অধ্যায় ১: লীলার পরিচয় এবং জাদুকরী বনে প্রবেশ
ছোটদের বাংলা রূপকথার ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
একটি ছোট্ট গ্রামে, যেখানে সবুজ ধানের ক্ষেত আর নদীর তীরে ফুলের সারি মিলে এক মনোরম দৃশ্য তৈরি করেছিল, সেখানে বাস করত লীলা নামের একটি মিষ্টি মেয়ে। লীলার বয়স ছিল মাত্র দশ বছর, কিন্তু তার চোখে ছিল এমন এক কৌতূহলের ঝিলিক যা তাকে তার সমবয়সীদের থেকে আলাদা করে তুলত। তার কালো চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসত, আর তার মুখে সবসময় একটা হালকা হাসি লেগে থাকত, যেন সে কোনো গোপন স্বপ্নের জগতে বাস করত। গ্রামের সবাই তাকে ভালোবাসত, কারণ লীলা ছিল সবার জন্য একটি ছোট্ট সাহায্যকারী। কখনো কারো বাড়ির ছাদ বৃষ্টিতে ভিজে গেলে সে ছুটে গিয়ে শুকনো পাতা এনে দিত, আবার কখনো গ্রামের বুড়োদের জন্য নদী থেকে পানি এনে দিত। তার এই স্বভাব দেখে গ্রামের প্রবীণরা বলতেন, “লীলার মধ্যে একটা আলাদা জাদু আছে। একদিন এই মেয়ে আমাদের সবাইকে অবাক করে দেবে।”
লীলার ঘর ছিল ছোট্ট, কিন্তু সেখানে ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। সে তার বাবা-মা আর ঠাকুরমার সাথে থাকত। তার বাবা ছিলেন একজন পরিশ্রমী কৃষক, যিনি ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ধানের খেতে কাজ করতেন। মা ছিলেন গৃহিণী, যিনি সকালে রান্না করে সন্ধ্যায় সবাইকে একসাথে খাওয়াতেন। কিন্তু লীলার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন তার ঠাকুরমা। ঠাকুরমার চুলে পাক ধরেছিল, আর তার কণ্ঠে ছিল গল্প বলার এক অদ্ভুত মাধুর্য। প্রতি রাতে, যখন গ্রামে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ত, ঠাকুরমা লীলাকে গল্প শোনাতেন—রাজকুমারীদের দুঃসাহসিক কাহিনী, পরীদের জাদুকরী উড়ান, আর দূরের রহস্যময় জঙ্গলের কথা। লীলা সেই গল্প শুনে মুগ্ধ হয়ে যেত। তার ছোট্ট মন ভরে উঠত কল্পনায়। সে ভাবত, “একদিন আমিও এমন এক জায়গায় যাব, যেখানে সবকিছু জাদুকরী।”
এক সন্ধ্যায়, লীলা তার ঠাকুরমার পাশে বসে আগুনের তাপে হাত গরম করছিল। হঠাৎ ঠাকুরমা একটি পুরানো কাঠের বাক্স খুলে তার থেকে একটি বই বের করলেন। বইটির মলাট ছিল চামড়ার, ধুলোয় ভরা, আর তার উপর সোনালি অক্ষরে লেখা ছিল “জাদুকরী বনের রহস্য”। লীলার হাতে বইটি দিয়ে ঠাকুরমা বললেন, “এটা আমার বাবার দেওয়া। তিনি বলতেন এই বইয়ে লেখা গল্প সত্যি।” লীলা বইটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে শুরু করল। প্রতিটি পাতায় ছিল অদ্ভুত ছবি—কথা বলা গাছ, গান গাইতে পারা পাখি, আর রঙিন ডানাওয়ালা পরীরা। বইটিতে লেখা ছিল যে এই জাদুকরী বন গ্রামের কাছেই আছে, কিন্তু সেখানে যেতে সাহস লাগে। লোকে বলত, যারা সেখানে গেছে, তারা আর ফিরে আসেনি।
“ঠাকুরমা, এই বনটা কি সত্যিই আছে?” লীলা উৎসাহে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞাসা করল।
ঠাকুরমা হেসে বললেন, “হ্যাঁ, আমার বাবা বলতেন এটা আছে। কিন্তু সেখানে শুধু তারাই যেতে পারে যাদের মনে ভয়ের চেয়ে কৌতূহল বেশি।”
লীলার মন উত্তেজনায় নেচে উঠল। সে বলল, “আমি যাব, ঠাকুরমা। আমি এই বন দেখতে চাই। আমি জানতে চাই এর রহস্য।”
ঠাকুরমা একটু চিন্তায় পড়লেন। তিনি জানতেন লীলা সাহসী, কিন্তু তবুও তার মনে একটা ভয় জাগল। কিন্তু লীলার চোখে সেই দৃঢ়তা দেখে তিনি আর বাধা দিলেন না। তিনি বললেন, “ঠিক আছে, কিন্তু সাবধানে যাবে। আর এই বইটা সাথে নিয়ে যাবে। এটা হয়তো তোমার পথ দেখাবে।”
পরদিন ভোরে, যখন সূর্যের প্রথম আলো গ্রামের ওপর পড়ল, লীলা তার ছোট্ট কাপড়ের ব্যাগে কিছু শুকনো খাবার, এক বোতল পানি, আর সেই পুরানো বইটি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। তার বাবা-মা তখন খেতে কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তাই সে তাদের না জানিয়েই রওনা দিল। গ্রামের বাইরে একটি সরু পথ ছিল, যেটি সোজা বনের দিকে চলে গেছে। লীলা সেই পথ ধরে হাঁটতে শুরু করল।
পথে তার চারপাশে ছিল প্রকৃতির অপরূপ রূপ। লাল, হলুদ, আর নীল রঙের ফুলের সারি রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে যেন তাকে স্বাগত জানাচ্ছিল। উড়ন্ত প্রজাপতিরা তার মাথার ওপর নাচছিল, আর তাদের ডানার রং দেখে লীলার মনে হচ্ছিল যেন তারা তাকে বনের দিকে ডাকছে। দূরে নদীর শান্ত জলের শব্দ ভেসে আসছিল, আর মাঝে মাঝে বাতাসে ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভরে যাচ্ছিল। লীলা একবার থেমে একটা হলুদ ফুল তুলে তার চুলে গুঁজে দিল। তারপর আবার হাঁটতে শুরু করল।
হঠাৎ, পথের ধারে একটি ছোট্ট খরগোশকে দেখতে পেল সে। খরগোশটি একটা গাজর চিবোচ্ছিল। লীলাকে দেখে সে একটু ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে ঝোপের দিকে ছুটল, কিন্তু লীলা হেসে বলল, “আমি তোমাকে কিছু করব না। তুমি আমার বন্ধু।” তার কথা শুনে খরগোশটি যেন একটু শান্ত হল। সে আবার ফিরে এসে গাজর খেতে শুরু করল। লীলা তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, “বনের প্রাণীরা কি আমার মতোই কৌতূহলী?”
লীলা হাঁটতে হাঁটতে বনের কাছে পৌঁছাল। দূর থেকে বনটি দেখতে ছিল অন্যরকম। গাছের পাতাগুলো উজ্জ্বল সবুজ, যেন সেগুলোতে সূর্যের আলো জমে আছে। আকাশে রঙিন পাখিরা উড়ছিল—নীল, লাল, আর হলুদ রঙের পালক নিয়ে তারা যেন একটা জীবন্ত রংধনু তৈরি করেছিল। বাতাসে ভেসে আসছিল একটা মিষ্টি গন্ধ—ফুলের সুবাস আর ভেজা মাটির গন্ধ মিশে যেন একটা জাদুকরী আবহ তৈরি করেছিল। লীলার হৃদয় দ্রুত লাফাতে শুরু করল। তার মনে একটু ভয় জাগল, কিন্তু তার কৌতূহল তাকে এগিয়ে যেতে বলল। সে গভীর শ্বাস নিয়ে বনের মধ্যে পা রাখল।
বনের ভেতরে প্রথমে সবকিছু শান্ত মনে হল। গাছের ডালপালা হাওয়ায় দুলছিল, আর পাতার ফাঁকে সূর্যের আলো এসে মাটিতে ছোট ছোট আলোর দাগ ফেলছিল। লীলা ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল। তার পায়ের নিচে শুকনো পাতা মচমচ করছিল, আর দূরে কোথাও একটা ঝরনার শব্দ ভেসে আসছিল। হঠাৎ, সে একটা ছোট্ট প্রজাপতিকে দেখল, যার ডানায় ছিল সোনালি রেখা। প্রজাপতিটি তার সামনে উড়তে উড়তে যেন তাকে পথ দেখাচ্ছিল। লীলা তার পিছু পিছু এগিয়ে গেল।
কিছুদূর যাওয়ার পর, সে শুনতে পেল পাখিরা যেন কথা বলছে। “স্বাগতম, লীলা,” একটি নীল রঙের পাখি ডালে বসে বলে উঠল। লীলা অবাক হয়ে চারদিকে তাকাল। পাখিটির চোখে একটা চমক ছিল, যেন সে লীলাকে অনেকদিন ধরে চেনে।
“তুমি আমার নাম জানলে কী করে?” লীলা বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল।
“এই বন সব জানে। তুমি এখানে এসেছ, কারণ তুমি বিশেষ,” পাখিটি উত্তর দিল।
লীলা বুঝতে পারল যে এই বন সত্যিই জাদুকরী। তার চোখে কৌতূহল আর মুখে হাসি ফুটে উঠল।
ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য বাংলা ছোট গল্প - অগ্নিযুগের ছায়া: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া এক প্রেম ও প্রতিরোধের কাহিনি। যুদ্ধ, বেদনা ও সাহসের মাঝে গড়ে ওঠা সম্পর্কের গল্প। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ২: জাদুকরী প্রাণীর সাথে দেখা এবং রহস্যময় বার্তা
ছোটদের বাংলা রূপকথার ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
লীলা বনের গভীরে পা বাড়াতে বাড়াতে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছিল। বাতাসে মিষ্টি ফুলের গন্ধ ভাসছিল, আর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে মাটিতে ছোট ছোট আলোর দাগ তৈরি করছিল। হঠাৎ, তার পায়ের শব্দ থেমে গেল। তার সামনে একটি ছোট্ট পরী উড়ে এসে থামল। পরীটির আকার ছিল লীলার হাতের চেয়েও ছোট, কিন্তু তার সৌন্দর্য ছিল অপরূপ। তার ডানা ছিল রঙিন প্রজাপতির মতো—নীল, লাল, আর সোনালি রঙের মিশ্রণে সেগুলো সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছিল। পরীটির পরনে ছিল ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরি একটি সূক্ষ্ম পোশাক, যা বাতাসে হালকা দুলছিল। তার চুল ছিল সোনালি রঙের কোঁকড়ানো ঢেউয়ের মতো, যা তার কাঁধের ওপর দিয়ে নেমে এসেছিল। তার চোখে ছিল এক দুষ্টুমির হাসি, যেন সে কোনো গোপন রহস্য জানে।
পরীটি লীলার চারপাশে উড়তে উড়তে, তার হালকা ডানার শব্দে একটি মিষ্টি সুর তৈরি করছিল। তারপর সে থেমে, লীলার সামনে ভেসে থেকে বলল, “হ্যালো, লীলা! তুমি এই জাদুকরী বনে কেন এসেছ?” তার কণ্ঠস্বর ছিল মধুর, যেন মধু ঝরে পড়ছে।
লীলা প্রথমে কথা বলতে পারল না। পরীটির এই অপার্থিব সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল। তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সে সাহস সঞ্চয় করে বলল, “আমি এই বনের রহস্য জানতে চাই। আমি শুনেছি এখানে অনেক জাদুকরী জিনিস আছে—গাছ যারা কথা বলে, পাখি যারা গান গায়, আর এমন প্রাণী যাদের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারে না।”
পরীটি তার মিষ্টি হাসি দিয়ে উত্তর দিল। “তুমি ঠিক শুনেছ, লীলা। এই বনে অনেক রহস্য আছে। কথা বলা গাছগুলো গল্প শোনায়, গান গাইতে পারা পাখিরা সুর তৈরি করে, আর আমরা পরীরা এই বনের জাদুকে জীবন্ত রাখি। কিন্তু এই সবকিছুর মাঝে সবচেয়ে বড় রহস্য হল বনের রাজা। তিনি এই বনের হৃদয়, সবচেয়ে জ্ঞানী এবং শক্তিশালী প্রাণী। তার সাথে দেখা করা সহজ নয়। যদি তুমি তাকে খুঁজে পেতে চাও, তাহলে তুমাকে তিনটি চ্যালেঞ্জ পূরণ করতে হবে।”
লীলার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার মনে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা জেগে উঠল, যার সাথে মিশে গিয়েছিল একটু ভয়। বনের রাজার কথা শুনে তার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমি প্রস্তুত! আমি এই চ্যালেঞ্জগুলো গ্রহণ করব। কিন্তু চ্যালেঞ্জগুলো কী?”
পরীটি লীলার আরও কাছে উড়ে এল, তার ডানা থেকে একটি হালকা বাতাস লীলার মুখে এসে লাগল। সে বলল, “খুব ভালো। শোনো তাহলে। প্রথম চ্যালেঞ্জটি হল জাদুকরী নদী পার হওয়া। এই নদী কোনো সাধারণ নদী নয়—এর জলে জাদু লুকিয়ে আছে, আর এটি পার হওয়া খুব কঠিন। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি হল জাদুকরী গুহায় প্রবেশ করা। গুহাটি অন্ধকার, ঠান্ডা, আর ভয়ঙ্কর, কিন্তু সেখানে একটি গোপন রহস্য অপেক্ষা করছে। আর তৃতীয় চ্যালেঞ্জটি হল জাদুকরী ফুল খুঁজে বের করা। এই ফুল শুধু রাতে ফোটে, আর এটি এই বনের সবচেয়ে দুর্লভ এবং মূল্যবান জিনিস।”
লীলা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তার মনে ভয়ের একটি ছায়া পড়লেও, তার সাহস আর কৌতূহল তাকে এগিয়ে যেতে প্ররোচিত করল। সে বলল, “আমি এই চ্যালেঞ্জগুলো পূরণ করব। কিন্তু আমি কীভাবে পথ খুঁজে পাব?”
পরীটি তার ছোট্ট জাদুকাঠি বের করে একটি দ্রুত ঘূর্ণন দিল। হঠাৎ তার হাতে একটি ছোট্ট আলোর বল উদ্ভাসিত হল। বলটি ছিল উষ্ণ, উজ্জ্বল, আর এতটাই হালকা যে এটি বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। পরীটি এটি লীলার হাতে দিয়ে বলল, “এটি তোমাকে পথ দেখাবে। যখনই তুমি হারিয়ে যাবে বা দ্বিধায় পড়বে, এটির আলো তোমাকে সঠিক পথে নিয়ে যাবে।” তারপর সে হালকা হেসে, ঘণ্টার মতো মিষ্টি শব্দ করে উড়ে চলে গেল। লীলা তাকে চোখের পলকে বনের গাছপালার মাঝে হারিয়ে যেতে দেখল।
লীলা আলোর বলটি হাতে নিয়ে দেখল। এটি তার হাতের তালুতে একটি ছোট্ট তারার মতো জ্বলছিল। এর আলো নরম কিন্তু তীব্র, আর এটি হাতে ধরে মনে হচ্ছিল যেন এটির নিজস্ব জীবন আছে। সে গভীর শ্বাস নিল, তার মনকে শান্ত করল, এবং তার যাত্রা শুরু করল। আলোর বলটি তার সামনে ভেসে চলল, তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল।
বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লীলা লক্ষ্য করল যে চারপাশ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। গাছের পাতাগুলো ফিসফিস করছিল, যেন তারা নিজেদের মধ্যে গোপন কথা বলছে। পথের দুপাশে ফুল ফুটছিল, যেন তার আগমনকে স্বাগত জানাচ্ছে। কাঠবিড়ালিরা গাছের ডালে লাফালাফি করছিল, তাদের লেজ দিয়ে বাতাসে ছোট ছোট ঝড় তুলছিল। রঙিন পাখিরা তার মাথার ওপর দিয়ে উড়ছিল, তাদের গানে বন ভরে যাচ্ছিল। একবার সে একটি হরিণের পরিবারকে দেখল—তারা একটি ছোট্ট খোলা জায়গায় ঘাস খাচ্ছিল, তাদের গ্রীবা উঁচু করে লীলার দিকে তাকিয়ে।
কিন্তু এই সৌন্দর্যের মাঝেও লীলার মনে একটি অস্বস্তি জাগছিল। মাঝে মাঝে তার মনে হচ্ছিল যেন কেউ তাকে দেখছে। সে চোখের কোণে কিছু নড়তে দেখছিল, কিন্তু পিছনে তাকালে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। বনের প্রাণীরা কি তাকে লক্ষ্য করছে? নাকি এখানে আরও কিছু লুকিয়ে আছে? এই প্রশ্নগুলো তার মনে ঘুরছিল, কিন্তু সে নিজেকে শক্ত করল এবং এগিয়ে চলল।
আলোর বলটি তাকে একটি সরু পথে নিয়ে গেল। পথটি বনের আরও গভীরে চলে গিয়েছিল, আর দুপাশে ছিল আলোকিত মাশরুম। এই মাশরুমগুলো নীল আলো ছড়াচ্ছিল, যা সূর্য ডোবার সাথে সাথে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। লীলা মুগ্ধ হয়ে তাদের দিকে তাকাল। তার মনে হচ্ছিল যেন সে কোনো স্বপ্নের জগতে হাঁটছে।
অধ্যায় ৩: চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি
ছোটদের বাংলা রূপকথার ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
লীলা তার যাত্রায় এগিয়ে চলছিল। বনের গভীরে পৌঁছে সে এক অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেল—পানির কলকল শব্দ, যা কখনো মৃদু, কখনো জোরালো হয়ে উঠছিল। সে বুঝল যে সে জাদুকরী নদীর কাছে এসে পড়েছে। এই নদীটি ছিল তার প্রথম চ্যালেঞ্জ, যা পার না করলে সে বনের রাজার কাছে পৌঁছাতে পারবে না। লীলার হৃদয়ে উত্তেজনা আর একটু ভয় মিশে গেল। সে জানত, এই পথে অনেক পরীক্ষা তার জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু তার মন বলছিল, “আমি পারব। আমি সাহসী।”
লীলা নদীর তীরে পৌঁছতেই তার চোখে পড়ল এর অপরূপ সৌন্দর্য। নদীটি ছিল প্রশস্ত—প্রায় পঞ্চাশ হাতের মতো—এবং এর জল ছিল এতটাই স্বচ্ছ যে নীচের পাথরগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু এই জল সাধারণ ছিল না। তাতে এক অদ্ভুত আলো ঝিকমিক করছিল, যেন আকাশের তারারা নেমে এসে জলে খেলা করছে। স্রোত ছিল তীব্র, এতটাই জোরালো যে লীলার মনে হল, এতে পা দিলে সে ঠিকই ভেসে যাবে।
নদীর জলে জাদুকরী প্রাণীরা লুকিয়ে ছিল। কিছু মাছ লাফিয়ে উঠছিল, তাদের গায়ে রংধনুর সাত রঙ ঝকঝক করছিল। কয়েকটি বড় কচ্ছপও ভেসে উঠল, তাদের খোলসে সোনালি নকশা যেন রোদের আলোয় চকচক করছে। তারা লীলার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ছিল, যেন বলতে চাইছে, “দেখি, তুমি কী করতে পারো!” একটি ছোট্ট মাছ লীলার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “এই নদী পার করা সহজ নয়। তুমি কি সত্যিই পারবে?” লীলা হেসে বলল, “চেষ্টা তো করবই।”
সে চারপাশে তাকাল। নদীর ওপারে একটি ছোট্ট দ্বীপ দেখা যাচ্ছিল, আর সেখানে একটি কাঠের নৌকা বাঁধা ছিল। নৌকাটি ছোট, কিন্তু মজবুত। লীলা ভাবল, “ওই নৌকা দিয়েই আমি নদী পার হতে পারি। কিন্তু কীভাবে ওপারে যাব?” তার কাছে কোনো সেতু ছিল না, আর স্রোতের মধ্যে সাঁতার কাটাও অসম্ভব। তখন তার মনে পড়ল তার ব্যাগে থাকা লম্বা দড়িটির কথা। সে গ্রাম থেকে এটি নিয়ে এসেছিল, ভেবেছিল কখনো না কখনো কাজে লাগবে।
লীলা দড়িটি বের করল। এটি ছিল মোটা আর শক্ত—ঠিক যেমনটা এখন তার দরকার। নদীর এপারে একটি বড় গাছ ছিল, যার ডালগুলো নদীর ওপর ঝুঁকে পড়েছিল। সে দড়ির এক প্রান্ত গাছের একটি মজবুত ডালে বেঁধে দিল। তারপর অন্য প্রান্তটি শক্ত করে ধরে নদীর ওপারে ছুঁড়ে দিল। দড়িটি বাতাসে উড়ে গিয়ে ওপারের একটি গাছের শাখায় আটকে গেল। এখন দড়িটি নদীর ওপর দিয়ে একটি সরু সেতুর মতো ঝুলছিল।
লীলার হৃদয় জোরে জোরে ধুকপুক করতে লাগল। দড়ি ধরে ঝুলে ঝুলে পার হওয়া সহজ কথা নয়। নীচে তীব্র স্রোত আর জাদুকরী প্রাণীরা তাকিয়ে আছে। তার হাত যদি পিছলে যায়, তাহলে সে পড়ে যাবে। কিন্তু সে নিজেকে বলল, “আমি পারব। আমি ভয় পাব না।” সে গভীর শ্বাস নিয়ে দড়িটি দুই হাতে শক্ত করে ধরল এবং ঝুলে পড়ল। তার পা মাটি ছেড়ে উঠল, আর সে ধীরে ধীরে হাত দিয়ে দড়ি টেনে এগোতে শুরু করল।
নীচে জাদুকরী মাছগুলো লাফিয়ে উঠে তার দিকে তাকাচ্ছিল। একটি বড় কচ্ছপ মাথা তুলে বলল, “সাবধান, ছোট্ট মেয়ে! পড়ে গেলে আমরা তোমাকে বাঁচাতে পারব না।” লীলা হাসল, যদিও তার হাসিতে একটু ভয় মিশে ছিল। সে বলল, “চিন্তা করো না। আমি সাহসী। আমি পারব।” তার কথা শুনে কচ্ছপটি মুখ নিচু করে জলে ডুবে গেল, যেন লীলার সাহসে সে খুশি হয়েছে।
লীলা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল। তার হাত কখনো কখনো পিছলে যাচ্ছিল, আর বাতাসে তার শরীর দুলছিল। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল যেন সে আর পারবে না। কিন্তু সে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিল। অনেক কষ্টের পর, অবশেষে সে নদীর ওপারে পৌঁছাল। তার পা মাটি স্পর্শ করতেই সে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। সে দড়িটি ছেড়ে দিয়ে নৌকার কাছে গেল।
নৌকাটি ছিল হালকা, আর এতে একটি ছোট্ট পাল লাগানো ছিল। লীলা নৌকাটি জলে নামিয়ে তাতে উঠে পড়ল। সে পালটি খুলে দিতেই বাতাসে তা ভরে গেল। নৌকাটি ধীরে ধীরে নদীর এপারে ফিরে আসতে শুরু করল। এপারে পৌঁছে লীলা নৌকাটি গাছের সাথে বেঁধে রাখল। তার প্রথম চ্যালেঞ্জ পার হয়েছে। সে নিজের ওপর গর্ব অনুভব করল। তার মনে হল, “আমি সত্যিই সাহসী।”
লীলা আবার পথ চলতে শুরু করল। এবার পথটি পাথুরে হয়ে গেল। চারপাশে বড় বড় পাথর ছড়িয়ে ছিল, আর গাছের সংখ্যা কমে আসছিল। হঠাৎ, সে একটি বিশাল গুহার মুখে এসে দাঁড়াল। গুহাটির প্রবেশপথে দুটি পাথরের স্তম্ভ ছিল, যেন দুজন প্রহরী পাহারা দিচ্ছে। ভেতর থেকে একটি গভীর গর্জন ভেসে এল। লীলার পা কেঁপে উঠল। সে বুঝল, এটাই তার দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ—জাদুকরী গুহায় প্রবেশ করা।
গুহার মুখে দাঁড়িয়ে লীলা ভেতরের অন্ধকারের দিকে তাকাল। তার হাতে আলোর বলটি জ্বলছিল, কিন্তু গুহার অন্ধকার এত গাঢ় যে আলোটি যেন হারিয়ে যাচ্ছিল। আবার একটি গর্জন শোনা গেল, এবার আরও কাছ থেকে। লীলা ভাবল, “ভেতরে কী আছে? একটা দানব?” তার মন বলছিল পিছিয়ে যেতে, কিন্তু তার হৃদয় বলল, “না, আমি পিছপা হব না। আমি বনের রাজার কাছে যাবই।”
সে আলোর বলটি সামনে ধরে গুহায় ঢুকল। ভেতরে ঠান্ডা বাতাস তার মুখে এসে লাগল। মাটিতে ছোট ছোট পাথর ছিল, যা তার পায়ে খোঁচা দিচ্ছিল। গুহার দেয়ালে অদ্ভুত নকশা দেখা যাচ্ছিল—যেন কেউ অনেক আগে এখানে গল্প এঁকেছিল। লীলা সাবধানে এগিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ, তার সামনে একটি বিশাল ছায়া পড়ল। সে মাথা তুলে দেখল—একটি বড় দানব তার দিকে তাকিয়ে আছে।
দানবটির চেহারা ছিল ভয়ঙ্কর। তার উচ্চতা ছিল প্রায় দশ হাত, আর শরীরে পাথরের মতো শক্ত চামড়া। তার চোখ দুটি লাল আগুনের মতো জ্বলছিল, আর মুখে ধারালো দাঁত ঝকঝক করছিল। সে গর্জন করে বলল, “কে তুমি? কেন আমার গুহায় এসেছ?”
লীলার গলা শুকিয়ে গেল। সে ভয়ে কাঁপছিল, কিন্তু সে জানত, ভয় দেখালে দানবটি তাকে আক্রমণ করতে পারে। তাই সে সাহস করে বলল, “হ্যালো, দানব। আমার নাম লীলা। আমি এই গুহা পার হতে চাই। আমি বনের রাজার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।”
দানবটি অবাক হয়ে লীলার দিকে তাকাল। তার গর্জন একটু কমে গেল। সে বলল, “তুমি ভয় পাচ্ছ না? সবাই আমাকে দেখে পালায়।”
লীলা হাসার চেষ্টা করল। তার হাসি কাঁপছিল, কিন্তু সে বলল, “না, আমি ভয় পাচ্ছি না। কারণ আমি জানি, সব প্রাণীই ভালো হতে পারে। তুমিও নিশ্চয়ই ভালো। তুমি কি আমার বন্ধু হবে?”
দানবটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর হঠাৎ হেসে উঠল। তার হাসি গুহার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছিল। “তুমি সাহসী, লীলা। আমি অনেকদিন ধরে এই গুহায় একা আছি। কেউ আমার সাথে কথা বলে না। তুমি প্রথম যে আমাকে ভয় পাওনি। হ্যাঁ, আমি তোমার বন্ধু হব।”
লীলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সে বলল, “ধন্যবাদ, দানব। তুমি কি আমাকে গুহার ওপারে পৌঁছে দিতে পারবে?”
দানবটি মাথা নাড়ল। “অবশ্যই। আমি তোমাকে পথ দেখাব।” সে তার বিশাল হাত দিয়ে লীলাকে তুলে নিল এবং কাঁধে বসিয়ে দিল। তারপর গুহার গভীরে হাঁটতে শুরু করল। লীলা দানবের কাঁধে বসে চারপাশ দেখছিল। গুহার ভেতরে ঝুলন্ত পাথরগুলো আলোর বলের আলোয় চকচক করছিল। কিছুক্ষণ পর, তারা গুহার ওপারে পৌঁছাল। সেখানে একটি ছোট্ট প্রবেশপথ ছিল।
দানবটি লীলাকে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে বলল, “এই পথ দিয়ে তুমি বেরিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু সাবধান, বনের গভীরে আরও বিপদ আছে।”
লীলা হেসে বলল, “ধন্যবাদ, আমার নতুন বন্ধু। আমি সাবধানে যাব।” তারপর সে গুহা থেকে বেরিয়ে আবার বনের পথে পা রাখল। তার দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জও পার হয়েছে।
লীলা তার পথে এগিয়ে চলল, তার মনে নতুন আশা আর সাহস নিয়ে। জাদুকরী নদী পার করতে সে তার বুদ্ধি আর সাহস ব্যবহার করেছে। গুহায় দানবের সাথে দেখা হওয়ায় সে শিখেছে যে সাহসের সাথে দয়াও জরুরি। সে বুঝেছে, ভয়ঙ্কর দেখতে হলেও কারো মনে ভালোবাসা থাকতে পারে। তার নতুন বন্ধু দানব তাকে এই শিক্ষা দিয়েছে।
এখন তার সামনে শুধু একটি চ্যালেঞ্জ বাকি—জাদুকরী ফুল খুঁজে বের করা। লীলা জানে, এই পথ কঠিন হবে, কিন্তু সে প্রস্তুত। তার সাহস, বুদ্ধি, আর নতুন বন্ধুরা তার সাথে আছে। সে আলোর বলের পিছু পিছু হাঁটতে লাগল, তার চোখে স্বপ্ন আর মনে দৃঢ়তা নিয়ে।
কল্পবিজ্ঞান-এর বাংলা ছোট গল্প - শেষ অধ্যায়: একটি রহস্যময় কল্পবিজ্ঞান গল্প, যেখানে এক বিজ্ঞানীর গবেষণা মুহূর্তেই রূপ নেয় বিভীষিকায়। পড়ুন এই বাংলা ছোট গল্প যেখানে বিজ্ঞান, সংকট ও মানবিকতার টানাপোড়েন একসঙ্গে মিশে গেছে! সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৪: জাদুকরী বন্ধু এবং ফুলের সন্ধান
ছোটদের বাংলা রূপকথার ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
লীলার জীবনে এখন এসে দাঁড়িয়েছে তার তৃতীয় এবং সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জটি ছিল জাদুকরী ফুল খুঁজে বের করা—একটি এমন ফুল, যা শুধুমাত্র রাতের গভীর অন্ধকারে ফোটে এবং বনের সবচেয়ে দুর্গম গভীরে লুকিয়ে থাকে। এই ফুলটি ছিল অত্যন্ত দুর্লভ, এমনকি বনের পশুপাখিরাও এর অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানত না। লীলা শুনেছিল যে এই ফুলটির পাপড়ি রঙিন আলো ছড়ায়, এবং এটি যে কারও হাতে পড়লে তাকে অসাধারণ শক্তি দিতে পারে। তবে এই ফুলের সন্ধান পাওয়া এতটাই কঠিন ছিল যে সাধারণ মানুষের পক্ষে বনের সেই গভীর অংশে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব বলে মনে হতো।
লীলা অবশ্য হাল ছাড়ার পাত্রী ছিল না। প্রথম দুটি চ্যালেঞ্জে সে যে সাহস ও বুদ্ধিমত্তা দেখিয়েছিল, তা তার মনে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলেছিল। সে নিজেকে বলল, “আমি যদি আগের দুটো চ্যালেঞ্জ পার করতে পারি, তাহলে এটাও পারব। আমার কাছে সময় কম, কিন্তু আমি হার মানব না।” তার চোখে ছিল দৃঢ় সংকল্প, আর মনে ছিল একটি অদম্য ইচ্ছা—বনের রাজার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর।
সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্তে ডুবে গেছে। আকাশে চাঁদ উঠেছে, আর তার মৃদু আলো বনের গাছপালার মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। লীলা তার ছোট্ট আলোর বলটি হাতে নিল। এই আলোর বলটি ছিল তার একটি বিশেষ সঙ্গী—এটি কেবল পথ দেখায় না, বরং একটি উষ্ণতা ছড়ায় যা লীলার মনে সাহস জোগায়। সে গভীর নিশ্বাস নিয়ে বনের দিকে পা বাড়াল।
রাতের বন ছিল এক ভিন্ন জগৎ। দিনের বেলায় যে গাছগুলো সবুজ আর শান্ত মনে হতো, রাতে তারা যেন ছায়ার দানবের মতো দীর্ঘ হয়ে উঠেছিল। বাতাসে পাতার মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছিল, আর দূর থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছিল। লীলার মনে একটু ভয় জাগল। সে অন্ধকারে একা, আর চারপাশে অজানা শব্দ। কিন্তু সে নিজেকে শান্ত করল। “ভয় পেলে কিছু হবে না,” সে নিজের মনে বলল, “আমাকে এগিয়ে যেতে হবে।” আলোর বলটি তার পথ আলোকিত করছিল, আর সেই আলোর উষ্ণতা তাকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দিচ্ছিল।
লীলা বনের গভীরে যতই এগিয়ে যাচ্ছিল, ততই চারপাশের পরিবেশ অদ্ভুত হয়ে উঠছিল। হঠাৎ, সে একটি মৃদু হাসির শব্দ শুনতে পেল। শব্দটি এতটাই হালকা ছিল যে প্রথমে সে ভাবল এটা তার মনের ভুল। সে থেমে গিয়ে চারপাশে তাকাল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়ছিল, কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। তারপর, হঠাৎ তার সামনে একটি ছোট্ট খরগোশ লাফিয়ে এল।
এটি কোনো সাধারণ খরগোশ ছিল না। এর গায়ের রং ছিল রুপালি, যা চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছিল। এর কানের প্রান্তে সোনালি রেখা ছিল, আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল এর চোখ—দুটি ছোট্ট তারার মতো জ্বলজ্বল করছিল। লীলা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। খরগোশটি তার দিকে তাকিয়ে হাসল, এবং তারপর একটি মানুষের মতো কণ্ঠে বলল, “হ্যালো, লীলা। তুমি কি জাদুকরী ফুল খুঁজছ?”
লীলা প্রথমে ভয়ে পিছিয়ে গেল, কিন্তু তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি খুঁজছি। তুমি কীভাবে আমার নাম জানলে?”
খরগোশটি আবার হাসল। “এই বনের সবাই তোমার কথা জানে,” সে বলল। “তুমি সাহসী মেয়ে। তুমি প্রথম দুটো চ্যালেঞ্জ পার করেছ, আর এখন তুমি বনের রাজার সামনে যেতে চাও। আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।”
লীলার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে বলল, “তুমি কি আমাকে ফুলটি খুঁজে দিতে পারবে?”
খরগোশটি মাথা নাড়ল। “অবশ্যই। চলো, আমি তোমাকে নিয়ে যাব।”
লীলা আর জাদুকরী খরগোশটি একসাথে বনের আরও গভীরে যাত্রা শুরু করল। খরগোশটি লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, আর লীলা তার পিছু পিছু হাঁটছিল। পথে তারা অনেক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। এক জায়গায় ছিল আলোকিত মাশরুমের বাগান। এই মাশরুমগুলো নীল আলো ছড়াচ্ছিল, যেন রাতের অন্ধকারে ছোট ছোট তারা জ্বলছে। লীলা একটু থেমে সেগুলোর দিকে তাকাল। “এগুলো কত সুন্দর!” সে মুগ্ধ হয়ে বলল।
খরগোশটি হেসে বলল, “এই বন জাদুতে ভরা। তুমি যত গভীরে যাবে, তত অদ্ভুত জিনিস দেখবে।”
তারা আরও এগিয়ে গেল। এক জায়গায় গাছের ডালে ঝুলন্ত ফুল দেখা গেল। এই ফুলগুলো রাতে জোনাকির মতো জ্বলছিল—কখনো হলুদ, কখনো সবুজ আলো ছড়াচ্ছিল। লীলা এমন দৃশ্য কখনো দেখেনি। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন স্বপ্নের জগতে এসে পড়েছে। “এই বন সত্যিই অসাধারণ,” সে বলল।
খরগোশটি বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু এখানে বিপদও আছে। তাই আমার সঙ্গে থাকো।”
অনেক পথ পেরিয়ে তারা অবশেষে একটি ছোট্ট ঝর্ণার কাছে পৌঁছাল। ঝর্ণাটি ছিল অপূর্ব সুন্দর। এর জল চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছিল, যেন হীরার কণা ছড়িয়ে আছে। চারপাশে ছোট ছোট পাথরের মধ্যে রঙিন ফুল ফুটে ছিল। লীলা মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঝর্ণার পাশে একটি ছোট্ট গাছ ছিল, আর সেখানে ফুটে ছিল জাদুকরী ফুলটি।
ফুলটির পাপড়ি ছিল রঙিন আলোর মতো—লাল, নীল, হলুদ, আর সবুজ রং মিশে এক অপূর্ব দৃশ্য তৈরি করেছিল। এটি যেন বনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। লীলা ধীরে ধীরে ফুলটির কাছে গেল। তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু সে সাহস করে ফুলটি আলতো করে তুলে নিল। আশ্চর্যের বিষয়, ফুলটি তার হাতে থাকলেও এর আলো একটুও কমল না।
লীলা খরগোশটির দিকে তাকিয়ে বলল, “ধন্যবাদ, আমার বন্ধু। তুমি ছাড়া আমি এটি কখনো খুঁজে পেতাম না।”
খরগোশটি হাসল। “তুমি খুব ভালো মেয়ে, লীলা। আমি তোমার বন্ধু হতে চাই।”
লীলা হেসে বলল, “আমিও। আমরা চিরকালের বন্ধু থাকব।”
এইভাবে, লীলা তার তৃতীয় চ্যালেঞ্জ পূরণ করল। তার হাতে জাদুকরী ফুল, আর তার পাশে একটি নতুন বন্ধু। সে এখন প্রস্তুত বনের রাজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। তার মনে কোনো ভয় ছিল না, কারণ সে জানত, তার সাহস আর বন্ধুর সঙ্গই তাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে।
ছোটদের রূপকথার গল্প - শীতলপুরের যাদুকরী রক্তগোলাপ: একটি হৃদয়স্পর্শী রূপকথার গল্প, যেখানে সত্যিকারের ভালোবাসার শক্তিতে শীতলপুরের অভিশাপ ভেঙে যায়। আকর্ষণীয় ছোটদের গল্প যা যাদু, প্রেম ও ত্যাগের এক অনন্য উপাখ্যান তুলে ধরে। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৫: বনের রাজার সামনে এবং গুরুত্বপূর্ণ পাঠ
ছোটদের বাংলা রূপকথার ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
লীলা এখন বনের রাজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তার হৃদয়ের ধুকপুকুনি এত জোরালো ছিল যে মনে হচ্ছিল বুক ফেটে বেরিয়ে আসবে। এই মুহূর্তটির জন্য সে কতটা পথ পাড়ি দিয়েছে, কত বিপদের মুখোমুখি হয়েছে, তার হিসাব নেই। বনের গভীরে, যেখানে সূর্যের আলোও ঠিকমতো পৌঁছায় না, সেখানে এই রাজার সাক্ষাৎ পাওয়া যেন এক অলৌকিক ঘটনা। রাজা ছিলেন একজন বৃদ্ধ জাদুকর, যার চেহারায় সময়ের ছাপ স্পষ্ট। তার লম্বা সাদা দাড়ি বাতাসে হালকা হালকা দুলছিল, মাথায় একটি উজ্জ্বল মুকুট যেন তার মর্যাদার প্রতীক। কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল তার চোখ—গভীর, জ্ঞানী, যেন সে এক নজরে লীলার সমস্ত যাত্রা দেখে ফেলতে পারেন।
তিনি একটি বিশাল গাছের নিচে বসে ছিলেন। গাছটির ডালপালা এত উঁচুতে ছড়িয়ে গিয়েছিল যে মনে হচ্ছিল আকাশের সীমানা ছুঁয়ে ফেলেছে। পাতাগুলোতে সোনালি আভা খেলছিল, যেন সূর্যের আলো সেখানে জমে গিয়ে এক অপার্থিব সৌন্দর্য তৈরি করেছে। লীলা এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। তার পাশে ছিল ছোট্ট খরগোশটি, যে তার এই দীর্ঘ যাত্রায় একনিষ্ঠ সঙ্গী হয়ে উঠেছিল।
রাজা লীলার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। সেই হাসিতে কোনো গাম্ভীর্য ছিল না, বরং ছিল এক অদ্ভুত উষ্ণতা, যা লীলার ভয় কমিয়ে দিল। “তুমি সাহসী এবং বুদ্ধিমান, লীলা,” তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন। “তুমি তিনটি চ্যালেঞ্জ পূরণ করেছ। এই বনে অনেকেই এসেছে, অনেকে চেষ্টা করেছে, কিন্তু কেউ আমার সামনে দাঁড়াতে পারেনি। তুমি সত্যিই বিশেষ।”
লীলা মাথা নিচু করে সম্মান জানাল। তার গলায় একটা দ্বিধা ছিল, তবু সে সাহস করে বলে উঠল, “ধন্যবাদ, রাজা। আমি এই বনের রহস্য জানতে চাই। আমি এতদূর এসেছি শুধু এই প্রশ্নের উত্তর পেতে।”
রাজা একটি গভীর নিশ্বাস নিলেন। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, “এই বনের আসল রহস্য হল বন্ধুত্ব আর সাহসের শক্তি। তুমি তোমার যাত্রায় অনেক কিছু দেখেছ, অনেকের সাথে পথ চলেছ। পরী তোমাকে পথ দেখিয়েছে, দানব তোমাকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে, আর এই ছোট্ট খরগোশটি তোমার পাশে থেকে তোমাকে একা বোধ করতে দেয়নি। তারা তোমাকে সাহায্য করেছে, আর তুমিও তাদের প্রতি স্নেহ দেখিয়েছ। তোমার সাহস তোমাকে আমার সামনে এনেছে, কিন্তু বন্ধুত্বই তোমাকে এই শক্তি দিয়েছে।”
লীলা মন দিয়ে রাজার কথা শুনছিল। তার মনে হচ্ছিল যেন একটা পর্দা সরে যাচ্ছে। সে এতদিন যা যা পার করেছে—অন্ধকার গুহা, বিষাক্ত নদী, আর ভয়ঙ্কর জন্তু—সবকিছু পার হওয়ার পেছনে তার নিজের সাহসের পাশাপাশি বন্ধুদের ভূমিকা ছিল। সে বলে উঠল, “আমি বুঝেছি, রাজা। আমি শিখেছি যে একা কিছু করা খুব কঠিন, কিন্তু বন্ধুদের সাথে থাকলে সব সম্ভব হয়ে ওঠে।”
রাজা খুশি হয়ে মাথা নাড়লেন। “ঠিক বলেছ, লীলা। এই জাদুকরী বনের প্রকৃত শক্তি লুকিয়ে আছে ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের মধ্যে। যে এই পাঠ শিখতে পারে, সে জীবনে কখনো হারে না।” তারপর তিনি তার পোশাকের ভাঁজ থেকে একটি ছোট্ট জাদুকরী দুল বের করলেন। দুলটি ছিল সোনালি, এবং এর মাঝে জ্বলজ্বল করছিল একটি নীল পাথর। পাথরটি থেকে আলো ছড়িয়ে পড়ছিল, যেন একটি ছোট্ট তারা হাতে ধরা যায়। “এটি তোমাকে গ্রামে ফিরতে সাহায্য করবে,” তিনি বললেন। “এটি হাতে ধরে চোখ বন্ধ করো, আর তোমার ঘরের কথা ভাবো। তুমি যেখানে যেতে চাও, সেখানে পৌঁছে যাবে।”
লীলা দুলটি হাতে নিল। এটি স্পর্শ করতেই তার হাতে একটা উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল। সে রাজার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতায় বলল, “আমি কখনো এই যাত্রা ভুলব না। আপনি আর আমার বন্ধুরা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন।”
রাজা আবার হাসলেন। “যাও, লীলা। তোমার পরিবারের কাছে ফিরে যাও। কিন্তু মনে রেখো, সাহস আর বন্ধুত্বের শক্তি সব পারে। জীবনে যখনই বিপদ আসবে, এই পাঠ তোমাকে পথ দেখাবে।”
লীলা খরগোশটিকে কোলে তুলে নিল। তারপর দুলটি শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করল। সে তার ঘরের কথা ভাবতে শুরু করল—তার বাবা-মা, ঠাকুরমা, গ্রামের সবুজ মাঠ, আর ছোট্ট কুটির। হঠাৎ, তার শরীরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। মনে হল যেন একটা উষ্ণ আলো তাকে ঘিরে ফেলেছে। যখন সে চোখ খুলল, সে দেখল সে তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। খরগোশটি তার পায়ের কাছে লাফালাফি করছিল, যেন এই যাদুকরী ঘটনায় সেও খুশি।
গ্রামের মানুষ তাকে দেখে হতবাক হয়ে গেল। তারা দৌড়ে এসে ঘিরে ধরল। “লীলা, তুমি কোথায় ছিলে? আমরা তো ভেবেছিলাম তুমি হারিয়ে গেছ!” একজন জিজ্ঞাসা করল।
লীলা হেসে সবাইকে শান্ত করল। তারপর সে তার গল্প শুরু করল। “আমি জাদুকরী বনে গিয়েছিলাম। সেখানে আমি অনেক বিপদ পার করেছি, অনেক বন্ধু পেয়েছি—পরী, দানব, আর এই খরগোশ। আমি বনের রাজার সামনে দাঁড়িয়েছি। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন যে সাহস আর বন্ধুত্ব সব পারে। এই শক্তি আমাকে ফিরিয়ে এনেছে।”
গ্রামের মানুষ মুগ্ধ হয়ে তার গল্প শুনল। তারা বুঝল যে লীলা শুধু সাহসী নয়, জ্ঞানীও। তার গল্পে তারা নিজেদের জীবনের পাঠ খুঁজে পেল। কেউ কেউ বলল, “তুমি আমাদের গর্ব, লীলা।”
এইভাবে, লীলার জাদুকরী যাত্রা শেষ হল। কিন্তু তার শেখা পাঠগুলো তার সাথে চিরকাল থাকবে। সে জানে, জীবনে যত বড় বিপদই আসুক, সাহস আর বন্ধুত্বের শক্তি তাকে সবকিছু জয় করতে সাহায্য করবে। গ্রামে ফিরে সে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেল, কিন্তু তার চোখে এখন একটা নতুন আলো। সে বুঝেছে, প্রকৃত জাদু কোনো মন্ত্রে নয়, বরং হৃদয়ের শক্তিতে।