঁধে বসেছিল।
পরের দিন সকালে স্থানীয় মাঝিদের কাছে শুনলাম, সাগর সন্ধ্যার চারপাশে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। কেউ কেউ বলল, এখানে যারা কাজ করতে এসেছে, তারা বেশিদিন টিকতে পারেনি। কেউ নাকি অদৃশ্য ছায়া দেখেছে, কেউ আবার অজানা ফিসফিসানি শুনেছে। আমি তাদের কথা উড়িয়ে দিতে চাইলাম, কিন্তু রাতের সেই ছায়ার কথা ভুলতে পারছিলাম না।
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - মেঘে ঢাকা দীঘা: অন্ধকারে ডুবে যাওয়া দীঘা, ঝড়ের থাবা, আর রহস্যময় কান্নার শব্দ!এই ভুতের গল্পে আপনি পাবেন ঝড়ের রাতে দীপস্তম্ভের রহস্য, শিউলির অপার্থিব কান্না, আর সোনাদা'র সাহসী অভিযান। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ২: সোনা দাসের কাহিনি
পরদিন সকালে, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে, আমি প্রথমবারের মতো সোনা দাসের নাম শুনলাম। স্থানীয়রা তাকে “সাগর সন্ধ্যার পুরনো আলোক রক্ষক” বলে সম্বোধন করছিল। সোনা দাসের নাম শুনে আমি অবাক হলাম, কারণ এর আগেও একাধিকবার বাতিঘরের ইতিহাস সম্পর্কে শুনেছি, কিন্তু তার নাম কখনো ওঠেনি। স্থানীয়দের মতে, সোনা দাস ছিলেন সেই মানুষ, যিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সাগর সন্ধ্যার আলোর জন্য। তাদের গল্পের মধ্যে ছিল এক ভয়ানক এবং রহস্যময় অন্ধকার, যা সাগর সন্ধ্যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত।
একটু সন্দেহ নিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সোনা দাসের পুরোনো নথিপত্র খুঁজে দেখব। পাথরের নিচে, এক পরিত্যক্ত কক্ষে আমি তার ডায়েরি পেলাম। নথিপত্র খুলতে গিয়ে প্রথমেই চোখে পড়ল কিছু অদ্ভুত এবং প্রাচীন লেখা। সোনা দাসের হাতের লেখা, যা বেশ পুরোনো, তার মধ্যে এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। তার ডায়েরিতে লেখা ছিল, ১৯৮৫ সালের এক ঝড়ো রাতে সোনা দাস আবিষ্কার করেন যে সাগর সন্ধ্যার আলো শুধু নাবিকদের পথ দেখায় না, বরং হারিয়ে যাওয়া নাবিকদের আত্মাদের তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। এটা জানার পর সোনা দাসের মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগে। তিনি অনুভব করেন, সাগরের এই রহস্যময় আলোক রশ্মি শুধু এক প্রকৃতির সেবা নয়, বরং একটি অশুভ চুক্তি।
এক রাতে, তীব্র ঝড়ের সময়, সোনা দাস সাগরের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে জানতে পারেন, সাগরের গভীরতার মধ্যে কোনো এক অন্ধকার শক্তি রয়েছে যা তার আলোর মাধ্যমে আত্মাদের পথ নির্দেশ করে। কিন্তু এই কাজের জন্য, একটি মূল্যের প্রয়োজন ছিল—মানুষের জীবনশক্তি। সোনা দাস সিদ্ধান্ত নেন, তিনি নিজের জীবনশক্তি উৎসর্গ করবেন এই রহস্যময় শক্তির কাছে, যাতে নাবিকদের আত্মারা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারে। সেই রাতে সাগরের গর্জনে যেন নতুন এক সুর মিলেছিল, যা সোনা দাসের আত্মাকে চিরকাল সাগর সন্ধ্যার আলোর সঙ্গে বাঁধে ফেলে।
ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় সোনা দাস লিখেছেন, “এখন আমি আর মানুষ নেই, আমি সাগরের আলোর একটি অংশ। আমার আত্মা এখন সাগরের সঙ্গে চিরকাল থাকতে হবে। সেই অন্ধকার ও আলোর মধ্যেই আমি হারিয়ে যাব।” তার এই অভিশপ্ত কথা পড়ে আমি শিউরে উঠলাম। সোনা দাসের আত্মা কি এখনও এখানে, সাগর সন্ধ্যার মধ্যে আটকে আছে? তার আত্মা কি এখনও একে একে হারিয়ে যাওয়া নাবিকদের দেহে নতুন জীবন দিচ্ছে?
এই রহস্যের জাল আরও ঘনীভূত হচ্ছিল। সোনা দাসের আত্মা, যার শৃঙ্খল সাগরের আলোতে বাঁধা, এখনো কি সাগর সন্ধ্যার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে? তাঁর আত্মার শ্বাস, এই বাতিঘরের বাতাসে কি এখনও অনুভূত হয়? যদি হয়, তবে কি আমি সেই শ্বাস গ্রহণ করছি? আমি একাধিকবার ঘর ঘুরে দেখলাম, সাগরের গর্জন আমার কানে এসে রুমের ভেতর ঢুকে পড়ছিল। রাতের অন্ধকারে, বাতিঘরের আলো যেন আরো বেশি গভীর, আরও অশুভ মনে হচ্ছিল।
আমি জানতাম, সোনা দাসের আত্মা এখনো সাগরের অন্ধকারে আটকে রয়েছে, আর তার গতিবিধি বুঝে তাকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমার মনের মধ্যে এক তীব্র প্রশ্ন ছিল—এই বাতিঘরের আলোর রহস্যে কি আমি নিজেও কখনো আটকে যাব?
অধ্যায় ৩: ভয়ঙ্কর ঘটনা
এরপর থেকে অদ্ভুত ঘটনাগুলো বেড়ে চলল। প্রথম দিন থেকেই আমি অনুভব করছিলাম, সাগর সন্ধ্যার বাতিঘরে কিছু একটা অদ্ভুত চলছিল। কিন্তু দিন দিন সেই অনুভূতিটা যেন আরও তীব্র হতে লাগল। রাতের বেলা যখন আমি ঘুমানোর চেষ্টা করতাম, তখন মনে হতো, আমার চারপাশে যেন কিছু আছে, কিছু অদৃশ্য, যা আমাকে ঘিরে রেখেছে। কোনো এক রহস্যময় শক্তি, যা সাগরের গর্জনের সঙ্গে এক হয়ে আমার মনে ভয় জাগিয়ে তোলে। মাঝে মাঝে আমি কানাঘুষার মতো শব্দ শুনতাম, যেন কেউ আমার পাশে এসে ফিসফিস করছে। ঘরের কোণে, দেয়ালের সাথে আছড়ে পড়া বাতাসের শব্দ শুনতে পেতাম, কিন্তু সেই সুর সঙ্গীতের মতো নয়, যেন এক ভয়ঙ্কর প্রতিধ্বনি। এই শব্দগুলো আমার মনের মধ্যে একটি অশুভ অনুভূতি তৈরি করত, যা আমাকে পাগল করে দেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছিল।
একদিন রাতে, যখন আমার চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল, হঠাৎ করেই বাতির ঝলকানো শুরু হল। আলোটা অদ্ভুতভাবে মিটমিট করে জ্বলে উঠছিল, যেন নিজের ইচ্ছেমতো ঝলসানি দিচ্ছিল। আমি জানতাম না, এটা প্রযুক্তির ভুল, নাকি বাতিঘরের অভিশপ্ত শক্তি, কিন্তু কিছু একটা ছিল যা আমাকে শিহরিত করছিল। অন্ধকারে আলোটা যেন একেকটি অশুভ মুখের মতো গাঢ় হয়ে উঠছিল, এবং একের পর এক ছায়াগুলো ঘরের দেয়ালজুড়ে চলাফেরা করতে লাগল। ছায়াগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, তারা আমার দিকে এগিয়ে আসছিল, গতি একেবারে স্লো, যেন আকাশের মেঘের মতো। আমি চোখ সরিয়ে নিতাম, কিন্তু ফিরে তাকালে একই দৃশ্য দেখতে পেতাম। একে একে প্রতিটি ছায়া আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকত, যেন তারা আমাকে ঘিরে ধরেছিল। তাদের আকৃতিও কখনো কখনো অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, যেন সেগুলি কোনো মানুষের চেয়ে ভিন্ন কিছু—অন্তহীন, অজ্ঞাত।
এতদিনে, আমি শঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলাম। এক রাতে যখন ঘুমানোর জন্য শুয়ে ছিলাম, আমার মনে হলো, আমি আবার সেই অদ্ভুত শব্দগুলো শুনছি। স্নায়ুতে উত্তেজনা জমতে শুরু করেছিল। হঠাৎ করেই, একটা অদ্ভুত হালকা নড়াচড়া, যেন কোনো পদচারণা, শুনতে পেলাম। আমি অবাক হয়ে চোখ মেললাম এবং লক্ষ্য করলাম, দরজার কাছে এক বিরাট ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। ছায়াটা একেবারে সোজা, যেন কিছু একটা অপেক্ষা করছে। আমি ভয় পেয়ে দরজার দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছিল, ছায়াটি আমাকে ডাকছে, কিন্তু কেন? কেন সে এখানে দাঁড়িয়ে আছে? আমি এক নিঃশ্বাসে জিজ্ঞেস করলাম, “কে তুমি?” কিন্তু কোনো উত্তর এল না। ছায়াটি চুপ করে ছিল। আমি কিছুক্ষণ কিছু না বললেও সে চলে আসেনি। তার শরীরের প্রতিটি রেখা স্পষ্টভাবে আমার চোখে ভেসে উঠছিল, এবং আমি দেখতে পেলাম, ছায়ার ভেতর কিছু যেন অস্পষ্ট, বিভ্রান্তিকর কিছু ছিল, যেটি শুধু আমি অনুভব করতে পারছিলাম।
এমনকি সেই মুহূর্তে, আমি অনুভব করলাম, আমার শরীরে অদ্ভুত ঠাণ্ডা একটা শীতলতা এসে বসে গেছে। তাপমাত্রা একেবারে নিচে নেমে গিয়েছিল। আমি মনে মনে ভাবলাম, কোনো ভ্রম হচ্ছে কিনা, কিন্তু ছায়াটা একটুও নড়ল না। আমি আবারও বললাম, “কে তুমি?” এবার আমার গলা কাঁপছিল। ছায়া আমার দিকে আসতে শুরু করল। আমি কিছু না ভাবিয়ে সোজা উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে ফেললাম। এক মুহূর্তের জন্য আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ঠিক তখনি ছায়াটি ধীরে ধীরে গলে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, অবাক, শিউরে শিউরে। আমার মনে হচ্ছিল, ওই ছায়াটি শুধু আমার সামনে থেকেই গলে যায়নি, বরং সে আমার মধ্যে কোথাও লুকিয়ে গেছে—একটি অশুভ শক্তি যা আমার শরীরের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে।
আমি জানতাম, কিছু একটা ভুল হচ্ছে। এই জায়গায় কিছু এমন কিছু রয়েছে, যা আমি কখনো অনুভব করিনি, বা বুঝিনি। সাগর সন্ধ্যা আমাকে শুধুমাত্র আলোক রক্ষকের দায়িত্ব দেয়নি, বরং আমাকে এক ভয়াবহ রহস্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যা আমি ভেবেছিলাম, হয়তো আমি বুঝতেই পারব না। কিন্তু এখন, আমি জানি—এটি একটা নতুন ভয়, একটা অন্ধকার যা কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না।
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - ঝড়ের রাত: "ঝড়ের রাত" একটি ভৌতিক বাংলা ছোট গল্প যেখানে ভয়, রহস্য ও অতিপ্রাকৃত ঘটনায় ভরপুর এক রাতের অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে। ভুতের গল্প প্রেমীদের জন্য শিহরণ জাগানো এক উপহার। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৪: অভিশাপ ভাঙার চেষ্টা
আমি সমাধানের পথ খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম। সাগর সন্ধ্যার অন্ধকার রহস্য আমাকে তাড়া করছিল, আর আমি জানতাম, যদি আমি কিছু না করি, তবে এই অশুভ শক্তি আমাকে পুরোপুরি গ্রাস করবে। দিন-রাত একাকার হয়ে উঠেছিল, ঘুমেও কখনো মনে হতো, কেউ আমার চারপাশে হাঁটছে, কথা বলছে, আর সেই কথাগুলো আমার মাথার মধ্যে ঢুকছে, যেন অন্য কোনো দুনিয়া থেকে চলে আসছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, এটি স্বপ্ন নাকি বাস্তব। এই অবস্থায়, আমি একমাত্র পথ খুঁজে পেলাম, এলিয়াস নামক এক বৃদ্ধ মাঝির কাছে যাওয়া। লোকটি সাগর সন্ধ্যার পুরোনো ইতিহাস জানত, এবং তার থেকেই কিছু উত্তর পাওয়ার আশায় আমি তার কাছে গেলাম।
এলিয়াসের বাড়ি সাগর থেকে বেশ কিছুটা দূরে, একটি ছোট্ট গ্রামে ছিল। সেখানে পৌঁছানোর পর, আমি দেখতে পেলাম, বাড়ির চারপাশে যেন একটা নীরবতা ছড়িয়ে রয়েছে, যেন কোনো প্রাণ নেই। এলিয়াস নিজেই একদম একা, আর তার চোখে একটা গাঢ় শূন্যতা ছিল। তাকে দেখে আমার মনে হল, সে অনেক কিছু জানে, কিন্তু কিছু বলতে চাইছে না। তবে, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি সাগর সন্ধ্যার সম্পর্কে কিছু জানেন?” তার মুখটা এক মুহূর্তের জন্য বিবর্ণ হয়ে গেল, এবং সে ধীরে ধীরে আমাকে বসতে বলল।
“তুমি জানো, সোনা দাসের আত্মা একেবারেই শান্তি পাবে না যতক্ষণ না আরেকজন আলোক রক্ষক তার জীবন উৎসর্গ করবে,” এলিয়াস বলল, তার গলা কম্পিত, যেন কোনো ভয়ানক স্মৃতি তাকে তাড়া করছে।
এই কথা শুনে আমার শরীর এক মুহূর্তে শীতল হয়ে গেল। আমি ভেবেছিলাম, সোনা দাসের আত্মা কোনো কারণে এই জায়গার সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু এই অতিরিক্ত চুক্তি—একজন নতুন আলোক রক্ষক তার জীবন উৎসর্গ করবে—এটা আমার ধারণার বাইরে ছিল। “এটা কি সত্যি?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
এলিয়াস মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, সত্যি। সোনা দাস নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিল যাতে সাগর সন্ধ্যা নাবিকদের পথ দেখাতে পারে। কিন্তু তার আত্মা তখন থেকেই এখানে আটকে গেছে। সে এক সময় নিজের জীবনের রক্ষা করেছিল, কিন্তু সাগরের কাছে তার আত্মাকে বন্দি করতে হয়েছিল। এখন, যদি কেউ আরেকটি প্রাণ উৎসর্গ না করে, তাহলে সাগর সন্ধ্যা আর সোনার আত্মা শান্তি পাবে না। আর, যে লোক এটি করবে, তাকে সাগরের অভিশাপের সম্মুখীন হতে হবে।”
এলিয়াসের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝলাম, এটি শুধু একটি কপালের লেখা নয়, এটি বাস্তব। আমার শরীরে শিরশিরে ঠাণ্ডা অনুভব হচ্ছিল, যেন কিছু অদৃশ্য শক্তি আমাকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু কি করার ছিল? আমি যদি এই চুক্তি না মানি, তাহলে সাগরের অভিশাপ চলতেই থাকবে। সাগর সন্ধ্যার আলো আর ছায়াগুলোর মতো অদ্ভুত ঘটনার পেছনে এই অভিশাপই দায়ী। আমি ভাবতে লাগলাম, যদি একদিন এই অভিশাপ আমার ওপরেও এসে পড়ে?
এলিয়াস তার চোখ বন্ধ করে এক সময় বলল, “তুমি জানো, সাগর কখনো তার কাছে আসা প্রাণীকে ফিরে যেতে দেয় না। যদি তুমি চুক্তি ভাঙো, তাহলে সাগর সন্ধ্যা তোমাকে তার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখবে। তুমি তখন সোনা দাসের মতোই এদের আবর্তে আটকা পড়বে।”
তার কথাগুলো শুনে আমার সমস্ত শরীর জ্বলন্ত তাপ অনুভব করছিল, যদিও বাইরে শীত ছিল। মনে হচ্ছিল, যেন সাগরের গর্জন আরো জোরে শুনতে পাচ্ছি, এবং আলো-অন্ধকারের মধ্যে কিছু অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। এলিয়াসের মুখ থেকে সেই ভয়াবহ সত্য শুনে, আমি সম্পূর্ণ ভাবে বুঝতে পারলাম—এটা শুধু সোনা দাসের গল্প নয়, এটা আমারও গল্প হতে চলেছে। যেভাবে সোনা তার জীবন উৎসর্গ করেছিল, আমাকে তা করতে হবে। আর সেই অভিশাপকে ভেঙে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।
এলিয়াস এবার বলল, “তোমার আগে অনেক মানুষ চেষ্টা করেছে। কেউই সফল হয়নি। কিন্তু তুমি যদি সোনার আত্মাকে মুক্ত করতে চাও, তাহলে সেই পথ নিতে হবে। আর একদিন তুমি সাগরের কাছে গিয়ে তোমার আত্মাকে উৎসর্গ করবে।”
তার কথা শুনে আমি অদ্ভুত এক শূন্যতা অনুভব করলাম। যে অনুভূতি একে একে আমার দেহে প্রবাহিত হচ্ছিল, তা আমাকে শিউরে উঠতে বাধ্য করেছিল। আমি জানতাম, আমি যদি এই চুক্তি না মানি, তাহলে সাগরের অভিশাপ আমাকেও গ্রাস করবে, কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিতেও এক অদ্ভুত ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - অন্ধকারের ডাক: "অন্ধকারের ডাক" একটি রোমাঞ্চকর ভুতের গল্প। ভয়ের ছায়ায় ঘেরা এই বাংলা ছোট গল্প আপনাকে নিয়ে যাবে এক অজানা জগতের রহস্যে, যেখানে বাস্তবতা আর কল্পনার সীমানা মুছে যায়। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৫: আত্মত্যাগ
এক রাতে, আকাশ অন্ধকারে ছেয়ে গেল, এবং হঠাৎ করেই ভয়ঙ্কর ঝড়ের দেখা মিলল। সাগরের গর্জন যেন আকাশে বজ্রপাতের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল, এবং বাতাস যেন এক উন্মাদিত প্রাণী হয়ে উঠেছিল। সমুদ্রের বিশাল ঢেউগুলি আছড়ে পড়ছিল, আর সে শব্দ যেন আমার মনকে চূর্ণবিচূর্ণ করতে চাইছিল। আমি জানতাম, আজ রাতেই সব কিছু শেষ হবে। সাগর সন্ধ্যার অভিশাপ শেষ হতে চলেছে, কিন্তু তার জন্য আমাকে সবার শেষ পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমি সিঁড়ির দিকে এগিয়ে চললাম, আমার হাতটা কাঁপছিল, কিন্তু পা চলছিল। বাতাস যেন আমাকে পেছন থেকে টানছিল, যেন সে আমাকে ফিরে যেতে বলছে। সাগরের সেই ভয়ানক গর্জন আরো বেড়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, সমুদ্র নিজেই আমাকে যেন থামাতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি থামলাম না, আমার ইচ্ছে ছিল সাগর সন্ধ্যার আলোতে প্রবেশ করবো। আমার কাঁপানো শরীর আর হৃদস্পন্দন শীঘ্রই ঝড়ের তীব্রতার সঙ্গে একত্রিত হয়ে এক ভয়ানক সুর তুলছিল।
লোহার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে আমি বুঝতে পারছিলাম, সাগর যেন নিজের কোলাহলে ভাসছে, আর সেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসা আলোটা আগের চেয়ে অনেক উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। আমার শরীরে এক অবর্ণনীয় অনুভূতি চলছিল। একটি অদ্ভুত শক্তি যেন আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, আর আমি নিজেই জানতাম, এখনই সময় এসেছে।
আলোর দিকে আমি অগ্রসর হচ্ছিলাম, এক নিঃশব্দ শান্তি আমার মন ও শরীরকে গ্রাস করল। মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেছি, যেন আমি আর এই পৃথিবীর অংশ নই। আলোটা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তার মধ্যে একটি অদ্ভুত স্নিগ্ধতা ছিল। কিন্তু সাগরের কালো অন্ধকার আলোকিত হয়ে উঠল, যেন তার মধ্যে আমি এক নতুন পৃথিবীতে প্রবেশ করলাম। প্রতিটি মুহূর্তে আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি এখন সাগর সন্ধ্যার অংশ হয়ে গেছি। সেই আলো আমাকে এক অবিরাম যাত্রার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। আমার শরীর আর আত্মা যেন একসাথে মিশে গিয়েছিল সেই আলোর সঙ্গে, আর সেই আলো আমাকে সাগরের নিত্য পরিবর্তনশীল অভিশাপে ধারণ করেছিল।
আমি ঘুরে তাকালাম, তখন দেখলাম, সোনা দাসের আত্মা দূর থেকে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছিল। তার গভীর চোখ দুটি যেন আমার মধ্যে একটি অদৃশ্য বার্তা পাঠাচ্ছিল, যা আমি বুঝতে পারছিলাম না। তার চোখে একটা শান্তি, এক প্রশান্তি ছিল—যেন সে ধন্যবাদ জানাচ্ছিল আমাকে। হয়তো সে জানত, আমি তার পথেই হাঁটছি, তার অভিশাপ শেষ করতে। সোনা দাসের আত্মা আমার দিকে এক মুহূর্তের জন্য তাকাল, তারপর সাগরের সেই চমৎকার আলোতে বিলীন হয়ে গেল।
এই সব কিছু ঘটে যাওয়ার পর, সাগর সন্ধ্যা আবার নিজের রুটিনে ফিরে গেল, এক নতুন আলোক রক্ষককে গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু তার অভিশাপ এখনো অক্ষত ছিল, সেই পুরোনো চক্রটি এখনো চলছিল। সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে আমি জানতাম, এই অভিশাপ এখনও ভেঙে যায়নি। সাগর সন্ধ্যার প্রতিটি নতুন আলোক রক্ষককে তার অন্ধকারে প্রবাহিত করে, এবং এই চক্র চলতেই থাকবে। আমি এখন জানি, পরবর্তী আলোক রক্ষক আমাকে অনুসরণ করবে, এবং একদিন আমি তার অভিশাপে অবশেষে হারিয়ে যাব।
মনে হচ্ছিল, সমুদ্রের বুকে এক অদৃশ্য যুদ্ধ চলছে, আর তার তরঙ্গে আছড়ে পড়ছে হাজার বছরের পুরনো একটি দুঃখিনী আত্মা। এক রাতের এই যাত্রা শেষ হয়ে গেল, কিন্তু সাগরের বুকে এখনো অপেক্ষা করছে নতুন কোনো রক্ষক, তার নিয়তি পূর্ণ করতে।