রচনা - সুরজিৎ রায় || গল্পপাঠে - সুমনা নাগ
অধ্যায় ১: ছোট্ট গর্তের শান্ত বাসা
বাংলা ছোটদের রূপকথার ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
একটা দেয়ালের গা ঘেঁষে ছিলো এক ছোট্ট ইঁদুরের গর্ত। সেই গর্তে থাকতো দুই ভাই—বড় ভাই মিঠু আর ছোট ভাই মিলু। মানুষদের বেডরুমের দেয়ালের ভেতরে এমন একটা জায়গা ছিলো যেখানে সারাদিন আলো-ছায়া খেলা করতো, আর রাত হলে নেমে আসতো নিঃশব্দ নিস্তব্ধতা। এই নিস্তব্ধতা ওদের সবচেয়ে প্রিয় ছিল। কারণ, তখন ওরা দুই ভাই একসঙ্গে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তো নরম, তুলোর মতো বিছানায়। মিঠু নিজের হাতে বানিয়ে রেখেছিলো সেই বিছানা, পুরনো সোয়েটারের সুতোর টুকরো, তুলো আর নরম কাগজ মিশিয়ে।
মিলু ছিল ছোট, কৌতূহলী আর খুবই স্বপ্নবাজ। সে সবসময় মজার সব কল্পনায় ডুবে থাকতো। আর তার সবচেয়ে প্রিয় স্বপ্ন ছিলো—চীজের পাহাড়! বিশেষ করে হলুদ, ঘ্রাণে ভরা চেডার চীজ। প্রতিরাতে সে চোখ বন্ধ করেই পৌঁছে যেতো তার কল্পনার চীজ-রাজ্যে। কখনো সে চীজের ওপর লাফাচ্ছে, কখনো সেটা কামড়ে খাচ্ছে, আবার কখনো মিঠুকে ডেকে বলছে, “এই দেখো ভাই, পুরোটা আমার!”
কিন্তু সমস্যা হতো একটা জায়গায়। সেই ঘুম ভাঙিয়ে দিতো বড় ভাই মিঠুর গর্জনের মতো নাক ডাকা। কখনো সেটা হালকা ফিসফিসে, আবার কখনো যেন কেউ হাসছে, আবার কখনো মনে হতো পুরো গর্তটাই কাঁপছে! মিলু কখনো চোখ কচলে উঠে বসে থাকতো, কখনো প্যাঁচ মেরে মাথার ওপরে কাপড় চাপা দিয়ে আবার ঘুমোনোর চেষ্টা করতো। বেশিরভাগ রাত সে মানিয়ে নিতো। কিন্তু বিশেষ করে যখন তার স্বপ্নে একটা বিশাল চীজের টুকরো তার সামনে ঠিক উঠে আসতো, তখনই হঠাৎ মিঠুর এক জোরালো ঘন ঘন নাক ডাকার শব্দে মিলু গড়গড়িয়ে জেগে উঠতো!
এক রাতে এমনই একটা স্বপ্নের মাঝে হঠাৎ চোখ খুলে বসে পড়ে মিলু। তার মনে হলো—”না, আর নয়। আমি বড় হচ্ছি। নিজের একটা শান্ত জায়গা দরকার আমার। যেখানে কেউ নাক ডাকবে না, কেউ ঘুম ভাঙাবে না। শুধু আমি আর আমার চীজের স্বপ্ন!”
পরদিন সকালে, সূর্যের আলো ঠিক করে আসেনি তখনও, মিঠু আরাম করে তার কাঁথা টেনে ঘুমোচ্ছিলো। মিলু ধীরে ধীরে উঠে বসল। বিছানা গুছিয়ে নিয়ে, দুটো কাগজের টুকরোয় বানানো কৌটোয় রাখা শুকনো রুটি খেতে খেতে সে মিঠুর দিকে তাকিয়ে বললো, “ভাইয়া, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি আজই বেরোবো—নিজের একটা গর্ত খুঁজে নেবো। আমি এখন অনেক বড় হয়েছি। আর একটা ছোট ভাই হিসেবে তোমার জায়গা দখল করে থাকবো না।”
মিঠু একটু হেঁসে চোখ খুলে তাকালো। তার ছোট ভাইয়ের চোখে সাহস আর কৌতূহল দেখে সে গর্বে ভরে উঠলো। গলায় নরম সুরে বললো, “যাও মিলু, খুঁজে দেখো তোমার নিজের জগৎটা কেমন। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো—এই গর্তে সবসময় তোমার জন্য একটা বিছানা থাকবে। তুমি যখন খুশি ফিরে আসতে পারো।”
এই কথা শুনে মিলুর বুক ভরে উঠলো আনন্দে। মিঠুকে জড়িয়ে ধরলো সে। তারপর গর্তের মুখে এসে থামলো। বাইরে তাকিয়ে দেখলো বিশাল ঘরটা। মানুষের ছড়ানো খেলনা, কার্পেটের সাঁকো, আসবাবের বন—সব মিলিয়ে ওর জন্য যেন এক বিশাল অভিযান অপেক্ষা করছে। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস নিয়ে মিলু মনে মনে বললো, “আমি পারবো। আমি আমার স্বপ্নের মতো একটা গর্ত খুঁজেই নেবো।”
এই কথা ভেবেই সে তার ক্ষুদে পা দুটো মেঝেতে ফেললো, আর শুরু হলো মিলুর সাহসিকতার যাত্রা—নতুন গর্তের খোঁজে, শান্তির খোঁজে, আর অবশ্যই—চীজের স্বপ্নের খোঁজে।
ছায়া, আলো, আর এক ফোঁটা অন্ধকার - বাংলা রোমান্টিক ছোট গল্প: ভয়, প্রেম আর অতৃপ্ত আত্মার রহস্যে মোড়া এক অনন্য রোমান্টিক বাংলা ছোট গল্প। ঈশান ও অন্বেষার জীবনে ঘটে যাওয়া এক রাত বদলে দেয় সবকিছু। এখনই পড়ুন এই ভৌতিক প্রেম কাহিনি! সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ২: খেলনার গোলকধাঁধা
বাংলা ছোটদের রূপকথার ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
মিলু নিজের ছোট্ট গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে নতুন গর্তের খোঁজে। তার পায়ের নিচে নরম কার্পেট, মাথার ওপরে উঁচু উঁচু আসবাবপত্রের ছায়া। চারদিকে সবই বিশাল! মানুষদের দুনিয়া একেবারে যেন এক রাজ্য, আর মিলু সেখানে একটা ছোট্ট রাজদূত।
সামনেই ছিলো মানুষের বাচ্চার ঘর। দরজাটা অল্প খোলা, আর ভেতরে থেকে আসছিলো হালকা আলো। মিলু ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকলো। ঘরের মেঝে ছিলো একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো—রঙিন প্লাস্টিকের ব্লক ছড়িয়ে ছিটিয়ে, লাল-নীল-হলুদ রঙের খেলনা গাড়িগুলো লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক যেন কোনো ছোটখাটো যানজট।
“উফ্! কি বিশৃঙ্খলা!” নিজের গোঁফ ঘষে ভাবলো মিলু। সে কিন্তু নিজের জায়গাটা সবসময় গুছিয়ে রাখে। এই জগাখিচুড়ি তার একদম পছন্দ না। মিঠু তাকে শিখিয়েছিল, “ঘুমনোর জায়গা যত ছোটই হোক, সেটা পরিপাটি হলে তবেই শান্তি মেলে।”
তবু, আজ মিলু কিছুতেই থামবে না। সে ঠিক করেছে, নিজেই খুঁজে নেবে নিজের গর্ত। সেই গর্তে থাকবে না কোনো নাক ডাকানি, থাকবে না কারও ঘুমের শব্দ—শুধু তার নিজের নিঃশ্বাস, আর স্বপ্নে চীজের সুবাস!
মিলু আস্তে আস্তে খেলনার ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললো। একবার এক গাড়ির চাকায় আটকে গিয়ে গড়িয়ে পড়লো, আরেকবার একটা ছোট্ট পুতুলের পায়ের নিচে পিছলে গেলো। কিন্তু সে থামলো না। ছোট পা দুটো দিয়ে, পুচকে দেহ নিয়ে, সে পেরিয়ে গেলো পুরো খেলনার গোলকধাঁধা।
ঘরটা পার করে সে ঢুকলো বসার ঘরে। ঘরটা আলোয় ঝলমল করছিলো, জানালার বাইরে রোদের আলো পড়ে কাঠের মেঝেতে উষ্ণ একটা ছায়া ফেলছিলো। মিলুর ছোট্ট পা গুনগুন করে শব্দ করছিলো—“টিক্ টিক্ টিক্”—যখন সে পার হচ্ছিলো খোলা মেঝে।
হঠাৎ, সে থেমে গেলো।
সামনে, বড় একটা নরম সোফার ঠিক পেছনে, দেয়ালে একটা গর্ত!
“এই তো!” মিলু আনন্দে লাফ দিয়ে উঠলো। গর্তটা একটু বড়, কিন্তু ভেতরে বেশ ছিমছাম। আলো এসে পড়ে না, তাই ঘরটা বেশ গাঢ় অন্ধকার। মিলুর মুখে ফুটে উঠলো স্বস্তির হাসি। “এই হবে আমার নতুন বাসা!”
সে ব্যস্ত হয়ে কাজে লেগে পড়লো। সোফার কোণের ভেতর হাতিয়ে হাতিয়ে পেলো কয়েকটা নরম পালক, কিছু তুলোর মতো কুণ্ডলী, আর ফেলে দেওয়া কাগজ। সব মিলিয়ে বানিয়ে ফেললো এক দারুণ বিছানা। যতটুকু জায়গা দরকার, ততটুকুই গুছিয়ে ফেললো। আর বাকিটা থাকলো খালি, ঠিক যেমন সে চায়।
সন্ধ্যা নামতে শুরু করলো। বাইরের আলো ফিকে হতে হতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো। মিলু জানে, ঘুমোনোর সময় হয়ে গেছে। সে সবসময় সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে—সেটাই তার নিয়ম। আজ যদিও মিঠু পাশে নেই, কেউ তাকে চাদর গায়ে দিচ্ছে না, কেউ বলছে না “শুভ রাত্রি, ছোটো ভাই”—তবু সে সাহস ধরে চোখ বন্ধ করলো।
বিছানায় শুয়ে মনে পড়লো পুরনো গর্তের কথা, মিঠুর ঘুমন্ত মুখ, আর তার মিষ্টি নাক ডাকানির আওয়াজ। আশ্চর্যভাবে আজ সেই শব্দটাই যেন একটু মিস করছে সে।
তবে মিলু জানে, সে বড় হচ্ছে। এখন নিজেকে প্রমাণ করতে হবে—একাই থাকতে শিখতে হবে। তাই সে বুক শক্ত করে শুয়ে রইলো। বাইরে যেন অনেক দূরে কারো কথা বলার আওয়াজ, কোথাও টিভির শব্দ। কিন্তু তার গর্ত বেশ নিরিবিলি।
মিলু চোখ বন্ধ করে ফেললো। আজ তার প্রথম রাত নতুন বাসায়।
আর মনে মনে ভাবলো—
“এটাই হয়তো আমার নতুন স্বপ্নের গর্ত…”
অধ্যায় ৩: শব্দের রাজ্যে ঘুম
বাংলা ছোটদের রূপকথার ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
মিলু তখন চোখ বন্ধ করে গভীর ঘুমে যাবার ঠিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নরম পালকের বিছানায় শরীরটা গুটিয়ে মিঠুর কথা মনে করেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে মাত্র, এমন সময়—
“ধাম ধুম!”
“আরে বলছি তো, ওই ম্যাচটা…!”
“হাসান! ভলিউমটা একটু কমাও তো!”
হঠাৎ করে চারপাশ কেঁপে উঠলো নানা রকমের কোলাহলে।
মিলুর চোখ বড় হয়ে গেল।
“উফ্! এটা আবার কি? মিঠুর নাক ডাকা তো কিছুই না এর তুলনায়!”
সে গর্ত থেকে উঁকি দিয়ে দেখলো, বসার ঘরের সোফায় বসে আছে পুরো পরিবার—মা, বাবা, আর দুই বাচ্চা। টিভি চলছে জোরে, কেউ খাচ্ছে চিপস, কেউ হাসছে জোরে জোরে, কেউ আবার একদম সোফার পেছনে উঠে এসেছে—মানে মিলুর গর্তের একদম গায়ে!
“এইখানে তো ঘুমানোই যাবে না!” মনে মনে গজগজ করলো মিলু।
সে কিছু না ভেবে ছুটে বেরিয়ে পড়লো সেই গর্ত থেকে। ছোট পা-দুটো মেঝের ওপর “টিক টিক” করে শব্দ করছে, আর কার্পেটের বাইরে টালি মেঝেতে গেলে হল “টুপ টাপ”—একেবারে জলপড়ার মতো শব্দ!
“এত শব্দ! এত আলো! এত লোক!” মিলুর মাথা ঘুরে গেল। সে জানে, যদি না ঘুমায়, তাহলে আগামীকাল তার চীজ খাওয়ার স্বপ্নটাও ভেস্তে যাবে।
তাই এবার সে ছুটে গেল রান্নাঘরের দিকে। ঘরটা তুলনামূলকভাবে একটু নিঃশব্দ। আলো কম, আর মানুষের পা চলাচলও তেমন নেই।
রান্নাঘরের কোণায় সে পেল একটা নতুন গর্ত—ফ্রিজের পেছনে। ফ্রিজের গায়ে গরম গরম বাতাস বের হচ্ছিলো, আর ভেতরটা বেশ আরামদায়ক লাগছিলো।
“এই তো! এবার নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাবে!” বলে মিলু তৎপর হয়ে উঠলো।
সে কিচেন টিস্যু খুঁজে খুঁজে নিয়ে এলো—একটু খসে পড়া টিস্যু, একটা টুকরো সুতির কাপড়, আর কয়েকটা শুকনো পেঁয়াজের খোসা (যা পরে সে বাদ দিয়েছিল, কারণ গন্ধটা বড় ঝাঁঝালো!)—সব মিলিয়ে বানিয়ে ফেললো একটা নরমসরম বিছানা।
ঘাড় গুটিয়ে, হাত পা গুটিয়ে, মিলু আবার শুয়ে পড়লো। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলেছিলো, ঠিক তখনই—
“ঠক ঠক!”
“ঝর ঝর ঝর…”
“ছপ ছপ ছপ!”
মিলু চমকে উঠলো।
“এইবার আবার কি?”
সে গর্ত থেকে উঁকি দিয়ে দেখলো, একজন মানুষ বাসন মাজছে। টিনের বাটিতে বারবার পানি পড়ছে, চামচ-ফোর্ক ঠুকে ঠুকে বাজছে এক অদ্ভুত সুরে।
“আহা! আবার ঘুম গেল!” মুখটা কুঁচকে গেল মিলুর।
এবার আর রাগ চেপে রাখতে পারলো না। গোঁফ ঝাঁকিয়ে বললো,
“এ তো একেবারে শব্দের রাজ্য! এখানে কি কেউ একটু চুপচাপ থাকতে পারে না? কেউ কি ঘুমোতে চায় না?”
সে বুঝলো, রান্নাঘরের এই গর্তও তার শান্ত ঘুমের জায়গা হতে পারবে না।
কিন্তু মিলু হতাশ হলো না। সে জানে, নতুন ঘর খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। মাঝে মাঝে ঘর পাল্টাতে হয়, মাঝে মাঝে কষ্টও হয়, কিন্তু মিঠুর একটা কথা মনে পড়লো—
“যেখানেই যাও, নিজের শান্তিটুকু নিজের মতো করেই খুঁজে নিতে হবে।”
মিলু আবার পিঠে তার ক্ষুদে ব্যাগটা বাঁধলো, মুখে একটা ছোট্ট হাসি এঁকে নিলো, আর বললো,
“আচ্ছা, দেখা যাক এবার কোথায় যাওয়া যায়!”
রাতের আকাশের নিচে, রান্নাঘরের ফাঁকা ছায়ার ভেতর দিয়ে মিলু আবার ছুটলো—
নতুন ঘরের খোঁজে, নতুন স্বপ্নের পেছনে।
কথা বলা তালগাছ - ছোটদের রূপকথার গল্প: টুকাইয়ের ছোটদের গল্প, যা রূপকথার গল্পের মতো সত্য, দয়া এবং বন্ধুত্বের শক্তি নিয়ে। এক অদ্ভুত গাছের সাহায্যে তার জীবনের নতুন যাত্রা শুরু হয়। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৪: ওপরে উঠে নতুন আশা
বাংলা ছোটদের রূপকথার ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
মিলু থেমে দাঁড়িয়ে ভাবলো, “নিচের সব ঘরেই মানুষজন, আলো আর শব্দে ভরা। তাহলে উপরের দিকেই যাই না কেন? সেখানেই হয়তো শান্তি আছে।”
ছোট্ট ব্যাগটা গাঁয়ে বেঁধে সে রওনা দিলো সিঁড়ির দিকে। প্রতিটি ধাপ যেন এক বিশাল পাহাড়। তার ছোট পা দুটো হাপরে উঠলো, কিন্তু সে থামলো না। মুখে ছিলো দৃঢ় সংকল্প—“আমি নিজের জন্য একটা নিঃশব্দ, শান্ত বাসা খুঁজবই!”
এক ধাপ… দুই ধাপ… সিঁড়ির রেলিং ধরে একরকম টেনে টেনে সে পৌঁছালো ওপরতলায়। উপরের করিডোরটা ফাঁকা। হালকা আলোয় মিলু দেখলো, একটা দরজা আধখোলা। ভেতরটা অন্ধকার আর ঠান্ডা।
“এই তো! এখানে নিশ্চয় কেউ নেই!” মনে মনে আনন্দে লাফ দিলো সে।
ধীরে ধীরে মিলু ঢুকে পড়লো ঘরটায়। এটা ছিলো বাথরুম। কিন্তু মিলু তো মানুষের জগৎের নিয়মকানুন জানে না! তার কাছে ঘর মানেই—একটা শান্ত কোণ, একটুখানি নরম বিছানা, আর ঘুমের মতো মিষ্টি স্বপ্ন।
ঘরের এক কোণে সে খুঁজে পেল একটা জামাকাপড় রাখার ঝুড়ি। ঝুড়ির পেছনে অন্ধকার, আর দেয়ালে একটা ছোট গর্ত।
“এটাই হবে আমার নতুন গর্ত!” মুখে ছোট্ট একটা হাসি ফুটে উঠলো মিলুর।
সে ঝুড়ির নিচ থেকে বের করলো কয়েকটা তুলোর বল—হয়তো কারও কান পরিষ্কারের কাজে ব্যবহৃত ছিলো, মিলুর কাছে এগুলোই রাজকীয় গদি। তার ছোট্ট হাত দিয়ে সে এগুলো এক করে বানিয়ে ফেললো এক আরামদায়ক বিছানা।
সব কিছু গুছিয়ে সে শুয়ে পড়লো। শরীরটা গুটিয়ে ফেললো, চোখ বন্ধ করলো, একটা দম নিয়ে মিঠুর স্মৃতিকে জড়িয়ে ধরলো।
ঠিক তখনই…
“ঝর ঝর… ঝপ ঝপ… ছপ ছপ…”
মিলুর কান টানটান হয়ে উঠলো।
“আবার শব্দ! এবার কি?”
সে ধীরে ধীরে গর্ত থেকে উঁকি দিয়ে দেখলো—বাথরুমের ঝরনা থেকে পানি পড়ছে। কেউ একজন স্নান করছে। পানির ধারা একটানা চলেছে, কখনো জোরে, কখনো আস্তে।
মিলু ভ眉 করে বললো,
“এই শব্দটা অবশ্য মিঠুর নাক ডাকার মতো বিরক্তিকর নয়। একটু শান্ত, একটু সুরের মতো। কিন্তু… ঘুমাতে হলে একেবারে নিঃশব্দ জায়গা দরকার।”
সে বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো। “বৃষ্টি পড়ার মতো এই শব্দটা শুনতে খারাপ না। কিন্তু যদি কেউ আবার দরজা খুলে ঢোকে, কিংবা গা ধোয়ার ফাঁকে ঝুড়ি নেড়ে ফেলে—তাহলে তো গর্তটাই উধাও হয়ে যাবে!”
নিঃশব্দে সে উঠে বসলো।
চোখে ছিলো একটু ক্লান্তি, কিন্তু মনের ভেতর ছিলো নতুন শক্তি।
“না, এখানেও নয়। শান্ত ঘর খুঁজতে গেলে আমাকে আরও ওপরে যেতে হবে—হয়তো ছাদে? হাওয়ার নিচে? তারা-র আলোয়?”
মিলু আবার তার ক্ষুদে ব্যাগটা গায়ে বাঁধলো। চোখে ছিলো ঝিমুনিভরা রোদ, কিন্তু পায়ে ছিলো আগামির আশা।
সে ধীরে ধীরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো, করিডোর পেরিয়ে ছাদের দিকে যে সিঁড়ি উঠে গেছে, সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো।
“এবারের খোঁজটা হবে একটু আলাদা। এবার শুধু একটা গর্ত না—আমি খুঁজবো এমন একটা জায়গা, যেখানে মনটাও শান্ত থাকবে।”
তার পায়ের নিচে ধাপে ধাপে শব্দ হলো—
“টিক… টিক… টিক…”
মিলু ছাদের দিকে উঠতে লাগলো—যেখানে বাতাস অপেক্ষা করছিলো এক সাহসী, একা ইঁদুরের জন্য।
ধোঁয়াশা - সত্য ঘটনা: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর গায়েব হওয়া ঘিরে রহস্য! তিনি কি আজও বেঁচে? ফিরে আসবেন? পড়ুন সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা বাংলা ছোট গল্প "ধোঁয়াশা"—এক গভীর প্রশ্নের উত্তরে যাত্রা। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৫: ঘরে ফেরার আনন্দ
বাংলা ছোটদের রূপকথার ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
অনেক খোঁজাখুঁজি, দৌড়াদৌড়ি আর চেষ্টা করার পর মিলু অবশেষে ফিরে এলো সেই পরিচিত পুরোনো ঘরে—যেখানে দেয়ালের কোণে ছিলো তার ছোট্ট গর্ত, যেখানে ছিলো মিঠু, আর ছিলো তার নরম তুলোর বিছানা।
বাচ্চার ঘরটা এখন একেবারে বদলে গেছে। মেঝে আর ততটাও বিশৃঙ্খল নয়। খেলনাগুলো গুছিয়ে রাখা, গাড়িগুলো সারি করে সাজানো, আর রঙিন ব্লকগুলো ঠোঙার মতো এক কোণে রাখা। মনে হচ্ছিলো যেন কেউ খুব যত্ন করে সব কিছু ঠিকঠাক করে রেখেছে।
মিলু ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো গর্তের দিকে। ছোট্ট হৃদয়টা কেমন করে উঠলো।
গর্তের ভেতর ঢুকে সে অবাক হয়ে গেলো—তার প্রিয় বিছানা একটুও বদলায়নি! সেই তুলোর মতো নরম, একটুও ধুলোবালি নেই। পাশে একটা ছোট চীজের টুকরোও রাখা! যেন কেউ জানতো—মিলু ফিরে আসবেই।
মিঠু তখন ঘুমাচ্ছিল। তার নাক থেকে আসছিলো সেই পরিচিত ঘোঁর ঘোঁর শব্দ।
মিলু হাঁফ ছেড়ে বললো,
“এটাই আমার ঘর। এখানেই শান্তি, এখানেই ঘুম।”
মিঠু ধীরে ধীরে চোখ খুললো। প্রথমে যেন কিছু বুঝতে পারলো না, তারপর মিলুকে দেখে মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠলো।
সে খুশিতে বললো,
“তুই ফিরে এসেছিস? আমি জানতাম তুই ফিরবি।”
মিলু মাথা নেড়ে হেসে বললো,
“আজ অনেক কিছু দেখলাম, খেলনার মধ্যে হাঁটলাম, টিভির শব্দ সহ্য করলাম, রান্নাঘরে লুকোলাম, এমনকি ছাদে গিয়েও ঘর খুঁজলাম। কিন্তু… নিজের ঘরের মতো জায়গা আর হয় না।”
মিঠু উঠে পড়লো। তার ছোট্ট কাঠের বাক্স থেকে বের করলো এক টুকরো পাউরুটি আর একটা পাতলা চীজের টুকরো। সেটা মিলুর দিকে বাড়িয়ে বললো,
“তোর জন্য স্যান্ডউইচ বানালাম। একদম গরম গরম!”
মিলুর চোখ আনন্দে চকচক করে উঠলো। সে চীজ স্যান্ডউইচ হাতে নিয়ে এক কামড় দিলো—স্বাদ যেন ঠিক স্বপ্নের মতো!
পেট ভরে খাওয়ার পর মিলু আবার তার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। মিঠু পাশেই ছিলো। বাইরে রাত গভীর, বাতাসে হালকা ঠাণ্ডা, আর ঘরের ভেতর একটানা নাক ডাকার সেই শব্দ—এবার আর বিরক্তিকর নয়, বরং শান্তির সুরের মতো।
মিলুর চোখ বন্ধ হয়ে এলো। সে হাসলো, মনে মনে ভাবলো,
“জীবনে অনেক নতুন জায়গা থাকতে পারে, অনেক রকম অ্যাডভেঞ্চার হতে পারে, কিন্তু রাতে ঘুমের জন্য নিজের ঘরের মতো কিছুই হয় না।”
তার স্বপ্নে আবার সেই চেনা চীজের পাহাড়, নরম বিছানা, আর একখানা আলো ঝলমলে চাঁদ, যেখানে ইঁদুররা দোল খায়, ঘুমায় আর গান গায়।
মিঠুর ঘোঁরঘোঁর শব্দ যেন লোরির মতো বাজতে লাগলো।
মিলু একটু গুটি মেরে বললো,
“এই হোক আমার রাজ্য, আমার শান্তি, আমার ঘর।”
আর সে চুপচাপ, শান্ত মনে ঘুমিয়ে পড়লো—একটা চীজের স্বপ্নে ভেসে।