রচনা - সুরজিৎ রায় || গল্পপাঠ - কৌশিক সাহা, মৌমিতা সাহা, সৌরভ মণ্ডল, বুবাই সাহা, বর্ণালী সংগীত - সৌরভ মণ্ডল শব্দগ্রহণ || নির্মাণ ও পরিচালনায় - মিহান'স প্রোডাকশন হাউস
অধ্যায় ১: কুয়াশার আড়ালে
বাংলা রহস্য রোমাঞ্চ ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
স্থান: সোনাগাছি যৌনপল্লী, সময়: সন্ধ্যে ৮ টা
ইশান: নমস্কার, আমি ইশান। আমি সমাজবিজ্ঞানের উপর গবেষণা করছি। আপনি যদি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তবে আমি আপনার জীবন ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই।
যৌনকর্মী: (হালকা হাসি) বাবু, আমাগো জীবন নিয়া কি জানতে চান? আমরা তো সমাজের অপৃশ্য মানুষ!
ইশান: সমাজ আপনাকে দেখলেও, আপনাকে বোঝে না। আমি চাই, আপনার কণ্ঠস্বর শোনা যাক। কেমন ছিল আপনার শৈশব?
যৌনকর্মী: শৈশব! ওটা তো বহু আগেই ফুরায় গেছে। নদীয়া জেলার গাঁয়ের মেয়ে আমি। বাবা ছিল দিনমজুর, মা গৃহস্থের বাড়িতে কাজ করত। খুব গরিব সংসার। স্কুলে যাইতে চাইতাম, কিন্তু টাকার জোগাড় হয় না।
ইশান: তাহলে কীভাবে এই পেশায় আসতে হলো?
যৌনকর্মী: (একটু চুপ থেকে) আমার বিয়ের বয়স হয়েছিল মাত্র ১৪, আর ১৫-তেই বিধবা হলাম। শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল, বাবার ঘরেও জায়গা হলো না। তারপর এক আত্মীয়ের কথায় শহরে আসলাম চাকরির আশায়। কিন্তু সে-ই আমায় বিক্রি করে দিল। তখন বুঝলাম, গরিব মেয়েদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাম নাই।
ইশান: এই জীবনে অভ্যস্ত হতে কতদিন লেগেছিল?
যৌনকর্মী: কেউ কি সত্যি অভ্যস্ত হয় বাবু? প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হইতো, মনে হইতো মইরা যাই। কিন্তু ক্ষিদে তো আর দয়া করে না!
ইশান: আপনি কি এই জীবন থেকে বের হতে চেয়েছেন কখনো?
যৌনকর্মী: অনেকবার। কয়েকবার পালাইতে গেছিলাম, কিন্তু ফিরতে হইছে। সমাজ আমাদের কুনো কাজ দেয় না, কুনো সম্মান দেয় না। দিনের শেষে আমরা শুধুই একটা ‘গরিব মেয়ে’ যাদের শরীরের বাইরে কিছু নাই।
ইশান: আপনার কাছে সমাজ কীভাবে দেখায়?
যৌনকর্মী: সমাজ আমাগো দেখে না, বাবু। আমাগো কথা শুনতে চায় না। রাস্তায় চলতে গেলে মানুষ গা বাঁচায়, অথচ রাইতে আবার এলে লজ্জা পায় না। এই সমাজ চাইলে আমাগো বাঁচাতে পারতো, কিন্তু ওরা শুধু বিচার করতে পারে।
ইশান: যদি আপনাকে বিকল্প জীবন দেওয়া হয়, কী করতেন?
যৌনকর্মী: (হেসে) স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি অনেক দিন! তবু যদি পারতাম, ছোটো মেয়েদের শেখাতাম কেমনে এই ফাঁদ থেকে বাঁচতে হয়।
ইশান: আপনার কি মনে হয় সমাজ আপনাদের প্রতি অন্যায় করছে?
যৌনকর্মী: বাবু, এই সমাজের নিয়মটাই এমন। যারা উপরে থাকে, তারা ঠিক করে কে নিচে থাকবে। আমাগো লড়াই শুধু বাঁচার জন্য, সম্মানের জন্য না।
ইশান: আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ, আপনি এত কিছু শেয়ার করলেন।
যৌনকর্মী: (একটু চুপ থেকে) বাবু, আমাগো কাহিনি লেখলে সমাজ বদলাবে?
ইশান: আমি নিশ্চিত নই, তবে আমি চাই মানুষ অন্তত আপনাদের সত্যিটা জানুক।
পিছনের রাস্তার আলো একটু ঝাপসা হয়ে আসে। দূরে কোনো এক কোণে আরেকটি কন্যাসন্তান নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে, যেন অতীত আর ভবিষ্যৎ একসাথে মিশে গেছে।
ইন্টারভিউ শেষ করে ঈশান ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল যৌনকর্মীর বলা কথাগুলো। “আমাগো কথা কেউ শুনতে চায় না, বাবু,”—এই বাক্যটা কানের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল বারবার। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে সে চারপাশে তাকালো। বাইরে অনেকজন যৌনকর্মী দাঁড়িয়ে আছে। কেউ পান চিবোচ্ছে, কেউ আবার তার কাস্টমারকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, আর কেউ চুপচাপ দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে।
এই জায়গাটা দিনের আলোয় এক রকম, আর রাতে পুরোপুরি ভিন্ন। রাতের আঁধারে এখানে জীবনের অন্য রূপ দেখা যায়—একটা বাস্তবতা, যা সমাজ দেখেও দেখাতে চায় না। ঈশান পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো, যদিও সে নিয়মিত ধূমপান করে না। আজ কেন যেন মনে হলো ধোঁয়ার মধ্যে চিন্তাগুলো হারিয়ে যাক।
ধীর পায়ে হেঁটে সে সোনাগাছির সরু গলি পেরিয়ে মূল রাস্তায় এলো। এখানে বাতাস তুলনামূলক পরিষ্কার, কিন্তু মাথার মধ্যে একটা ভারী অনুভূতি রয়ে গেছে। সে হাঁটতে লাগলো, গন্তব্য গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশন।
রাস্তার হলুদ আলো আর হালকা কুয়াশার মাঝে পরিবেশটা বেশ সুন্দর হয়ে উঠেছিল। রাত বাড়লেও কলকাতার ব্যস্ততা শেষ হয়নি, এখনো ট্রাম চলছে, কিছু খাবারের দোকান খোলা, কিছু রিকশাওয়ালা ক্লান্ত হয়ে নিজেদের গামছা দিয়ে মুখ মুছছে।
ঠিক সেই সময়, রাস্তার ভিড়ের শব্দের মাঝেও ঈশানের কানে এলো এক সুরেলা কণ্ঠ। কোনো এক নারী একলা বসে গান গাইছে। গানটা খুব পরিচিত মনে হলো—একটা পুরনো বাংলা লোকগান, যার সুর বিষাদমাখা, কিন্তু তাতে এক ধরনের গভীর মায়া লুকিয়ে আছে।
“তোমার ঘরে বাস করে কারা ও মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।
তোমার ঘরে বাস করে কারা ও মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।”
ঈশান একটু থমকে দাঁড়ালো। উৎস খুঁজতে চোখ ঘোরালো চারপাশে। রাস্তার পাশে, মেট্রো-স্টেশন এর একটু আগে ফুটপাতের এক কোণে একটা বেঞ্চে লাল শাড়ি পরা একজন মহিলা বসে আছে। বয়স বেশি নয়, এই ২৩-২৪ হবে। কিন্তু মুখের রেখায় অনেক গল্প লেখা আছে। সে আপনমনে গাইছে, যেন কেউ তাকে শুনুক বা না শুনুক, তাতে কিছু যায় আসে না।
ঈশানের পা অজান্তেই তার দিকে এগিয়ে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ শুনলো। গানের মধ্যে এক ধরনের বেদনা ছিল, যেন কোনো হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের সুর।
“এক জনে ছবি আঁকে এক মনে ও মন,
আরেক জনে বসে বসে রঙ মাখে ও মন।
এক জনে ছবি আঁকে এক মনে ও মন
আরেক জনে বসে বসে রঙ মাখে
হ আবার সেই ছবিখান নষ্ট করে
কোন-জনা, কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।”
“গানটা ভালো লাগলো আপনার?” মহিলা হঠাৎ গান থামিয়ে প্রশ্ন করলো।
ঈশান একটু চমকে গেল। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “হ্যাঁ, খুব সুন্দর গাইছেন।”
মহিলা একটু হেসে বললো, “সুন্দর? এই শহরে কত কিছুই সত্যিই সুন্দর আছে?”
ঈশান কিছু বলার জন্য মুখ খুললো, কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না।
ঈশান নিজেকে একটু সামলে নিয়ে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “আপনি কি এখানেই থাকেন?”
মহিলাটি ঈশানের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে একটু মুচকি হাসলো। তার হাসির মধ্যে ছিল একধরনের স্থিতধী আত্মবিশ্বাস, যেন এ ধরনের ভুল বোঝাবুঝি তার কাছে নতুন কিছু নয়। ঈশান খেয়াল করলো, আশেপাশেই কয়েকজন যৌনকর্মী দাঁড়িয়ে ছিল, যারা পথ চলতি মানুষদের ডাকছিল। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই মহিলাটিকে দেখে ঈশানের মনে হয়েছিল তিনিও হয়তো সেই একই পেশার কেউ।
মহিলাটি শান্ত স্বরে বললো, “আমি শ্যামবাজারে থাকি। মেট্রো ধরবো বলে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আপনি?”
ঈশান এক মুহূর্তের জন্য থতমত খেয়ে গেল। বুঝতে পারলো, একটা বিশাল ভুল করে ফেলেছে। তার কণ্ঠে অনুশোচনা ফুটে উঠলো, “সরি! আসলে…” কিন্তু বাক্যটা শেষ করার আগেই মহিলাটি হেসে বললো, “সরি বলার কিছু নেই। আপনি যা ভেবেছিলেন, সেটা একদম স্বাভাবিক। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা মানেই সবাই একই রকম, তাই না?”
ঈশান মাথা নিচু করলো। সত্যিই, তার এই ভুল ধারণা যেন সমাজের আর দশজনের মতোই সাধারণ হয়ে উঠেছিল।
মহিলাটি একটু থেমে বললো, “আপনি আসার আগে, কয়েকজন আমাকে পার নাইটের রেট জিজ্ঞেস করে চলে গেছে। তাদেরও দোষ দিচ্ছি না, এই জায়গার পরিচিতি তো এমনই।”
তারপর একটু হেসে বললো, “বাই দ্য ওয়ে, আমার নাম অন্বেষা। আপনার?”
ঈশান এবার একটু স্বস্তি পেল। তার মনে হলো অন্বেষা অন্যরকম, সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী আর স্পষ্টভাষী। সে একটু হেসে বললো, “আমার নাম ঈশান!”
বলেই সে অন্বেষার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। অন্বেষা ঈশানের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর হাত বাড়িয়ে দৃঢ়ভাবে করমর্দন করলো। ঈশানের মনে হলো, এই মুহূর্তটা যেন কেমন অদ্ভুতভাবে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন।
অন্বেষা বললো, “আপনার যদি তাড়া না থাকে, তাহলে এক কাপ চা খাওয়া যেতে পারে।”
ঈশান এক মুহূর্ত ভাবলো, তারপর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তারা দুজন পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। রাস্তার উজ্জ্বল হলুদ আলোর আভা তাদের পেছনে ফেলে তারা মেন্ রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল।
“আপনি এখানে কী করছেন?” অন্বেষা জিজ্ঞেস করলো, তার চোখে কৌতূহল।
ঈশান একটু ইতস্তত করে বললো, “আমি একজন সোসিওলজিস্ট। গবেষণার কাজে এসেছিলাম। যৌনকর্মীদের জীবন নিয়ে একটা গবেষণা করছি।”
অন্বেষা একটু হাসলো, বললো, “বাহ! গবেষণা করছেন! ভালো কথা। তাহলে আমাকে নিয়েও কিছু লিখবেন?”
ঈশান একটু হেসে বললো, “আপনার গল্পটা জানলে হয়তো লিখবো।”
অন্বেষা চায়ের কাপে চুমুক দিল, তারপর বললো, “আমার গল্প তেমন কিছু নয়। মধ্যবিত্ত পরিবার, সংসারের চাপ, নিজের মতো করে বাঁচার চেষ্টা, ব্যস!”
ঈশান শুনছিল, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল অন্বেষা যা বলছে তার চেয়ে অনেক বেশি গভীর কিছু লুকিয়ে আছে তার জীবনে।
“আপনি কী করেন?” ঈশান এবার পাল্টা জিজ্ঞেস করলো।
অন্বেষা একটু হাসলো, “আমি একটা বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে কাজ করি। আর অফ টাইম এ রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে বেড়াই। (একটু জোরে হেঁসে)”
“এখানে! মানে আসে পাশেই কি আপনার অফিস?”
অন্বেষা বললো, “না! আমার অফিস সল্টলেকে। আজ কি যেন মনে হলো তাই এখানেই নেমে পারলাম।”
ঈশান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো।
তারপর বললো, “আমার মনে হয়, আমি আপনাকে ভুল বোঝার জন্য আবারও দুঃখিত।”
অন্বেষা হেসে বললো, “এতবার দুঃখিত হতে হবে না। বরং, সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর চেষ্টা করুন। তাহলেই ভালো কিছু হতে পারে!”
ঈশান চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিলো। অন্বেষার কথা আজকের রাতের আলোয় তার মনে গভীরভাবে গেঁথে গেল। ওরা দুজনে চা শেষ করে দাম মিটিয়ে মেট্রো স্টেশন এর দিকে এগিয়ে গেল।
কথা বলা তালগাছ - ছোটদের রূপকথার গল্প: টুকাইয়ের ছোটদের গল্প, যা রূপকথার গল্পের মতো সত্য, দয়া এবং বন্ধুত্বের শক্তি নিয়ে। এক অদ্ভুত গাছের সাহায্যে তার জীবনের নতুন যাত্রা শুরু হয়। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ২: ছায়ার সন্ধান
বাংলা রহস্য রোমাঞ্চ ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
সেদিনের পর থেকে বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। ঈশান তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে—গবেষণা, রিপোর্ট লেখা, ইন্টারভিউ নেওয়া—এই সবের মধ্যেই দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ব্যস্ততার মধ্যেও মাঝে মাঝে এক মুহূর্তের জন্য তার মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই সন্ধ্যাটা, সেই কথোপকথন, আর সেই এক কাপ চা।
একদিন রাতে ঈশান তার ডেস্কে বসে কাজ করছিল। গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে হঠাৎই একটু বিরতি নিল। ইউটিউবে বাংলা লোকগীতি শুনতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর, অটো-প্লে অন থাকার জন্য “তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা” গানটি বেজে উঠলো।
সুরটা যেন হঠাৎই ঈশানের মনকে এক অদ্ভুত নস্টালজিয়ার ঘেরাটোপে নিয়ে গেল। তার কাজ করার মনোযোগ এক নিমেষেই ভেঙে গেল। সে চেয়ার ছেড়ে পিছনে হেলান দিল, চোখ বন্ধ করলো আর গানের সুরে ডুবে গেল। অন্বেষার সেই গলায় গাওয়া গানটার কথা মনে পড়ে গেল তার।
সেদিন তারা অনেকক্ষণ একসাথে সময় কাটিয়েছিল। অন্বেষার হাসি, তার চোখের ভাষা, তার আত্মবিশ্বাসী অথচ কোমল কণ্ঠ—সবকিছু যেন মনে পড়ে যেতে লাগলো। যদি সেদিন সে অন্বেষার নাম্বারটা নিয়ে আসতো, তাহলে আজ তাকে খুঁজে পাওয়া কত সহজ হতো!
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা ভাবনা এল মাথায়—এভাবে বিনা কারণে কারও নাম্বার চাওয়া কি ঠিক হতো? হয়তো অন্বেষা ভুল বুঝতো!
তবুও মনকে শান্ত করতে পারলো না ঈশান। তার মনে হতে লাগলো, সে যদি আবার অন্বেষার সাথে দেখা করতে পারতো! কিন্তু কীভাবে? না আছে মোবাইল নম্বর, না জানে সে কোথায় কাজ করে, না জানে তার বাড়ির ঠিকানা!
তারপরও একরকম অদ্ভুত আশা তার মনে উঁকি দিল। যদি আবার তাদের দেখা হয়ে যায়?
ঈশান ভাবলো, হয়তো আবার গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশনের কাছে গেলে সে অন্বেষার দেখা পেতে পারে। হতে পারে, সে আবার কোনো কাজে ওই জায়গায় এসেছে। নাকি সে প্রতিদিন সেই পথ দিয়ে যায়? ঈশান জানে না, তবুও সে ঠিক করলো, পরের দিন সন্ধ্যায় গিরিশ পার্কে যাবে।
হয়তো, কপাল ভালো হলে, আবারও সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে। আবারও একসাথে এক কাপ চা খাওয়ার সুযোগ হবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় ঈশান সোজা গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশনে পৌঁছে গেল। স্টেশন চত্বরের চায়ের দোকানগুলোতে ভিড় তখনও জমজমাট। সে প্রথমে একটা চায়ের দোকানে বসল, তারপর একের পর এক চার-পাঁচ কাপ চা খেয়ে সময় কাটিয়ে দিল।
একবার স্টেশন চত্বরে হাঁটল, একবার পাশের গলিগুলোয় উঁকি দিল। সোনাগাছির গলির দিকেও খানিকক্ষণ পায়চারি করল, যদিও জানত যে অন্বেষার সঙ্গে এই জায়গার কোনো সম্পর্ক নেই। তবুও তার মনে হচ্ছিল, হয়তো আবার হঠাৎ করেই কোথাও দেখা হয়ে যাবে।
কিন্তু সেদিন আর অন্বেষার দেখা পেল না ঈশান।
সময় গড়িয়ে রাত ১০টা বেজে গেল। স্টেশনের আলো একটু মলিন হয়ে এসেছে, পথচলতি মানুষের ভিড়ও কমে এসেছে অনেকটা। অবশেষে হতাশ হয়েই ঈশান বাড়ির পথ ধরলো।
এইভাবে টানা চার-পাঁচ দিন ঈশান সন্ধ্যার পর গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশনের সামনে এসে অপেক্ষা করলো। প্রতিদিন একই রুটিন—এক কাপ, দু’কাপ, তিন কাপ চা খাওয়া, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা, স্টেশনের সিঁড়িতে বসে থাকা, মাঝে মাঝে সোনাগাছির গলির ভেতর ঢুঁ মারা, আবার ফিরে এসে মেট্রোর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা।
কিন্তু প্রতিদিনই তাকে খালি হাতে ফিরে যেতে হলো।
দিনের পর দিন অপেক্ষার পর ঈশানের মনে একটা প্রশ্ন আসতে শুরু করলো—সে কি ভুল জায়গায় খুঁজছে?
অন্বেষা তো বলেছিল সে শ্যামবাজারে থাকে। যদি সে প্রতিদিন গিরিশ পার্ক মেট্রোর বদলে শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনে যেত? তাহলে কি তার খোঁজ পাওয়া যেত?
এই ভাবনাটা আসতেই ঈশান স্থির করলো, এবার সে শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনে যাবে।
কিন্তু একসঙ্গে আরেকটা দ্বন্দ্বও জন্ম নিল মনে। এত বড়ো কলকাতা শহরে, এই ভয়ানক ভিড়ের মধ্যে একজন মানুষকে খুঁজে পাওয়া কি আদৌ সম্ভব?
লজিক বলছিল, না। এটা অসম্ভব।
কিন্তু মন তো আর যুক্তি মানে না।
মন চাইছিল, সে যেভাবেই হোক অন্বেষার সঙ্গে আবার দেখা করুক। যেন তার সঙ্গে কথা না বলে, তার সেই গানের সুর না শুনে, ঈশান আর শান্তি পেতে পারছে না।
এদিকে দিন দিন ঈশানের মধ্যে এক অদ্ভুত আসক্তি জন্ম নিচ্ছিল। দিনে-রাতে বারবার ইউটিউবে গিয়ে শুনতে লাগলো সেই গান—”তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা”।
প্রতিবার গানটা বাজানো মাত্রই অন্বেষার মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠতো। মনে হতো, গানটার প্রতিটি শব্দ যেন তার মনের কথাই বলে দিচ্ছে।
এখন তার একটাই লক্ষ্য—অন্বেষাকে খুঁজে পাওয়া।
সকাল ঠিক ৭টা।
ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো করে জামা-কাপড় পরে ঈশান বেরিয়ে পড়ল শ্যামবাজার মেট্রোর দিকে। মনে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা। আজকেও কি খালি হাতে ফিরতে হবে? নাকি সত্যি সত্যি অন্বেষার দেখা পাবে?
মেট্রো স্টেশনের কাছে একটা ছোট দোকানে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ঈশান নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল,
“অন্বেষা কোথায় থাকতে পারে? সে কি প্রতিদিন সকালে মেট্রো ধরে? যদি ধরি, তাহলে কোন সময়?”
কোনো উত্তর নেই। শুধু একটা অনিশ্চিত আশা নিয়ে সে অপেক্ষা করতে লাগল। সকাল ৮টা বাজতেই মেট্রো স্টেশনে অফিসযাত্রীদের ঢল নামল। ঈশান স্টেশনের ভিতরে ঢুকে পড়ল। প্রতিটি মেট্রোর কামরার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে লোকজনের মুখ স্ক্যান করতে লাগল।
“অন্বেষা, তুমি কোথায়? একটি বার… শুধু একবার সামনে এসো।”
কিন্তু সময় পেরিয়ে যায়, মানুষ আসে, মানুষ যায়—কিন্তু অন্বেষার দেখা নেই।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে এলো। ঈশান তখনো স্টেশনের ভেতরেই বসে। মানুষ কমে আসছে ধীরে ধীরে, তার চোখের ভেতর ক্লান্তি জমে উঠছে। মনে হচ্ছে এই শহরের ভিড়ের মধ্যে এক অচেনা ছায়ার খোঁজ করে সে নিজের সময় নষ্ট করছে।
এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে সে ঘরে ফিরল।
এরপর কেটে গেল কয়েকদিন।
ঈশান কাজের মধ্যে ডুবে যেতে চাইছিল, কিন্তু কিছুতেই পারছিল না। অন্বেষার সেই গান, সেই কণ্ঠস্বর যেন প্রতিটা মুহূর্তে তার মাথার মধ্যে বাজছিল।
কিন্তু ধীরে ধীরে একটা সত্যকে মেনে নিতে বাধ্য হল সে—অন্বেষাকে আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
“হয়তো অন্বেষা আমার জন্য নয়… হয়তো আমাদের পথ আলাদা।”
এইভাবে ১০-১২ দিন কেটে গেল।
সেদিন বিকেলে ঈশান বাংলা একাডেমিতে গিয়েছিল। মাথা ঠান্ডা করতে পুরনো বইয়ের ঘ্রাণ নিতে গিয়েছিল। কিন্তু তার মন তখনো কোথাও আটকে আছে।
বাংলা একাডেমির পাশে চায়ের দোকানের সামনে, একটা বড় গাছের নিচে বসে চা খাচ্ছিল সে। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো এক পরিচিত সুর—
“এক জনে ছবি আঁকে এক মনে ও মন
আরেক জনে বসে বসে রঙ মাখে
হ আবার সেই ছবিখান নষ্ট করে
কোন-জনা, কোন জনা…”
চমকে উঠল ঈশান!
এটা তো…
এটা তো অন্বেষার গলা!
সে মুহূর্তের মধ্যে উঠে দাঁড়াল। চায়ের কাপ হাত থেকে পড়ে গেল মাটিতে।
সন্ধ্যার হালকা আলোয় চোখ ঘোরাতেই দেখতে পেল কয়েক হাত দূরে এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পিছন ফিরে আছে সে, কিন্তু ঈশান নিশ্চিত—এটা অন্বেষা!
মনে হল কেউ যেন তার হৃদয়টাকে এক ঝটকায় চেপে ধরল।
সে প্রায় চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “অন্বেষা!”
মেয়ে পিছন ফিরে তাকাল।
ঈশান আর ভুল করতে পারল না।
সামনে সত্যিই অন্বেষা দাঁড়িয়ে আছে!
কিন্তু অন্বেষার চোখে একটা অদ্ভুত শূন্যতা। যেন গভীর কোনো দুঃখ, কোনো গোপন কষ্ট তার চোখের ভেতরে লুকিয়ে আছে।
“এতদিন পর দেখা… কিন্তু এই অভিব্যক্তি কেন?”
অন্বেষা বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “ঈশান! তুমি?“
ঈশান আর কিছু ভাবতে পারল না। সে সোজা এগিয়ে গিয়ে অন্বেষার হাত ধরে তাকে গাছের বেদিতে বসালো। তার চোখে জল, কিন্তু সেটা আনন্দের!
“অন্বেষা…!”
ওরা এক কাপ করে চা অর্ডার করল। গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঈশান এক নিঃশ্বাসে বলে উঠল,
“তুমি জানো অন্বেষা, তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি প্রায় অর্ধেক কলকাতা ঘুরে ফেলেছি।”
অন্বেষা একদৃষ্টিতে ঈশানের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। ঈশানের কথার মাঝে যে তীব্র আকুলতা, তাতে ওর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটল।
“তাই নাকি?” – বলে হাসতে হাসতে মাথা একটু কাত করল অন্বেষা।
ঈশান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একটু থেমে বলল,
“তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে একদিন সোনাগাছি পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম।”
এই কথা শুনে অন্বেষা এবার সত্যিই হেসে ফেলল।
“সোনাগাছি! ঈশান, তুমি কি ভেবেছিলে আমি সেখানে থাকি?”
হাসির ভেতরেও ঈশান এক অদ্ভুত লাজুকতা দেখতে পেল। অন্বেষার চোখের কোণে জল চিকচিক করছিল কি? নাকি সেটাও তার কল্পনা?
ঈশান মাথা নাড়িয়ে বলল,
“না, তা নয়। কিন্তু তুমি কোথায় হারিয়ে গেলে, আমি কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যেন অন্ধকারের মধ্যে কোনো কিছু কে হাতড়ে ধরার চেষ্টা করছিলাম।“
অন্বেষা এবার একটু গম্ভীর হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“সবাই অন্ধকারকে ভয় পায়, তাই না?“
ঈশান এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হয়তো ভয় পাই, কিন্তু তুমি যদি সেই অন্ধকারের মধ্যে থাকো, আমি তোমার সাথে থাকতে রাজি আছি।“
অন্বেষার চোখে এবার সত্যিকারের বিস্ময় ফুটে উঠল।
“তুমি তো বেশ বড় কথা বললে ঈশান। কিন্তু জানো, কিছু অন্ধকার থাকে, যেখানে আলো প্রবেশ করতে পারে না।”
ঈশান হালকা হেসে বলল,
“তাহলে আলো না থাক, আমি নিজেই অন্ধকারের সাথে থাকতে শিখে নেব।”
অন্বেষা চুপ করে ঈশানের দিকে তাকিয়ে থাকল। মনে মনে জানত, ঈশান ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার চোখের ভাষাই বলে দিচ্ছিল সবকিছু।
কিন্তু অন্বেষা কিছুই প্রকাশ করল না।
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে ঈশান বলল,
“অন্বেষা, আমি তোমাকে আর হারাতে চাই না।”
অন্বেষা হেসে বলল,
“তুমি কি জানো ঈশান, কিছু কিছু সম্পর্ককে হারিয়ে ফেলাই ভালো, নাহলে তারা কষ্ট দিয়ে যায়।”
ঈশান কিছু বলল না। শুধু বুঝতে পারল, অন্বেষার চোখের গভীরে একটা রহস্য লুকিয়ে আছে, যে রহস্য সে ধীরে ধীরে উন্মোচন করতে চায়…
ওরা এবার একে অপরকে নিজেদের মোবাইল নম্বর দেয়। তারপর সেদিন ওখান থেকে ওরা বিদায় নেয়।
অধ্যায় ৩: অতীতের ক্ষত
বাংলা রহস্য রোমাঞ্চ ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল ঈশান। আকাশটা বেশ মেঘলা, হালকা বাতাস বইছে। একটা অজানা শূন্যতা ওর মনে বাসা বেঁধেছে। অন্বেষার সাথে সেদিনের দেখা হওয়ার পর থেকে ওর মন যেন কোথাও গেঁথে আছে। আর ভাবতে পারছে না অন্য কিছু।
মোবাইল হাতে নিয়ে অনেকবার ভাবলো কল করবে কি না। শেষ পর্যন্ত আর দোনামনা না করে ডায়াল করেই ফেলল অন্বেষার নম্বর। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে ধীর, স্নিগ্ধ কণ্ঠে অন্বেষার গলা ভেসে এল—
“এই রাত্তিরবেলা ফোন? কী ব্যাপার ঈশান, ঘুম আসছে না?”
ঈশান হেসে বলল,
“তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে ঘুম যেন উধাও হয়ে গেছে।”
অন্বেষা হালকা হেসে বলল,
“উহু! এতদিন তো খুঁজে বেড়ালে, পেয়েও যদি ঘুম হারিয়ে ফেলো, তাহলে তো মুশকিল!”
ঈশান একটু লজ্জা পেয়ে বলল,
“ঠিক সে জন্য না… আসলে, তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে। তোমার গলাটা কেমন যেন… একটা জাদুর মতো কাজ করে মনে।”
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এল না, কিছুক্ষণ নীরবতার পর ঈশান হঠাৎ শুনতে পেল অন্বেষা গুনগুন করছে—
“এক জনে সুর তোলে এক তারে ও মন
আরেক জনে মন্দিরাতে তাল তোলে ও মন
এক জনে সুর তোলে এক তারে ও মন
আরেক জনে মন্দিরাতে তাল তোলে
হ আবার বেসুরা সুর ধরে দেখো
কোন জনা, কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা, মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।”
ঈশান কিছুক্ষণ চুপ করে শুনলো। এটা সেই গান, যে গানটা সেদিনও গুনগুন করছিল অন্বেষা। এবার ঈশানের মনে একটু খটকা লাগল। ও একটু ধীরে বলল—
“আচ্ছা অন্বেষা, তুমি এই গানটাই বার বার কেন গাও?”
অন্বেষার কণ্ঠস্বর বদলে গেল, যেন একটু গম্ভীর হয়ে উঠল।
“কেন, তোমার কোনো আপত্তি আছে?”
ঈশান একটু হকচকিয়ে গেল।
“না! এমনি জিজ্ঞেস করলাম। প্লিজ রাগ করো না!”
একটু নীরবতা। তারপর স্বাভাবিক কণ্ঠে অন্বেষা বলল—
“আরে! না না, রাগ করছি না। তবে গানটা আমার খুব পছন্দের, কিছু বিশেষ কারণও আছে…”
ঈশান উৎসুক হয়ে বলল,
“কি কারণ?”
অন্বেষা মৃদু হাসল,
“সব কি একসাথে বলে দিতে হয়? একটু ধীরে ধীরে জানলেই তো পারো!”
ঈশান হাসল।
“ঠিক আছে। তবে একটা কথা বলো, ওই দিন রাতে আমার মধ্যে এমন কী দেখলে যে আমার প্রেমে পড়ে গেলে?”
ঈশান একটু থমকে গেল।
“আমি জানি না অন্বেষা, এটা প্রেম কি না, কিন্তু তোমার মাঝে একটা অদ্ভুত রহস্য আছে, যা আমাকে টানছে। তোমার চোখের দিকে তাকালেই মনে হয় যেন হাজারটা গল্প লুকিয়ে আছে সেখানে, অথচ তুমি কিছুই প্রকাশ করছ না। আমি সেই গল্পগুলো জানতে চাই।”
অন্বেষা এবার আর হাসল না। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“সব গল্প জানার জন্য তৈরি তো?”
ঈশানের গলা একটু নরম হয়ে এল।
“আমি জানি না। কিন্তু জানতে চাই। তুমি আমায় ভয় পেতে বলেছ, কিন্তু আমি ভয় পাইনি। আমি শুধু তোমাকে জানতে চাই, তোমার ছায়ার ভিতর কী আছে, সেটা দেখতে চাই।”
অন্বেষা এবার চুপ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর বলল,
“হয়তো একদিন আমিই সব বলে দেব, হয়তো একদিন সব জানতে পারবে। কিন্তু তার জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে ঈশান।”
ঈশান মৃদু হেসে বলল,
“আমি অপেক্ষা করব অন্বেষা, কারণ আমি জানি—তুমি আমার জীবনে অকারণে আসোনি।”
ওপাশ থেকে শুধু একটা হালকা হাসির শব্দ এল।
ধীরে ধীরে ঈশান আর অন্বেষার মধ্যে একটা অদ্ভুত টান তৈরি হয়। তারা একসঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসতে শুরু করে। গঙ্গার ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখা, কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো বইয়ের দোকানে ঘোরাফেরা, কিংবা এক কাপ চায়ের আড্ডা—সবকিছুতেই যেন একটা অনিবার্য আকর্ষণ কাজ করে।
একদিন গঙ্গার ধারে বসে চুপচাপ নদীর ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল অন্বেষা। হালকা বাতাসে ওর চুল উড়ছিল, আর ঈশান তাকিয়ে ছিল ওর দিকেই। হঠাৎ অন্বেষা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—
“জানো, কখনো কখনো মনে হয়, আমি যেন এই পৃথিবীর কেউ নই। আমার এখানে থাকার কোনো মানেই নেই।”
ঈশান একটু চমকে উঠল।
“এইরকম বলছ কেন? কী হয়েছে?”
অন্বেষা একটু হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে বিষাদ মেশানো ছিল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল—
“তুমি জানো, আমার একটা জমজ বোন ছিল—তানিশা। দেখতে একেবারে আমার মতো। ও ছিল আমার পৃথিবী, আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। তিন বছর আগে একটা অ্যাক্সিডেন্টে ও মারা যায়। তারপর সবকিছু বদলে গেল।”
ঈশান স্তব্ধ হয়ে শুনছিল।
“তারপর?”
অন্বেষার চোখের কোণে জল চিকচিক করছিল।
“তারপর… মা আর বাবা একদিন একসঙ্গে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করলেন। আমি শুধু দেখতে পেলাম, আমার পুরো পৃথিবীটা আমার চোখের সামনে ভেঙে যাচ্ছে, অথচ আমি কিছুই করতে পারলাম না।”
ঈশান কোনো কথা খুঁজে পেল না। কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা নেমে এল। তারপর ঈশান আস্তে আস্তে বলল—
“আমি দুঃখিত অন্বেষা, সত্যি দুঃখিত। আমি জানি, এই কথায় তোমার কোনো কষ্ট কমবে না, কিন্তু আমি তোমার পাশে আছি। আমি সত্যিই আছি।”
অন্বেষা একটু হেসে মাথা নাড়ল।
“জানো, এই সব ঘটনার পর আমার আত্মীয়-পরিজনেরাও একে একে দূরে সরে গেল। আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম। এখন আমি কাউকে কাছে টানতে ভয় পাই।”
ঈশান এবার ওর হাতটা আলতোভাবে ধরল।
“তুমি একা নও, অন্বেষা। আমি আছি। আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যাব না।”
অন্বেষা কিছু বলল না, শুধু একবার ঈশানের চোখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
দিন যত এগিয়ে যেতে থাকে, ওরা দুজন দুজনের আরো কাছে আসে। একদিন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ঘুরতে গিয়েছিল ওরা। সেদিন আকাশটা ছিল মেঘলা, বিকেলের আলোয় পুরো জায়গাটা ছিল মোহময়।
ওরা একসঙ্গে হাঁটছিল, অন্বেষার মুখে সেই চিরচেনা হাসি, কিন্তু হঠাৎ করেই সে থমকে দাঁড়াল।
“ঈশান, আমার এত কাছে এসো না।”
ঈশান অবাক হয়ে গেল।
“মানে? কী বলতে চাচ্ছো?”
অন্বেষা এবার একটু গম্ভীর হয়ে গেল।
“আমার ছায়া তোমাকে গ্রাস করবে।”
ঈশান হাসল,
“তুমি কি সিনেমার ডায়লগ দিচ্ছো? অন্বেষা, আমি তোমাকে বুঝতে চাই। আমি জানতে চাই, তোমার ভেতরে আসলে কী চলছে।”
অন্বেষার মুখ শক্ত হয়ে গেল। ওর চোখে হঠাৎ এক অদ্ভুত দৃষ্টি ফুটে উঠল।
“তুমি এসব জানতে চাও কেন? আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও!”
ও হঠাৎ করে ঈশানকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল। ঈশান হতভম্ব হয়ে গেল।
“অন্বেষা, আমি তো শুধু তোমাকে বুঝতে চাই!”
অন্বেষা আর কিছু বলল না। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল সামনে। ঈশান ওর দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু আর কিছু বলল না।
ও বুঝতে পারল, অন্বেষার মনে গভীর ক্ষত লুকিয়ে আছে। কিন্তু সেই ক্ষতের গভীরতা ঠিক কতটা, সেটা কি সে কখনো জানতে পারবে?
অন্বেষা কি কিছু লুকোচ্ছে?
ঈশানের মনে একের পর এক প্রশ্ন ভিড় করতে লাগল…
অধ্যায় ৪: অন্ধকার গলি
বাংলা রহস্য রোমাঞ্চ ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সেই ঘটনার পর ঈশান আর অন্বেষাকে সেভাবে বিরক্ত করেনি। ওদের কথাবার্তা স্বাভাবিক থাকলেও, একটা অদৃশ্য দূরত্ব যেন গড়ে উঠেছিল। ঈশানের মনে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—“অন্বেষা কেন এমন বলল? ওর ছায়া কীভাবে ওকে গ্রাস করতে পারে? ও কি কোনো কিছু লুকোচ্ছে?” কিন্তু সে জেনেশুনেই এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেনি। হয়তো ভয় পেয়েছিল, আবার যদি অন্বেষা দূরে সরে যায়? অন্যদিকে, অন্বেষা বুঝতে পারছিল, ঈশানের মনে দোনোমোনো চলছে। সে জানে, ঈশান জানতে চায়, সবটা জানতে চায়, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলছে না। এভাবেই কিছুদিন কেটে যায়। এক সন্ধ্যায়, আচমকা ঈশানের ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে নাম দেখে তার বুকটা ধক করে উঠল—অন্বেষা কলিং…
ঈশান: “হ্যালো?”
অন্বেষার স্বর খুব স্বাভাবিক ছিল, যেন কিছুই হয়নি—
অন্বেষা: “কেমন আছো?”
ঈশান: “ভালো, তুমি?”
অন্বেষা: “ভালোই। শুনো, শুক্রবার রাতে একটু আমার বাড়ি আসবে?”
ঈশান অবাক হয়ে গেল।
ঈশান: “তোমার বাড়ি?”
অন্বেষা: “হ্যাঁ। আসবে তো?”
ঈশান: “হঠাৎ?”
“উফ্, এত প্রশ্ন কেন? আসবে কি আসবে না?”
ঈশান: “আসব, নিশ্চয়ই আসব। কিন্তু ব্যাপারটা কী?”
অন্বেষা: “এখনই সব জানার দরকার নেই, শুক্রবার রাতে এসো, ঠিক রাত আটটায়। আমি অপেক্ষা করব।”
অন্বেষা আর কিছু না বলে ফোন কেটে দিল। ঈশান ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। কেমন যেন একটা শিহরণ বয়ে গেল শরীরের মধ্যে। অন্বেষার কণ্ঠস্বরে আজ যেন একটা অদ্ভুত গভীরতা ছিল। অন্বেষা ওকে কেন ডেকেছে? তার মনে ভয় মেশানো উত্তেজনা খেলে গেল। শুক্রবার রাতটা কি কোনো বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ? ঈশানের অজান্তেই রাতের অন্ধকারে এক রহস্য জাল বুনতে শুরু করল…
শুক্রবার সন্ধ্যায়, পূর্ব সিদ্ধান্তমতো ঈশান শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনের ২ নম্বর গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। চারদিকে ব্যস্ততার ছাপ, অফিসফেরত মানুষের ভিড়, ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে থাকা গাড়ির হেডলাইটের আলোয় রাস্তা কখনো আলোকিত, কখনো ছায়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
ঈশান কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দূর থেকে অন্বেষাকে দেখতে পেল। একটা গাঢ় নীল রঙের কুর্তি আর কালো স্কার্ফে ওর চেহারাটা কেমন যেন আরও গম্ভীর আর রহস্যময় লাগছিল।
“অনেকক্ষণ হলো এসেছ?”—অন্বেষা কাছে এসেই জিজ্ঞেস করল।
“না, এই তো কিছুক্ষণ,” ঈশান মৃদু হাসল।
একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করল ওরা। রাস্তার বাতিগুলো মাঝে মাঝে ফ্লিকার করছিল, যেন রাতের অন্ধকার আরও বেশি গাঢ় করে তুলতে চাইছে। গলির মোড়ে এসে ঈশান লক্ষ্য করল কিছু ছেলে ক্যারাম খেলছে। সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে, ছেলেগুলোর হাসাহাসির শব্দ হালকা গুঞ্জনের মতো মনে হচ্ছে।
ঠিক তখনই ঈশানের কানে এলো একটা চাপা ফিসফিস—
“আবার একজনকে নিয়ে এসেছে শেষ করবে বলে…”
এক মুহূর্তের জন্য ঈশানের পা থমকে গেল। ছেলেগুলোর মধ্যে কয়েকজন বাঁকা হেসে অন্বেষার দিকে তাকাল, তারপর হঠাৎ সবাই চাপা গলায় হাসতে শুরু করল। অন্বেষা ঈশানের হাতটা একটু শক্ত করে ধরল, তারপর খুব শান্ত স্বরে বলল, “ওদের কথায় কান দিও না! বুঝতেই পারছো, একজন একা মেয়ের পক্ষে সমাজে টিকে থাকতে হলে কতটা সংগ্রাম করতে হয়।” ঈশান একবার অন্বেষার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল—সেখানে একটা কঠিন বাস্তবের ছায়া, যেটা হয়তো সমাজের এই সংকীর্ণ মানসিকতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে করতে গড়ে উঠেছে।
সে কিছু বলল না, শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। রাস্তার বাতিগুলোর আলো-ছায়ার মাঝে দু’জন আবার এগিয়ে চলল। তবে ঈশানের মনে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করছিল। ছেলেটা এমন কথা বলল কেন? “শেষ করবে” মানে কী? এই এলাকায় কি অন্বেষাকে নিয়ে কোনো অদ্ভুত গুজব আছে? কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা অন্বেষার বাড়িতে পৌঁছে গেল।
অন্বেষার বাড়িটা দেখেই ঈশানের কেমন একটা অস্বস্তি হলো। তিনতলা পুরোনো বাড়ি, দেয়ালের প্লাস্টার চুইয়ে চুইয়ে খসে পড়ছে, জানালার কাঠগুলো জীর্ণ হয়ে গেছে। বাড়ির সামনে একসময় বাগান ছিল বোধহয়, কিন্তু এখন সেখানে কেবল শুকিয়ে যাওয়া আগাছা আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভাঙা ইটপাথর।
চারদিকে এমন নিস্তব্ধতা, যেন এই বাড়িতে কোনো প্রাণের স্পন্দন নেই। বাতাসে একটা অদ্ভুত স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, অনেকদিন না-পরিষ্কার করা পুরনো আসবাবের গন্ধের মতো। ঈশান একটু কুঁকড়ে উঠল।
“তুমি এখানে একা থাকো?” সে আস্তে জিজ্ঞেস করল।
অন্বেষা দরজা খুলে ঈশানকে ভিতরে ডাকল, চোখে এক অদ্ভুত রহস্যময় দৃষ্টি;
“এসো, ভেতরে এসো। আজ অনেক গল্প হবে।”
ঈশান ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে দোতালার ঘরটায় ঢুকল। চারপাশটা বেশ অগোছালো, কিন্তু ঘরের ভেতর একটা অদ্ভুত নীরবতা ছিল, যেন ঘর নিজেই কিছু লুকিয়ে রেখেছে।
“একটু বসো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। কিছু মনে করো না। একাই থাকি, বুঝতেই পারছো,”—বলল অন্বেষা, একগাল হাসি দিয়ে।
ঈশান মাথা নাড়ল। “না, না! তুমি ফ্রেশ হয়ে এস। আমি ঠিক আছি।”
অন্বেষা দরজা ভেজিয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেল। ঈশান তখনো ঘরটা পর্যবেক্ষণ করছিল।
ঘরের এক কোণে একটা ছোটো বইয়ের র্যাক ছিল। বই দেখতে ঈশানের বরাবরই ভালো লাগে। সে এগিয়ে গেল। প্রথমে ভাবল সাধারণ কিছু উপন্যাস বা গল্পের বই থাকবে, কিন্তু বইগুলোর নাম দেখেই সে থমকে গেল; “দ্য বুক অফ ব্ল্যাক ম্যাজিক অ্যান্ড অফ প্যাক্টস”, “ডার্ক রিচুয়ালস”, “দ্য বুক অফ ডেথ”, “দ্য বুক অফ শ্যাডো” –তার গলা শুকিয়ে এল।
“এগুলো এখানে কী করছে?”
সে আঙুল দিয়ে ধুলো জমা একটার ওপর দিয়ে বুলিয়ে নিলো। স্পষ্টতই, এগুলো বহু পুরোনো, হয়তো অনেক বছর ধরে কেউ পড়েনি। কিন্তু তখনই তার চোখ পড়ল একটা পুরোনো চামড়ার মলাট দেওয়া ডায়েরির ওপর। ঈশান এক মুহূর্ত ভাবল। অন্যের ব্যক্তিগত জিনিস হাত দেওয়া উচিত না। কিন্তু কৌতূহল তাকে ছাড়ল না। সে ধীরে ডায়েরিটা খুলল।
প্রথম পাতায় কিছু অস্পষ্ট হস্তলিপি। ভাষাটা বুঝতে পারল না, কিন্তু দ্বিতীয় পাতায় আঁকা ছিল কিছু অদ্ভুত নকশা—ত্রিভুজ, বৃত্ত, রহস্যময় প্রতীক। ডাইরির পাতা উল্টে কয়েকটা লাইন পড়েছিল ঈশান। সেখানে ইংরেজি আর ল্যাটিন ভাষায় কিছু লেখা ছিল—কোনো এক বিশেষ পূজার বর্ণনা। নীচের পাতায় একটা গোল আকৃতির চিহ্ন, তার মধ্যে লেখা—
“সাক্রিফাইসিউম এড টেনেব্রাস” অর্থাৎ, “অন্ধকারের জন্য উৎসর্গ”।
হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল পাড়ার ছেলেটার বলা কথা— “শেষ করবে!” ঈশানের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
“এর মানে কী? অন্বেষা সত্যিই কী একা থাকে? নাকি এখানে অন্য কিছু আছে?”
সে ডায়েরিটা দ্রুত আগের জায়গায় রেখে দিলো। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। ঠিক তখনই… একটা দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেল। ঈশান দ্রুত পেছনে তাকাল। বাতাসে একটা চাপা শব্দ—মৃদু ফিসফিসানি যেন কেউ তার কানের কাছে কিছু বলছে, কিন্তু শব্দগুলো বোধগম্য নয়।
“আমি কি কল্পনা করছি?”
সে উঠে দাঁড়াতে যাবে, তখনই অন্বেষা ফিরে এল। অন্বেষা গোলাপি রঙের সিল্কের নাইটগাউন পরে দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এলো, আর ঈশানের চোখ এক মুহূর্তের জন্য আটকে গেল। মৃদু আলোয় তার ত্বক ঝলমল করছিল, সিল্কের মসৃণতা যেন তার সৌন্দর্যকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। দীর্ঘ, ঢেউ খেলানো চুল খোলা, চোখের গভীরতায় একটা অদ্ভুত টান, যেন হাজারো গল্প লুকিয়ে আছে সেখানে। গাউনটা তার শরীরের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে, যেন এক নীরব সুর বেজে চলেছে বাতাসে। অন্বেষার হাঁটাচলার ছন্দে ছিল এক মোহময় আকর্ষণ, যা তাকে রহস্যময়, অথচ অভিজাত করে তুলেছিল।
“কী করছিলে?”—গলায় অদ্ভুত এক স্বর, যেন খুব ধীর অথচ তীক্ষ্ণ।
ঈশান চমকে উঠে বলল, “কিছু না, তোমার বইগুলো দেখছিলাম। বেশ ইন্টারেস্টিং কালেকশন!”
অন্বেষা অদ্ভুতভাবে তাকাল। এক মুহূর্ত চুপ থেকে হাসল।
“তুমি জানো, কিছু জিনিস দেখতে সাধারণ মনে হলেও আসলে তা নয়?”
ঈশানের মুখে কোনো কথা এল না।
অন্বেষা ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।
“তুমি কি ভয় পাচ্ছ?”
ঈশান গলা পরিষ্কার করে বলল, “ভয় পাওয়ার কিছু আছে?”
অন্বেষা হাসল।
“কিছু রহস্য না জানাই ভালো।”
ঈশানের মনে হলো, হাসিটার মধ্যে কিছু একটা লুকিয়ে আছে। ঘরের ভেতরের বাতাস যেন একটু ভারী হয়ে এল। তার মনে হলো, সে আজ কোনো ভুল জায়গায় এসেছে।
ধোঁয়াশা - সত্য ঘটনা: নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর গায়েব হওয়া ঘিরে রহস্য! তিনি কি আজও বেঁচে? ফিরে আসবেন? পড়ুন সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা বাংলা ছোট গল্প "ধোঁয়াশা"—এক গভীর প্রশ্নের উত্তরে যাত্রা। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৫: ছায়ার খেলা
বাংলা রহস্য রোমাঞ্চ ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
রাতের নিস্তব্ধতা ক্রমশ গভীর হচ্ছিল। জানলার বাইরে মৃদু হাওয়া বইছিল, গাছের পাতাগুলো যেন এক অজানা সুরে ফিসফিস করে কিছু বলতে চাইছিল। অন্বেষা ধীর পায়ে এসে ঈশানের পাশে বসল, ওর কাঁধে মাথা রাখল না ঠিকই, কিন্তু ওর উপস্থিতিতে ঈশানের ভেতরটা কেমন যেন গরম হয়ে উঠল।
অন্বেষা ঈশানের হাতটা নিজের হাতে নিল, আস্তে করে কাছে টেনে বলল, “চা খাবে?”
ঈশান মোবাইল বের করে সময় দেখল, রাত ঠিক ৯টা। একটু হেসে বলল, “তার থেকে বরং অনলাইনে ডিনার অর্ডার করে দিই?”
অন্বেষা মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, তার দরকার নেই। আজ আমার হাতের রান্না খেয়ো।”
ঈশান অবাক হলো না, বরং ওর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। ওরা নিজেদের জীবনের গল্পে হারিয়ে গেল। পুরনো স্মৃতি, ভালো লাগা, কষ্টের মুহূর্ত—সব মিলিয়ে যেন একটা আবছা রঙের ছবি আঁকা হচ্ছিল। অন্বেষার চোখ দুটো যেন জাদু করছিল ঈশানকে, ওর কণ্ঠের কোমলতা, শরীরের নড়াচড়া—সবকিছুই যেন এক অদ্ভুত মোহ তৈরি করছিল।
কিছুক্ষণ পর ঈশান একটু ইতস্তত করে বলল, “একটা সিগারেট খেতে পারি?”
অন্বেষা হেসে ফেলল। ঈশান প্রথমবারের মতো বুঝতে পারল, অন্বেষার হাসির মধ্যে কী গভীর উষ্ণতা লুকিয়ে আছে।
“এতে আবার পারমিশন নেওয়ার কী আছে?”
ঈশান কিছু বলতে যাবে, তখনই অন্বেষা আবার বলল, “ওয়ান খাবে?”
ঈশান একটু অবাক হয়ে তাকাল, “আছে তোমার কাছে?”
“হুমম!”
ঈশান অন্বেষার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “তাহলে নিয়ে এসো!”
অন্বেষা রহস্যময় এক হাসি দিয়ে বলল, “রান্নাঘরে চলো! ওয়ান খেতে খেতে, তোমার সাথে কথা বলতে বলতে রান্নাও হয়ে যাবে।”
ঈশান কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল। রান্নাঘরের আলো নরম, হালকা কমলা রঙের। একটা পুরনো কাঠের আলমারি ছিল একপাশে, যার ওপরে রাখা ছিল একটা সাদা মোমবাতি। অন্বেষা ধীর পায়ে গিয়ে আলমারি খুলল, একটা ছোট অ্যালুমিনিয়াম-এর কৌটো বের করল।
কৌটো থেকে দুটো সিগারেট বের করে ঈশানের দিকে একটা বাড়িয়ে দিল, তারপর নিজে একটা ধারালো।
“এই নাও,” অন্বেষা বলল।
ঈশান একটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখল—সাধারণ সিগারেটের মতোই, কিন্তু ওর মাথায় ছোট একটা খোদাই করা নকশা ছিল, যা আগে কখনো দেখেনি।
“এটা কি স্পেশাল সিগারেট?” ঈশান কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল।
অন্বেষা মিষ্টি হেসে বলল, “খেলে বুঝবে।”
ঈশান আর কথা না বাড়িয়ে লাইটার জ্বালাল। তারপর অন্বেষার দিকে লাইটার টা বাড়িয়ে দিল। প্রথম টান দিতেই একটা হালকা নরম গন্ধ নাকে এলো, যা ওর মনে এক ধরণের প্রশান্তি এনে দিল।
রাতের নরম আলো আর লাল রঙের নেশা
রান্নাঘরের উষ্ণতা যেন একটু একটু করে বাড়ছিল। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু অন্বেষা আর ঈশানের কথাবার্তার নরম গুঞ্জন মিলিয়ে যাচ্ছিল রাতের বাতাসে।
অন্বেষা পাশের ফ্রিজ থেকে একটা পুরোনো রেড ওয়াইনের বোতল বের করল। বোতলের গায়ের লেবেলটা কিছুটা বিবর্ণ, মনে হচ্ছিল বহুদিনের জমিয়ে রাখা কোনো বিশেষ মুহূর্তের স্বাক্ষী। পাশে থাকা আলমারি খুলে দুটো ওয়াইনের গ্লাস বের করে ওর একটাতে অল্প করে ওয়াইন ঢালল, তারপর আরেকটা গ্লাস ঈশানের দিকে এগিয়ে দিল।
“এই নাও, একটু রিল্যাক্স হও,” অন্বেষা হেসে বলল।
ঈশান গ্লাসটা নিয়ে চোখে চোখ রাখল অন্বেষার। সেই চোখের গভীরতায় যেন কেমন একটা রহস্য লুকিয়ে আছে, যা ঈশান ঠিক বোঝে না, শুধু অনুভব করে।
ওরা গ্লাস ঠুকিয়ে চিয়ার্স করল। ঈশান প্রথম চুমুক দিতেই একটু ভ্রু কুঁচকে তাকাল। স্বাদটা ওর কাছে একটু তেতো আর অন্যরকম লাগল। অন্বেষা ওর এই হালকা অস্বস্তি বুঝে হাসল, “তোমার তো ওয়াইন খাওয়ার অভ্যাস নেই, তাই তো?” ঈশান মাথা নাড়ল, “মদ খেয়েছি, কিন্তু ওয়াইন খুব একটা খাইনি। এটার স্বাদ বেশ অন্যরকম।”
“এটাই তো মজার ব্যাপার, ধীরে ধীরে নিলে বুঝবে এর আসল স্বাদ,” অন্বেষা বলল, নিজের গ্লাসে ছোট্ট চুমুক দিয়ে।
এরপর ও রান্নায় মন দিল। একটা কড়াইতে রান্না বসিয়ে ফ্রিজ থেকে আগের রাতে মাখানো আটা বের করল। ঈশান তাকিয়ে দেখছিল, অন্বেষা কী নিখুঁতভাবে হাতের তালু দিয়ে লেচি কেটে রুটি বানাচ্ছে। ঈশান গ্লাসে আরেকটু ওয়াইন ঢেলে অন্বেষার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাকে দেখে তো মনে হয় না তুমি রোজ রান্না করো।”
অন্বেষা হেসে বলল, “একদম ঠিক ধরেছো। রান্না করতে ভালো লাগে, কিন্তু সবসময় করি না। তবে আজকে ইচ্ছে হলো, তাই তোমার জন্য নিজে হাতে করছি।”
ঈশান খানিকটা চুপ করে ওর কথা শুনল, তারপর আস্তে বলল, “আজকের রাতটা মনে থাকবে আমার, জানো?” অন্বেষা এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। ঈশানের চোখের গভীরতা ওকে যেন একটু টেনে নিল, সেই পুরনো, রহস্যময় রেড ওয়াইনের মতোই—যা একবার স্বাদ নিলে ভোলা কঠিন।
ও ধীরে বলল, “আমারও…”
রান্নার গন্ধ, নরম আলো আর লাল রঙের নেশা—সব মিলিয়ে রাতটা যেন একটু বেশি মিষ্টি হয়ে উঠছিল। চুলায় রাখা কড়াইয়ের ভেতর তেল একটু একটু করে ফেনিয়ে উঠছিল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর অন্বেষা ঈশানের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি জানো, তুমি যখন কথা না বলে শুধু তাকিয়ে থাকো, তখন তোমাকে খুব অন্যরকম লাগে?”
ঈশান একটু হেসে বলল, “কেমন?”
অন্বেষা চোখ সরু করে বলল, “একটা গভীর সমুদ্রের মতো। যেখানে নেমে গেলে আর ফেরা যায় না।”
ঈশানের বুকের ভেতর একটা ঢেউ বয়ে গেল। ও ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে অন্বেষার পাশে দাঁড়াল, ওর চুলে আলতো করে হাত রাখল।
“তাহলে ডুব দাও?” ঈশান মৃদু স্বরে বলল। অন্বেষা হাসল, কিন্তু কিছু বলল না। চোখ তুলে ঈশানের দিকে তাকাল। সেই চোখের ভাষায় যে আমন্ত্রণ ছিল, তার উত্তর মুখে দেওয়ার দরকার নেই।
অন্বেষা পেছন ফিরে ঈশানের দিকে তাকাল। চোখেমুখে লাজুক একটা অভিব্যক্তি, কিন্তু সেই দৃষ্টির গভীরে একটা টান, একটা আহ্বান লুকিয়ে ছিল। ঈশান ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরল। ওর উষ্ণ নিঃশ্বাস লাগছিল অন্বেষার কাঁধে। ঈশান আলতো করে কাঁধের কাছে একটা চুমু খেয়ে নরম স্বরে গুনগুন করে গাইতে লাগল,
“এক জনে ছবি আঁকে এক মনে ও মন,
আরেক জনে বসে বসে রঙ মাখে ও মন…”
গানের সুরে যেন একটা মোহাচ্ছন্নতা ছিল। অন্বেষা কিছুক্ষণ চুপ করে শুনল, তারপর আস্তে আস্তে ওর সাথে গলা মিলিয়ে গাইতে লাগল।
“হ আবার সেই ছবিখান নষ্ট করে
কোন-জনা, কোন জনা…”
ঈশান অন্বেষাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, যেন এই মুহূর্তটা চিরদিনের জন্য আটকে রাখতে চায়। একসাথে ওরা গাইছিল, কিন্তু গানের কথা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল ওদের স্পর্শের উষ্ণতায়।
পাঁচ মিনিট কেটে গেল, ওরা একে অপরের উষ্ণতায় ডুবে রইল। তারপর অন্বেষা ধীরে ঈশানের হাত ছাড়িয়ে নিল, ঘুরে ওর দিকে তাকাল।
চোখে চোখ রাখা মাত্রই একটা নিঃশব্দ বোঝাপড়া হয়ে গেল ওদের মধ্যে।
অন্বেষা ঈশানের মুখ দু’হাতে ধরে ওকে গভীরভাবে চুমু খেল। সেই চুম্বনের মধ্যে ছিল আকুলতা, ছিল ভালবাসার অজস্র না বলা কথা।
ঈশান অন্বেষার চুলের মধ্যে হাত চালিয়ে দিল, আরেক হাতে ওর কোমরটা নিজের দিকে টেনে আনল। রান্নাঘরের বাতাস উষ্ণ হয়ে উঠছিল, যেন দু’জনের শরীরের উত্তাপে চারপাশের হাওয়া গলতে শুরু করেছে।
ওরা ধীরে ধীরে দেয়ালের দিকে সরে গেল, ঈশান অন্বেষাকে আলতো করে ঠেসে ধরল। ঠোঁট থেকে ঠোঁট সরিয়ে ওরা একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
শ্বাস ভারী হয়ে আসছিল।
অন্বেষার গালের পাশে ঈশান ঠোঁট রাখল, গলায়, তারপর ধীরে ধীরে কাঁধ বেয়ে নিচের দিকে নামতে লাগল। অন্বেষার আঙুল ঈশানের চুলে জড়িয়ে গেল, ওর শরীর ঈশানের উষ্ণতায় গলে যেতে চাইছিল।
একটা দীর্ঘ শিহরণ অন্বেষার শরীর বেয়ে নেমে গেল।
হঠাৎ করেই ও নিজেকে সামলে নিয়ে ঈশানের বুকে হাত রেখে বলল, “রাত এখনো অনেক বাকি! তুমি একটু বসার ঘরে বসো, আমি রুটি গুলো তাড়াতাড়ি করে নিয়ে আসছি।”
ঈশান ওর চোখে চোখ রেখে হাসল, তারপর মাথা নাড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে, কিন্তু বেশি দেরি কোরো না।”
অন্বেষা রান্না শেষ করতে গেল, আর ঈশান বসার ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে অন্বেষা ট্রেতে রুটি আর তরকারি নিয়ে এল। ঠিক তখনই কারেন্ট চলে গেল। পুরো ঘর মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকারে ঢেকে গেল। অন্বেষা একটু চুপ করে থাকল, তারপর আলমারি থেকে একটা সাদা মোমবাতি বের করে এনে জ্বালাল। মোমবাতির হলুদ আলো ধীরে ধীরে ওদের চারপাশ আলোকিত করল।
ঈশান মজার স্বরে বলে উঠল, “দেখো দেখি! আমাদের আজ ক্যান্ডল লাইট ডিনার!”
অন্বেষা হেসে উঠল, “তাই তো! সত্যি বলতে, এটাও একটা সুন্দর মুহূর্ত।”
ওরা একসাথে খাওয়ায় মন দিল। কথা বলতে বলতে, হাসতে হাসতে খাবার চলছিল। সেই সাদা মোমবাতিটা একটু একটু করে গলছিল, যেমন করে অন্বেষা আর ঈশানের মাঝে থাকা অলিখিত দূরত্বটাও গলে যাচ্ছিল—নিঃশব্দে, নিঃশর্তে…
অধ্যায় ৬: অন্ধকার রাতের মায়া
বাংলা রহস্য রোমাঞ্চ ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
ডিনার শেষ হতে রাত প্রায় ১১টা বাজে। বাড়ির চারপাশে নীরবতা, দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের বিচ্ছিন্ন ঘেউ ঘেউ। খাওয়া শেষ করে ঈশান আয়েশ করে পেছনে হেলান দিল।
“অন্বেষা, আর একটা সিগারেট পাওয়া যাবে? আজ খুব ভালো লাগছে!” ঈশান মৃদু হেসে বলল।
অন্বেষা খাওয়া শেষ করে প্লেট আর বাসনগুলো গুছিয়ে তুলতে তুলতে পেছন ফিরে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে! রান্নাঘরে গিয়ে দিয়ে আসছি, তারপর এনে দিচ্ছি।”
ঈশান একদৃষ্টিতে অন্বেষার চলে যাওয়াটা দেখছিল। মোমবাতির আলো নিভে গেছে, ততক্ষণে কারেন্ট ও চলে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে অন্বেষা ফিরে এল হাতে দুটো সিগারেট নিয়ে। ঈশান একটা নিয়ে মুখে চাপাতেই অন্বেষা লাইটারটা এগিয়ে দিল। দুজনে সোফায় পাশাপাশি বসে, ধোঁয়ার মাঝে যেন নিজেদের কথাগুলোও হারিয়ে ফেলছিল।
“তোমার আজকের দিনটা কেমন লাগল?” অন্বেষা ঈশানের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল।
ঈশান একটুখানি হেসে বলল, “সত্যি বলতে, মনে হচ্ছে অনেক দিন পর এত শান্ত একটা রাত কাটালাম। তোমার সাথে সময় কাটানো সবসময়ই অন্যরকম।”
অন্বেষা নরম চোখে ঈশানের দিকে তাকাল, তারপর ধোঁয়ার রিং বানিয়ে মৃদু হাসল। “তাহলে তো প্রায়শই আসতে হবে।”
সিগারেট শেষ হতে ঈশান টের পেল ওর চোখদুটো ভারী হয়ে আসছে। ঘুম যেন ধীরে ধীরে ওকে আচ্ছন্ন করছে। অন্বেষা বুঝতে পেরে বলল, “বেডরুমে চলো, অনেক রাত হয়ে গেছে।”
ঈশান কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল। ওরা দু’জনে একসাথে বেডরুমের দিকে এগোল। ঘরে ঢুকে অন্বেষা এসিটা চালিয়ে দিল। ঠান্ডা বাতাস ধীরে ধীরে ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ঈশান বিছানার দিকে এগোতে গিয়েই অন্বেষাকে প্রশ্ন করল, “তুমি কখন আসবে?”
অন্বেষা একটা মায়াবী হাসি দিয়ে বলল, “আমি বাসনগুলো ধুয়ে নিই, তারপর আসছি। তুমি একটু জিরিয়ে নাও।”
ঈশান হাসিমুখে মাথা নাড়িয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ল। শরীরের ক্লান্তি এতটাই চেপে বসেছিল যে মুহূর্তের মধ্যেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। ওর এতটাই ঘুম পেয়েছিল যে নিজের প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করতেও ভুলে গিয়েছিল…
রাত তখন গড়িয়ে ভোর রাত। নিস্তব্ধতা এমন যে কেবল ঘড়ির টিক টিক শব্দই শোনা যায়। ঈশান ঘুমের মধ্যে কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করছিল। শরীরের ওপর একটা ভারী চাপ টের পাচ্ছিল সে, যেন কেউ বুকের ওপর বসে আছে।
হঠাৎ…
“তোমার ঘরে বাস করে কারা ও মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা, মন জানোনা…”
ভুতুড়ে সুরে ভেসে এল এক অচেনা কণ্ঠ।
ঘুম ভেঙে ঈশানের চোখ খুলতেই তার সমস্ত শরীর আতঙ্কে জমে গেল। তার বুকের ওপরে বসে আছে অন্বেষা! কিন্তু এটা সেই অন্বেষা নয়, যাকে সে চেনে।
চুলের বাঁধন খুলে এলোমেলো হয়ে পড়েছে, মুখে লাল সিঁদুর লেপটে আছে, আর সে অদ্ভুতভাবে গুনগুন করে গান গাইছে। তার চোখ দুটো লালচে আর ফাঁকা, একদম শূন্য দৃষ্টিতে ঈশানের দিকে তাকিয়ে আছে।
“অরিত্র! তোকে আজ আমি ছাড়বো না!”
তারপর আবার গান—
“এক জনে ছবি আঁকে এক মনে ও মন,
আরেক জনে বসে বসে রঙ মাখে ও মন।”
ঈশান চিৎকার করতে চাইলো, কিন্তু ভয়ে তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোল না। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। সে প্রাণপণে শরীরের ভার সরাতে চাইলো, কিন্তু অন্বেষার হাতের জোর অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
হঠাৎ অন্বেষা নিজের গাল থেকে সিঁদুর তুলে ঈশানের মুখে মেখে দিল, “নে! আমার রক্ত মাখ, অরিত্র!”
এইবার ঈশান পাগলের মতো হাত-পা ছোঁড়ার চেষ্টা করলো। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে, হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছে।
“অন্বেষা! তুমি শান্ত হও! আমি অরিত্র না! আর কে এই অরিত্র?”
অন্বেষা এক দমে হাসতে লাগলো, সেই হাসিতে যেন ভয়াবহ একটা প্রতিশোধের তীব্রতা লুকিয়ে ছিল।
“এক জনে সুর তোলে এক তারে ও মন,
আরেক জনে মন্দিরাতে তাল তোলে ও মন…”
তারপর হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলো, “অরিত্র, তুই আমাকে খুন করলি কেন? তোর জন্য আমার বাবা-মাকে মরতে হয়েছে!”
এটাই ছিল ঈশানের সুযোগ। সে এক ঝটকায় অন্বেষাকে ঠেলে মাটিতে ফেলে দিল। অন্বেষা ধাক্কা খেয়ে মাথায় আঘাত পেল, সঙ্গে সঙ্গে সে মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে গেল।
ঈশান কিছু না ভেবেই ছুটতে শুরু করলো। দরজাটা খুলেই দৌড় দিল সরু গলি ধরে, বুকের মধ্যে যেন হৃদপিণ্ডটা হাতুড়ির মতো ধাক্কা মারছে।
রাস্তার মোড়ে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল, ড্রাইভার ভেতরে ঘুমাচ্ছিল। ঈশান দরজা ধাক্কিয়ে ড্রাইভারকে জাগাল।
“ভাই, লেকটাউন চলো! খুব বিপদের মধ্যে আছি!”
ড্রাইভার ঘুম চোখে ঈশানের অবস্থা দেখে চমকে উঠলো। তার জামা ভেজা ঘামে, মুখ সাদা, আর মুখে লালচে দাগ!
“কি হয়েছে দাদা?”
ট্যাক্সি চলতে শুরু করলো, আর ঈশান কাঁপা কাঁপা গলায় সব সংক্ষেপে বলল। ড্রাইভার চুপচাপ শুনছিল, কিন্তু অন্বেষার নাম শুনতেই তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
“দাদা, আপনি কি বললেন? অন্বেষা? কোন বাড়ির?”
ঈশান ঠিকানাটা বলতেই ড্রাইভার হঠাৎ ব্রেক কষে ট্যাক্সি থামিয়ে দিল।
“ও তো একটা পাগল, দাদা! ওই পাড়ার লোকে তাকে ডাইনি বলে ডাকে!”
ঈশান হতভম্ব হয়ে গেল।
“ডাইনি মানে?”
ড্রাইভার একটু শ্বাস নিল, যেন একটা বড় কিছু বলার আগে নিজেকে প্রস্তুত করছিল। ট্যাক্সির জানালার বাইরে তখনো রাতের আঁধার ঝাপসা হয়ে আছে। ঈশানের বুকের ধুকধুকানি বাড়তে লাগল…
অধ্যায় ৭: অতীতের প্রতিধ্বনি
বাংলা রহস্য রোমাঞ্চ ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
ড্রাইভার ট্যাক্সিটা রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকানের পাশে থামাল। রাতের ঘটনার ধাক্কায় কাঁপতে থাকা ঈশান তখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেনি। ড্রাইভার সহানুভূতির সুরে বলল,
“দাদা, আপনি একটু হাত-মুখ ধুয়ে নিন, চা খান। আমি মিটার বন্ধ রাখছি, চিন্তা করবেন না।”
ঈশান মাথা নেড়ে রাজি হলো। চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে টাকা বের করতে গিয়ে বুঝল, তার ওয়ালেট অন্বেষার ঘরেই রয়ে গেছে। সে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
“ভাই, আমার সব কিছু ওখানেই ফেলে এসেছি! এটিএম কার্ড, টাকা—সবকিছু।”
ড্রাইভার হেসে বলল,
“কোনো চিন্তা নেই, দাদা। আমি দিয়ে দিচ্ছি। আপনি পরে ফেরত দিলেই হবে।”
ঈশান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলল,
“আপনার মতো মানুষ এখনো আছে দেখে মনে শান্তি লাগছে। ধন্যবাদ ভাই!”
রাতের ছায়া ফিকে হয়ে আসছে। আকাশে ভোরের আভা ছড়িয়ে পড়লেও ঈশানের মনের মধ্যে তখনো রাতের অন্ধকার ঘনীভূত।
চায়ের ভাঁড়ে ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিতে দিতে ড্রাইভার বলতে শুরু করলো,
“অন্বেষা আর তানিশা দুই জমজ বোন ছিল, দাদা। ওদের এত মিল ছিল যে কেউ আলাদা করতে পারত না।”
ঈশান তখনো রাতের ঘটনার ধাক্কা সামলে ওঠার চেষ্টা করছে। ধীরে ধীরে ড্রাইভারের কথাগুলো তার কানে প্রবেশ করছিল।
“তানিশা ভালোবাসতো অরিত্র নামে এক ছেলেকে। কিন্তু অরিত্র সুবিধার মানুষ ছিল না। সে ছিল খুব ধূর্ত, মেয়েদের ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলার লোক। তানিশার পরিবার প্রথম থেকেই সম্পর্কটা মানতে চায়নি, কিন্তু ভালোবাসার নামে মেয়েটা কিছুই শুনতে চাইতো না।”
ড্রাইভার একটু থেমে চায়ের ভাঁড় থেকে এক চুমুক নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো,
“একদিন রাতে রোড এক্সিডেন্টে তানিশার মৃত্যু হয়। তবে অনেকে বলে, ওটা দুর্ঘটনা ছিল না, বরং পরিকল্পিত খুন। কারণ, ঘটনাস্থলে তানিশার সবকিছু পাওয়া গেলেও তার মোবাইল ফোনটা কোথাও পাওয়া যায়নি। কেউ বলে, সেই মোবাইলে এমন কিছু ছিল যা অরিত্র প্রকাশ্যে আসতে দিত না।”
ঈশান হতভম্ব হয়ে বলল, “তারপর? অরিত্র?”
ড্রাইভার মাথা নাড়ল,
“তানিশার মৃত্যুর পর থেকে অরিত্র পুরো এলাকা থেকে উধাও হয়ে যায়। কেউ আর তাকে খুঁজে পায়নি। তানিশার বাবা-মা খুব ভেঙে পড়েছিলেন। তারা মেয়ে হারানোর শোক সইতে পারেননি। একদিন সকালে লোকজন দেখলো, দু’জনেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে।”
ঈশানের গায়ের রোম কেঁপে উঠলো। তার হাত থেকে চায়ের ভাঁড় প্রায় পড়ে যাচ্ছিল।
“আর অন্বেষা?” ঈশান কাঁপা গলায় বলল।
ড্রাইভার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“অন্বেষা, সে পুরোপুরি বদলে যায়। এত বড় দুঃখ একসাথে সামলে ওঠা কারো পক্ষেই সম্ভব না। সে পাড়ার প্রায় সবার সাথে ঠিক করে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। রাতে প্রায়ই ঘুমের মধ্যে ‘অরিত্র, তুই কোথায়? আমি তোকে ছাড়বো না!’ বলে চিৎকার করতো। প্রথম দিকে আত্মীয়স্বজন ওর পাশে ছিল। কিন্তু…”
ড্রাইভার থামল, যেন খুব কষ্টকর কিছু মনে পড়েছে।
“কিন্তু?” ঈশান উৎসুক হয়ে জানতে চাইল।
ড্রাইভার একটু ইতস্তত করে বলল,
“একদিন রাতের বেলা অন্বেষা তার মামার ছেলেকে অরিত্র ভেবে আক্রমণ করে বসে। ছেলেটা কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে যায়। এরপর তার আত্মীয়-স্বজন সবাই সম্পর্ক ছিন্ন করে নেয়। তখন থেকেই সে একা, পুরোপুরি একা। কেউ ওর সাথে কথা বলে না, ওর বাড়ির দিকে যায় না। ওর একমাত্র সঙ্গী ওই পুরোনো বাড়ির দেয়াল আর কিছু পুরনো স্মৃতি।”
ঈশান অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু তবুও কেউ ওকে সাহায্য করার চেষ্টা করলো না?”
ড্রাইভার করুণ হাসি হাসল,
“এই সমাজ মানসিকভাবে ভেঙে পড়া মানুষদের সাহায্য করতে চায় না, দাদা। বরং তাদের ভয় পায়। প্রথমে সবাই করুণা করেছিল, কিন্তু পরে ভয় পেল। ভয় পেল, কারণ তারা জানে না, কবে আবার অন্বেষা অরিত্র ভেবে আরেকজনকে আক্রমণ করবে!”
ঈশান চুপ হয়ে গেল। রাতের সেই ভয়াবহ দৃশ্য মনে পড়ে যাচ্ছিল।
“তুমি ভয় পেয়েছ, তাই তো?” ড্রাইভার ঈশানের চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল।
ঈশান মাথা নিচু করল।
“আমি জানি না। আমি ভয় পেয়েছি, অবাক হয়েছি, করুণাও হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না, এই মেয়েটার আসলে কী হয়েছে।”
ড্রাইভার চায়ের দাম মিটিয়ে বলল,
“চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। এই রাতের ধাক্কা সামলাতে একটু বিশ্রাম দরকার আপনার।”
চুপচাপ গাড়ির জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল ঈশান। রাস্তার আলো ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছিল, কিন্তু তার মনের ভিতর এক অন্ধকার জগতের দরজা খুলে যাচ্ছিল।
‘অন্বেষা সত্যিই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত? নাকি সে জানে কিছু যা অন্য কেউ জানে না? তানিশার মৃত্যুর আসল রহস্য কি?’
এইসব প্রশ্ন মাথার মধ্যে জট পাকাতে থাকলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্যাক্সি এসে ঈশানের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়ালো।
ঈশান বলল, “আমার তো সবকিছু ওই বাড়িতেই পড়ে আছে। কিন্তু আমি আপনাকে টাকা ফিরিয়ে দেব, কথা দিলাম।”
ড্রাইভার নম্বরটা দিয়ে বলল,
“এই নম্বরটা রেখে দিন, দাদা। টাকা ফিরিয়ে দেওয়া বড় কথা নয়, তবে আপনাকে ঠিকঠাক দেখে ভালো লাগলো। রাতের ঘটনাটা নিয়ে বেশি ভাববেন না, ঘুমিয়ে পড়ুন।”
ঈশান কৃতজ্ঞতাভরে বলল, “আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।”
ট্যাক্সি চলে গেল। ঈশান ফ্ল্যাটে ঢুকলো, দরজা বন্ধ করলো।
কিন্তু একটা প্রশ্ন তখনো ওর মাথার মধ্যে ঘুরছিল—
‘অরিত্র কি এখনো বেঁচে আছে? আর বেঁচে থাকলে কোথায় আছে?’
অধ্যায় ৮: ছায়ার খেলা
বাংলা রহস্য রোমাঞ্চ ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
সেদিন সারাদিন ঈশান ফ্ল্যাট থেকে বেরোয়নি। তার মাথার মধ্যে নানা চিন্তা একসাথে ঘুরপাক খাচ্ছিল। অন্বেষার সেই আতঙ্কিত চিৎকার, ড্রাইভারের গল্প, আর তানিশার রহস্যময় মৃত্যু—সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিল ওর মধ্যে। সন্ধে নামার পর হঠাৎই ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ঈশানের শরীর হিম হয়ে গেল—অন্বেষা কল করছে!
সে মুহূর্তের জন্য দ্বিধায় পড়ে গেল, তারপর হাত কাঁপতে কাঁপতে কলটা কেটে দিল। কিন্তু ফোন থামল না। অন্বেষা আবার ফোন করল। তারপর আবার। ঈশান একের পর এক কল ইগনোর করতে লাগল। শেষমেশ, ফোনটা বেজে ওঠা বন্ধ হলো। কিছুক্ষণ পর একটা মেসেজ এল—
“সরি!”
ঈশান মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। সে জানত না কী উত্তর দেওয়া উচিত। পরের দুই-তিন দিন সে ফ্ল্যাটের বাইরে পা রাখল না। কাজে যাওয়ার কথাও মনেই থাকল না। মনজুড়ে ছিল একধরনের অস্বস্তি, এক অদ্ভুত ভয়। চতুর্থ দিনের সকালে ফ্ল্যাটের দরজায় একটা কুরিয়ার এলো। ঈশান সই করে পার্সেলটা হাতে নিল। প্রেরকের নাম দেখে তার নিঃশ্বাস থমকে গেল—“অন্বেষা সেন”। পার্সেলটা খুলতেই চোখে পড়ল তার ফেলে আসা ওয়ালেট, আর সঙ্গে একটা চিঠি…
প্রিয় ঈশান,
তুমি কেমন আছো? জানি, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থায় তুমি নেই। আমি নিজেও জানি না, এই চিঠিটা লিখে ঠিক কী বলতে চাইছি, তবে মনে হচ্ছে কিছু না বললে বুকের ভেতরটা ফেটে যাবে। তাই লিখতে বসেছি, কারণ সামনাসামনি বলতে সুযোগ পাই নি।
ঈশান, আমি জানি তুমি কেন আমার ফোন ধরছো না। হয়তো চিরদিনের মতো সম্পর্ক শেষ করে দিতে চাইছো, আমার কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছো। আমি তোমাকে দোষ দেব না। আমি নিজেই জানি না, সেদিন রাতে ঠিক কী হয়েছিল। আমি যেন একটা অন্ধকারের গভীরে তলিয়ে গিয়েছিলাম, এমন এক আমি হয়ে উঠেছিলাম, যা আমি কোনোদিন হতে চাইনি।
আমি কি পাগল?
না, আমি হয়তো সত্যিই পাগল নই। কিন্তু এই ঘরটা, এই চার দেয়ালের মাঝে; আমি আর আমি থাকি না। একটা অদৃশ্য শক্তি যেন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। জানি, এসব কথা শুনতে হয়তো অলৌকিক লাগছে, কিন্তু আমি সত্যি বলছি, সন্ধ্যা নামার পর এই ঘরটা আর আগের মতো থাকে না। আমার শরীর, মন, এমনকি আমার চিন্তাভাবনাগুলোও বদলে যেতে থাকে। আমি যেন এক অদৃশ্য ছায়ার কাছে বন্দি হয়ে যাই।
ঈশান, আমি জানি না আমার ভবিষ্যৎ কী? আমি জানি না, এই অদ্ভুত অন্ধকার থেকে আমি আদৌ মুক্তি পাব কি না! তবে আমি এটুকু জানি—আমি তোমাকে ভালোবাসি।
হয়তো তোমার কাছে এটা হাস্যকর মনে হবে। একজন মানসিকভাবে অসুস্থ, অস্থির মনের মেয়ের ভালোবাসার কি আদৌ কোনো মূল্য আছে? আমি জানি না। তবে আমি এটা জানি, আমার ভিতরের ভয়ংকর দানবটার পাশাপাশি আমার ভেতরে একটা কোমল, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অনুভূতিও বাস করে, যা শুধু তোমার জন্য।
আমি কখনো কাউকে এভাবে চাইনি, যেমনভাবে তোমাকে চাইছি। হয়তো আমার চাওয়া এক স্বার্থপর মানসিকতার পরিচয়, কারণ আমার জীবনের জটিলতা তোমাকেও টেনে নিচ্ছে। কিন্তু আমি কি একবারের জন্যও তোমার স্পর্শ পেতে পারি না, তোমার উষ্ণ হাতের ছোঁয়ায় আমার হৃদয়কে ঠান্ডা রাখতে পারি না?
তুমি কি একবারের জন্যও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারবে না যে আমি একা নই?
ঈশান, আমি জানি আমার দোষের কোনো ক্ষমা নেই। আমি জানি, তুমি আমাকে আর দেখতে চাও না, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি পারো, অন্তত একবার আমার সাথে দেখা করো। আমি তোমার কাছে কোনো প্রতিশ্রুতি চাই না, কোনো দায়বদ্ধতা চাই না। আমি শুধু চাই, তুমি একবার আমার চোখের দিকে তাকাও, আমার মনের গভীর ভয়গুলোকে বুঝতে চেষ্টা করো।
এই পার্সেলের ভেতর তোমার ওয়ালেটটা পাঠিয়ে দিলাম। এটা ফেরত দেওয়ার জন্যই আমি তোমাকে বারবার ফোন করছিলাম, মেসেজ করছিলাম। কিন্তু আসলে, শুধু এইটুকুই কারণ ছিল না। আমি তোমার সাথে একবার কথা বলতে চেয়েছিলাম।
তুমি কি জানো, তুমি যখন আমার নাম ধরে ডাকো, তখন আমার ভেতরের সমস্ত অন্ধকার মুহূর্তের জন্য হলেও দূরে সরে যায়? তুমি কি জানো, তোমার হাসির শব্দ আমার একাকীত্বের প্রতিটি শূন্যতা ভরিয়ে দেয়?
তুমি পারলে, আমাকে ক্ষমা করো।
আমি জানি না, এই চিঠির কোনো উত্তর তুমি দেবে কি না, কিন্তু আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকব।
তোমার অপেক্ষায়,
অন্বেষা।
ঈশান চুপচাপ বসে ছিল, চিঠিটা তার হাতেই ধরা। অন্বেষার প্রতিটা শব্দ যেন তার হৃদয়ে আঘাত করছিল। সে জানত, এভাবে দূরে সরে থাকাটা কোনো সমাধান নয়। কিন্তু কিছু কথা মুখোমুখি না বলে ফোনে বলা সহজ। অনেকক্ষণ ভাবার পর সে গভীর শ্বাস নিলো, মোবাইলটা হাতে নিয়ে নম্বর ডায়াল করল।
রিং হতে থাকল। ঈশান অপেক্ষা করছিল। অবশেষে ওপাশ থেকে অন্বেষার কাঁদো কাঁদো কণ্ঠ ভেসে এলো।
অন্বেষা: (কাঁদতে কাঁদতে) হ্যালো!
ঈশান: হ্যালো! কেমন আছো?
অন্বেষা: (কান্না সামলানোর চেষ্টা করে) জানি না! ভালো থাকার চেষ্টা করছি! তুমি কেমন আছো?
ঈশান: আমিও ভালো থাকার চেষ্টা করছি। কিন্তু তুমি কাঁদছো কেন?
অন্বেষা: (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) আমার ভুল হয়ে গেছে, ঈশান! আমি জানি না সেদিন রাতে আমি কী করেছিলাম, কেন করেছিলাম! কিন্তু আমার একদম উচিত হয়নি। আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও।
ঈশান: (একটু দম নিয়ে) ঠিক আছে! আমি সেদিন রাতে তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম, তোমার কোথাও চোট লাগেনি তো?
অন্বেষা: জানি না! যখন জ্ঞান ফিরল, তখন দেখি আমি মেঝেতে পড়ে আছি। মাথাটা প্রচণ্ড ব্যথা করছিল, আর কপালের ডান দিকটা ফুলে গেছে। হয়তো চোট লেগেছিল।
ঈশান: (অন্যদিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে) সরি, অন্বেষা! আমার কিছু করার ছিল না!
অন্বেষা: সরি বলার কিছু নেই, ঈশান। এটা স্বাভাবিক… অন্তত আমার জন্য!
ঈশান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল। কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। তারপর হঠাৎ যেন মনে পড়ল, কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার।
ঈশান: আচ্ছা, এবার বলো, অরিত্র কে?
অন্বেষা: (একটু চমকে) অরিত্র? তুমি ওর কথা জানলে কীভাবে?
ঈশান: তুমি সেদিন রাতে আমাকে অরিত্র ভেবে আমাকে খুন করার চেষ্টা করছিলে…।
অন্বেষা: (দম নিয়ে) অরিত্র আমার দিদি তানিশার বয়ফ্রেন্ড ছিল। দিদির অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে সে কলকাতা ছেড়ে চলে যায়। তারপর আর কোনো খোঁজ পাইনি।
ঈশান: (গভীরভাবে শোনে) হুমম… আচ্ছা, এবার বলো, তোমার বাবা-মা আত্মহত্যা করেছিল কেন? তুমি কিছু জানো?
অন্বেষা: না, ঈশান! আমি কিছুই জানি না! তবে বাবা-মা মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে বাবা কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলত। খুব চিন্তিত দেখাত। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু বাবা-মা কেউই কিছু বলেনি।
ঈশান: (চিন্তিতভাবে) তোমার বাবার মোবাইল ফোনটা কোথায় আছে?
অন্বেষা: জানি না! তবে বাবা-মা যে ঘরে থাকত, ওই ঘরেই থাকতে পারে। কিন্তু বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে ওই দরজাটা আর খোলা হয়নি।
ঈশান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে ভাবছিল, এই রহস্যের সমাধান খুঁজতে হলে তাকে ওই ঘরে ঢুকতেই হবে।
ঈশান: আচ্ছা ঠিক আছে! এখন রাখছি, পরে কথা বলব। তুমি সাবধানে থেকো।
অন্বেষা: (কাঁদো কণ্ঠে) ঈশান…
ঈশান: হ্যাঁ?
অন্বেষা: (ধীরে বলে) লাভ ইউ!
ঈশান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি ফুটল।
ঈশান: লাভ ইউ টু!
এই বলে ঈশান ফোনটা কেটে দিল। ফোনের স্ক্রিনে অন্বেষার নামটা এখনো জ্বলজ্বল করছিল। তার মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরছিল।
অরিত্র কোথায় গেল? তানিশার মৃত্যুর আসল কারণ কী? বাবা-মা কেন আত্মহত্যা করল? সেই বন্ধ ঘরটায় কি আসল রহস্য লুকিয়ে রয়েছে?
অধ্যায় ৯: আলোর খোঁজে
বাংলা রহস্য রোমাঞ্চ ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
ঈশান মোবাইলটা পাশে রেখে একদৃষ্টিতে ছাদটার দিকে তাকিয়ে রইল। অন্বেষার কণ্ঠ এখনও তার কানে বাজছিল—কান্নাভেজা, অসহায়, একাকী। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, অন্বেষা শুধু একটা মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে না, বরং তার চারপাশে একটা অদৃশ্য অন্ধকার জাল ছড়িয়ে আছে। তাকে সেখান থেকে বের করে আনার দায়িত্ব ঈশানের কাঁধেই এসে পড়েছে।
সে জানত, দুটো বিষয় সবচেয়ে জরুরি—প্রথমত, অন্বেষার মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, তানিশার মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করা দরকার। অন্বেষার কথাগুলো মনে করার পর ঈশান বুঝতে পারল, তার বাবা-মায়ের মৃত্যুর ঘটনাও হয়তো কেবল আত্মহত্যা ছিল না। এসবের পেছনে কিছু গভীর সত্য লুকিয়ে থাকতে পারে।
প্রথমেই ঈশান ইন্টারনেটে সার্চ করে একজন ভালো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের খোঁজ করল। বেশ কিছু সময় খোঁজার পর সে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তথ্য পেল। তিনি মূলত মানসিক ট্রমা ও আচরণগত সমস্যার উপর কাজ করেন। ঈশান দ্রুত তার ক্লিনিকে কল করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করল।
এরপর তার মনে পড়ল, স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে সে শুধু একজনকেই চেনে—সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার। ওই মানুষটা হয়তো কিছু জানে, বা অন্তত স্থানীয় পুলিশ বা অন্য কারও সাথে যোগাযোগ করতে সাহায্য করতে পারবে। ঈশান একটু ভাবল, তারপর মোবাইলটা হাতে নিয়ে ড্রাইভারকে কল করার জন্য নাম্বারটা বের করল। এবার সত্যের কাছে পৌঁছনোই তার একমাত্র লক্ষ্য! ঈশান মোবাইলটা হাতে নিয়ে দ্রুত অনলাইন পেমেন্ট একটিভ করল। তারপর ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ফোন করল।
ঈশান: আমি ঈশান বলছি, সেদিন ভোর রাতে আপনি আমাকে শ্যামবাজার থেকে নিয়ে এসেছিলেন। চিনতে পারছেন?
ড্রাইভার: হ্যাঁ! বলুন, এখন কেমন আছেন? সব ঠিক আছে তো?
ঈশান: হ্যাঁ! আপনার এই নম্বরে পেমেন্ট করবো? আপনার নাম বিজয় মজুমদার তো?
ড্রাইভার(বিজয়): হুমম!
ঈশান দ্রুত অনলাইন পেমেন্ট করে দিল, তারপর কথাটা ঘুরিয়ে আনল মূল প্রসঙ্গে।
ঈশান: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সেদিন আমাকে সাহায্য করার জন্য।
বিজয়: ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই, মানুষ হিসেবে আমাদের একে অপরের বিপদে সাহায্য করা উচিত।
ঈশান: বিজয় দা, আপনার আর একটা সাহায্য দরকার।
বিজয়: হুমম! বলুন, কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
ঈশান: আমি ভাবছি স্থানীয় পুলিশ ও আপনাকে নিয়ে আমরা একবার অন্বেষার বাড়ি সার্চ করবো।
বিজয় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
বিজয়: কেন? আর এইভাবে কোনো নিদিষ্ট কারণ ছাড়া কারোর বাড়ি পুলিশ নিয়ে সার্চ করা যায় না।
ঈশান: সে ব্যাপারে চিন্তা করবেন না। আমি অন্বেষাকে রাজি করিয়ে নেবো। আপনি শুধু আমাদের সাথে থাকবেন আর যদি সম্ভব হয় পাড়ার এক দুজনকে সাথে রাখবেন।
বিজয় কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল,
বিজয়: আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি আগে পুলিশের সাথে কথা বলে আমাকে জানান। আমি এবং পাড়ার ২-৩ জন ওই সময় অন্বেষার বাড়িতে থাকবো।
ঈশান: থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ বিজয় দা!
ফোনটা রেখে ঈশান এক মুহূর্ত দেরি না করে অন্বেষাকে ফোন করল।
ঈশান: হ্যালো অন্বেষা!
অন্বেষা: হ্যালো! বলো?
ঈশান: একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে হবে। আমি ভাবছি তোমার বাড়িটা একবার সার্চ করবো পুলিশের সাহায্যে।
অন্বেষা: (অবাক হয়ে) কি বলছো! কেন হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিলে?
ঈশান: তুমি নিজেই বলেছিলে তোমার বাবা-মায়ের মৃত্যুর আগে কোনো একজন ফোন করত, আর তারপরে এইসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। তাছাড়া তানিশার মৃত্যুর ঘটনাটাও রহস্যজনক। আমি ভাবছি যদি কিছু সূত্র পাওয়া যায়!
অন্বেষা চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে বলল,
অন্বেষা: (গভীর শ্বাস নিয়ে) ঠিক আছে! যদি এতে কিছু জানা যায়, তবে আমি রাজি।
ঈশান স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। পরের দিন, ঈশান আর অন্বেষা শ্যামবাজার থানায় গিয়ে সাব-ইন্সপেক্টর সমরেশ বিশ্বাসের সাথে দেখা করল। সমরেশ বিশ্বাস সবকিছু শুনে বললেন,
সমরেশ বিশ্বাস: আপনি যা বলছেন, তা সত্যি হলে ব্যাপারটা খুবই সন্দেহজনক। আমরা এই কেসগুলো রি-ওপেন করতে পারি, তবে বাড়ি সার্চ করার জন্য আমাদের লিখিত আবেদন দরকার।
ঈশান ও অন্বেষা কোনো দেরি না করে থানায় লিখিত এফ-আই-আর জমা দিল। সমরেশ বিশ্বাস ফাইলের পাতা উল্টিয়ে বললেন,
সমরেশ বিশ্বাস: আমি তানিশার অ্যাক্সিডেন্ট ও তার বাবা-মায়ের সুইসাইড কেসটা রি-ওপেন করছি। সামনের রবিবার আমরা বাড়িতে যাবো সার্চ করতে।
ঈশান মাথা নেড়ে রাজি হলো। থানার কাজ শেষ করে সে দ্রুত বিজয়কে ফোন করল।
ঈশান: বিজয় দা, পুলিশ রবিবার আসবে সার্চ করতে। আপনি ও পাড়ার কিছু লোক থাকতে পারবেন?
বিজয়: (একটু ভেবে) ঠিক আছে! আমি ও পাড়ার কয়েকজন থাকবো।
সবকিছু ঠিক করে ঈশান ফোন রেখে দিল। এখন শুধু রবিবারের অপেক্ষা।
রবিবার সকাল থেকে অন্বেষার বুক ধুকপুক করছে। তার বাবার ঘরটা বছরের পর বছর বন্ধ ছিল। সেখানে ঢুকতে তার কেমন যেন ভয় লাগছিল। বেলা এগারোটা নাগাদ পুলিশ এসে পৌঁছাল। সমরেশ বিশ্বাসের সঙ্গে আরও দুইজন অফিসার ছিল। বিজয় আর কয়েকজন পাড়ার লোকও উপস্থিত ছিল।
সমরেশ বিশ্বাস: অন্বেষা, তোমার অনুমতি থাকলে আমরা ঘরটা খুলতে পারি।
অন্বেষা নিঃশব্দে মাথা নেড়ে চাবিটা এগিয়ে দিল। পুলিশ দরজা খুলতেই একটা স্যাতসেতে গন্ধ বেরিয়ে এলো। ঘরটা বেশ অগোছালো ছিল, ধুলো জমে গেছে সব জায়গায়। সমরেশ বিশ্বাস মনোযোগ দিয়ে খুঁজতে লাগল। হঠাৎই অন্বেষা আলমারির এক কোণায় একটা পুরোনো মোবাইল দেখতে পেল।
অন্বেষা: (উত্তেজিত গলায়) ঈশান! দেখো, বাবা’র পুরোনো মোবাইল!
পুলিশ মোবাইলটা নিয়ে ব্যাগে ভরে ফেলল।
সমরেশ বিশ্বাস: ভালো হয়েছে! মোবাইল মোবাইলটা আমরা ফরেনসিক টেস্ট এ পাঠাবো।
ঈশান এবার তাকাল আলমারির নিচের দিকে। সেখানে একটা পুরোনো ডাইরি। ডাইরি খুলে তারা দেখতে পেল, বেশিরভাগ পাতাতেই কোনো এক ‘অরিত্র’ নামের ব্যক্তির কথা লেখা ছিল।
ঈশান: (নিচু গলায়) অরিত্র তো তানিশার বয়ফ্রেন্ড ছিল! তাহলে সে কি এই ঘটনার সাথে জড়িত?
পুলিশ সবকিছু জব্দ করল, আর সমরেশ বিশ্বাস ঈশানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
সমরেশ বিশ্বাস: কিছু বড় রহস্য সামনে আসতে চলেছে। তোমাদের এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। এখন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে মোবাইল আর ডাইরি-র বিশ্লেষণের জন্য।
অন্বেষার চোখে ভয় আর কৌতূহল একসঙ্গে খেলা করছিল। সে জানত, আজ কিছু না কিছু প্রকাশ পাবে। ঈশান তাকিয়ে রইল বন্ধ দরজাটার দিকে। এই বাড়িটা যেন কোনো রহস্যময় অতীতের সাক্ষী হয়ে আছে, যা ধীরে ধীরে তার সামনে খুলে যাচ্ছে…
অনন্তের সন্ধানে - কল্পবিজ্ঞান-এর বাংলা ছোট গল্প: কল্পবিজ্ঞান গল্প 'অনন্তের সন্ধানে' - অরিত্রর নতুন মহাবিশ্বে যাত্রা। বাংলা ছোট গল্পে রহস্য, ত্যাগ ও সম্ভাবনার এক অনন্য মিশ্রণ। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করতে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ১০: ভোরের আলো
বাংলা রহস্য রোমাঞ্চ ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
পরের দিন সকালে, সে কলকাতার নামী মনোরোগ বিশেষজ্ঞা অপরাজিতা নন্দীর চেম্বারে গিয়ে হাজির হল।
অপরাজিতা তার সামনে বসে ঈশানের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বলুন, আপনার সমস্যা কী?”
ঈশান একটু ইতস্তত করল। তারপর ধীরে ধীরে অন্বেষার ঘটনা বলতে লাগল—তানিশার মৃত্যু, তার বাবা-মায়ের আত্মহত্যা, বাড়ির ভৌতিক পরিবেশ, অদ্ভুত স্বপ্ন আর সেই অদৃশ্য ভয় যা অন্বেষাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে।
অপরাজিতা মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন। তারপর সামনের টেবিলের উপর রাখা চশমাটা ঠিক করে বললেন, “আপনি যেটা বলছেন, এটাকে বলা হয় ‘স্পিরিট অবসেশন’ বা আত্মা-গ্রাস।”
ঈশান একটু চমকে উঠল, “সেটা আবার কী?”
অপরাজিতা ঠান্ডা গলায় বললেন, “আত্মা-গ্রাস এক রহস্যময় মানসিক অবস্থা, যেখানে কেউ অনুভব করে যে কোনো অদৃশ্য সত্তা তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এটি ভয়ংকর ভৌতিক অভিজ্ঞতা, অস্বাভাবিক আচরণ বা গভীর মানসিক বিভ্রান্তির রূপ নিতে পারে।”
ঈশানের কপালে ভাঁজ পড়ল।
“কিন্তু, এটা কি আসলেই সম্ভব? মানে, এটা কি সত্যিই কোনো অতিপ্রাকৃত ব্যাপার, নাকি এটা শুধুই মানসিক রোগ?”
অপরাজিতা একটু হাসলেন। “বিজ্ঞানীরা একে মানসিক রোগ বা মস্তিষ্কের বিভ্রম ভাবতে পারেন। কিন্তু যারা এই অভিজ্ঞতার শিকার, তাদের কাছে এটি এক ভয়ংকর বাস্তবতা। এমন অবস্থায় মানুষ তার নিজস্ব সত্তা হারাতে থাকে, ধীরে ধীরে অন্য কোনো শক্তি তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।”
ঈশান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। সে কিছু বুঝতে পারছিল না, শুধু এটুকু মনে হচ্ছিল যে অন্বেষাকে এখান থেকে সরিয়ে আনতে পারলে সে ভালো হয়ে যাবে।
অপরাজিতা তার চিন্তাভাবনা বুঝতে পেরে বললেন, “এই ধরনের সমস্যার চিকিৎসার প্রথম ধাপ হল লোকেশন চেঞ্জ। ভিকটিম যতদিন সেই বাড়িতে থাকবে, ততদিন সে আরও গভীরভাবে সেই সত্তার প্রভাবের মধ্যে চলে যাবে।”
ঈশান এবার সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেল।
“কিন্তু, আমি ওকে কোথায় নিয়ে যাবো? এই মুহূর্তে ওর আর কেউ নেই, আমি ছাড়া!”
অপরাজিতা ঈশানের চোখের দিকে তাকালেন। “আপনার নিজের ফ্ল্যাট আছে না?”
ঈশান মাথা নাড়ল, “আছে ঠিকই, কিন্তু…”
সে একটু থেমে গেল।
“কিন্তু কী?” অপরাজিতা জানতে চাইলেন।
ঈশান দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “সেদিন রাতে যা ঘটেছিল, তার পর থেকে ওকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসার সাহস পাচ্ছি না। আমি নিজেই ভয় পাচ্ছি, যদি সত্যিই কিছু থাকে?”
অপরাজিতা এবার একটু মৃদু হেসে বললেন, “আপনি ভয় পাবেন না, ঈশান। ভয় পেলে কখনও সত্যের মুখোমুখি হতে পারবেন না। আমার পরামর্শ, অন্বেষাকে একবার আমার চেম্বারে নিয়ে আসুন। ওর সাথে কথা বলে আমি বুঝতে পারবো, সমস্যাটা কতটা মানসিক আর কতটা অন্য কিছু।”
ঈশান একটু স্বস্তি পেল।
“ঠিক আছে, আমি ওকে রাজি করাবো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার চেম্বারে নিয়ে আসব।”
অপরাজিতা মাথা নাড়লেন, “সেটাই ভালো হবে। আর একটা কথা, কোনোভাবেই ওকে একা রাখবেন না।”
ঈশান একবার মাথা ঝাঁকালো, তারপর ধীরে ধীরে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে তখন সন্ধ্যা নামছে। আকাশে অন্ধকারের ছায়া ঘনিয়ে আসছে। মাথার মধ্যে কেবলই অন্বেষার কথা ঘুরছিল। “লোকেশন চেঞ্জ করতেই হবে!” অপরাজিতার কথাগুলো বারবার তার মনে পড়ছিল। সে আর দেরি না করে অন্বেষাকে ফোন করল।
“হ্যালো, অন্বেষা?”
ওপাশ থেকে একটু নিস্তব্ধতা, তারপর ক্লান্ত কণ্ঠে অন্বেষা বলল, “হ্যাঁ, বলো?”
“তুমি এখন কোথায়?”
“বাড়িতেই।”
ঈশান সরাসরি বলল, “শোনো, তুমি কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে নাও। আপাতত ২-৩ দিনের জন্য আমার ফ্ল্যাটে চলে এসো। তোমাকে ডাক্তার দেখাতে হবে, কাউন্সেলিং করাতে হবে।”
“না, ঈশান! আমি কোথাও যাব না।” অন্বেষার গলায় অনড় স্বর।
ঈশান ধৈর্য ধরে বোঝানোর চেষ্টা করল, “অন্বেষা, তোমার এই মুহূর্তে একা থাকা উচিত না। প্লিজ, আমার কথা শুনো। তুমি ভালো নেই, আর আমি জানি, এই বাড়ির পরিবেশ তোমার জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠছে। আমাকে বিশ্বাস করো, প্লিজ!”
অন্বেষা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। ঈশান বুঝতে পারছিল, ওর মনেও দ্বন্দ্ব চলছে।
অবশেষে অন্বেষা ধীর গলায় বলল, “ঠিক আছে, আসছি।”
ঈশান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রাত ৯টা নাগাদ অন্বেষা ঈশানের ফ্ল্যাটে পৌঁছাল। ওর হাতে একটা ছোট ব্যাগ, মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।
ঈশান দরজা খুলে বলল, “এসো।”
অন্বেষা ভিতরে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাল। ফ্ল্যাটটা ছোট হলেও গুছানো।
“খিদে পেয়েছে?” ঈশান জানতে চাইল।
অন্বেষা মাথা নাড়ল।
ঈশান বাইরে থেকে খাবার নিয়ে এসেছিল। ওরা একসঙ্গে ডিনার করল। খাবার শেষ হলে ঈশান একটা সিগারেট ধরাল, আর একটা অন্বেষার দিকে বাড়িয়ে দিল।
অন্বেষা কপাল কুঁচকে বলল, “আমি সিগারেট খাই না!”
ঈশান হতবাক!
“মানে? কিন্তু সেদিন তো দেখলাম তুমি ২-৩ টা সিগারেট খেলে!”
অন্বেষা বিস্মিত চোখে ঈশানের দিকে তাকাল। “সেদিন? তুমি হয়তো ভুল দেখেছো, ঈশান। আমি কখনোই সিগারেট খাইনি!”
ঈশান কিছু বলল না, কিন্তু তার মনের মধ্যে যেন একটা ঝড় বয়ে গেল। তাহলে সেদিন সে কাকে দেখেছিল?
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর ঈশান আবার প্রশ্ন করল, “তাহলে… তুমি কখনো মদ খেয়েছো?”
অন্বেষা একটু বিরক্ত হল, “কেন এসব জানতে চাইছো?”
“স্রেফ জানতে চাই।”
অন্বেষা মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, আমি মদও খাইনি। তবে দিদি মাঝে মাঝে মা-বাবাকে লুকিয়ে রেড ওয়াইন খেত। এখনও একটা বোতল পড়ে আছে আমার বাড়িতে। দিদি চলে যাওয়ার পর ওটাকে ফেলিনি, স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দিয়েছি। ওতে কিছুটা এখনো ওয়াইন আছে।”
ঈশান বিস্মিত হয়ে গেল।
“তানিশা রেড ওয়াইন খেত!?”
“হুমম!”
“সিগারেট?”
“হয়তো মাঝেমধ্যে, তবে আমি জানতাম না!”
ঈশানের মাথার ভেতর যেন সমস্ত ঘটনা গুলিয়ে যেতে লাগল।
“তাহলে… সেদিন রাতে আমি কার সাথে ছিলাম?”
ঈশান উঠে গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ঈশান অন্বেষার দিকে তাকাল।
“অন্বেষা, তুমি কি কখনো মনে করো যে তানিশা এখনো তোমার আশেপাশে আছে?”
অন্বেষার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।
“তুমি এসব কেন বলছো, ঈশান?”
ঈশান ধীরে ধীরে বলল, “কারণ আমি এখন আর নিশ্চিত নই… আমি সেদিন রাতে তোমার সাথে ছিলাম, নাকি তানিশার?”
অন্বেষার শরীর কেঁপে উঠল। ওর চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল।
“তুমি যা বলছো, তা সত্যি হলে… তবে কি দিদির আত্মা এখনো…”
কথাটা শেষ করতে পারল না অন্বেষা। ঈশান গভীরভাবে ভাবতে লাগল।
“কিছু একটা আছে, অন্বেষা। আমাদের এটা খুঁজে বের করতেই হবে!”
অন্বেষা এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। রাত গভীর হতে থাকল। বাইরে হাওয়ার শব্দ বেড়ে যাচ্ছিল। সে অন্বেষা কে তার শোবার ঘরটা দেখিয়ে নিজে আর একটা ঘরে চলে গেল। ওরা জানত, সামনের দিনগুলো আরও রহস্যময় হতে চলেছে…
অধ্যায় ১১: নতুন সূর্যোদয়
বাংলা রহস্য রোমাঞ্চ ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
পরের দিন সকাল। ঈশান আর অন্বেষা একসঙ্গে অপরাজিতা মজুমদারের চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে। অন্বেষার চোখেমুখে অস্বস্তি। ওর কখনোই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার অভ্যাস ছিল না।
ঈশান ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “রিল্যাক্স, অন্বেষা। শুধু নিজের অনুভূতিগুলো সত্যি করে বলবে।”
অন্বেষা মাথা নাড়ল, কিন্তু চেহারায় উদ্বেগ স্পষ্ট। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর নার্স এসে ওদের ভেতরে ডাকল।
অপরাজিতা ওদের বসতে বললেন। চশমার ফ্রেমটা একবার ঠিক করে তিনি অন্বেষার দিকে তাকালেন।
“অন্বেষা, কেমন আছো?”
অন্বেষা দ্বিধা নিয়ে বলল, “ভালো নেই, ডাক্তার ম্যাম। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি, অনেকসময় আমার নিজের মধ্যেই কেমন যেন পরিবর্তন টের পাই। আমি আস্তে আস্তে পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো?”
অপরাজিতা হাসলেন। “পাগল হওয়া মানে কী, জানো? আমরা যাকে ‘পাগল’ বলি, তারা আসলে হয়তো এমন কিছু অনুভব করে যা অন্যরা বোঝে না। ঠিক তোমার মতো। তাই ভয় পেয়ো না। তুমি একা নও।”
ঈশান পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।
“অন্বেষা, তুমি কি কখনো মনে করেছো যে তানিশা তোমার ভেতরে বাস করছে?”
অন্বেষা চমকে গেল।
“আমি জানি না… তবে মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমি তানিশার মতো কথা বলছি!”
অপরাজিতা গভীরভাবে তাকালেন। “এটা শুধু স্পিরিট অবসেশন নয়, তোমার মধ্যে স্প্লিট পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের লক্ষণও রয়েছে।”
ঈশান অবাক হয়ে বলল, “মানে?”
“মানে, অন্বেষা কখনো কখনো নিজেকে তানিশা ভাবতে শুরু করেছে। এটা সম্ভবত তার মানসিক ট্রমার কারণেই হয়েছে। কোনো বড় ধাক্কা বা শোকের পর এমনটা হতে পারে। সে কখনো সচেতনভাবে, কখনো অজান্তেই তানিশার চরিত্রে ঢুকে যাচ্ছে।”
অন্বেষা ভয়ার্ত চোখে বলল, “তাহলে আমি কি আর কখনো স্বাভাবিক হতে পারব না?”
অপরাজিতা আশ্বাস দিলেন, “পারবে, কিন্তু ধাপে ধাপে এগোতে হবে। প্রথম ধাপ হলো, তোমাকে তোমার পুরোনো পরিবেশ থেকে সরিয়ে আনা। ঈশান সেটা আগেই বুঝেছে। এখন তোমাকে জানতে হবে, তুমি আসলে কাকে হারিয়েছো, আর সেই শূন্যতা কীভাবে পূরণ করবে।”
অন্বেষা কিছু বলল না, শুধু মাথা নিচু করল।
একটু থেমে অপরাজিতা আরও বললেন, “আমি আরও কিছু তথ্য জানতে চাই। তানিশার কি কোনো মানসিক সমস্যা ছিল?”
অন্বেষা এক মুহূর্ত ভেবে বলল, “তানিশা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে থেকে ঘুমের ওষুধ খেত। মা-বাবা জানত না, কিন্তু আমি জানতাম। ও মাঝেমাঝে খুব দুশ্চিন্তা করত।”
অপরাজিতার মুখ চিন্তিত হয়ে উঠল।
“ঘুমের ওষুধ? এটা কি ডাক্তার লিখে দিয়েছিল?”
“না, ও বলেছিল অরিত্র জোগাড় করে দিত।”
ঈশান ও অপরাজিতা একে অপরের দিকে তাকাল।
প্রায় দেড় ঘণ্টার কাউন্সেলিং শেষে অপরাজিতা মজুমদার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। অন্বেষা তখনও চুপচাপ বসে ছিল, চোখেমুখে এক ধরনের ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।
অপরাজিতা ঈশানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “অন্বেষার যত্ন নেওয়া এখন সবচেয়ে জরুরি। ওর মানসিক অবস্থা বেশ জটিল। স্প্লিট পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার ও স্পিরিট অবসেশনের কারণে ও কখনো নিজের মধ্যে থাকবে, কখনো আবার তানিশার মতো আচরণ করবে। তুমি ওর পাশে থাকলে এই পরিবর্তনগুলো বুঝতে পারবে।”
ঈশান মাথা নাড়ল, “আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু কীভাবে সামলাবো?”
অপরাজিতা একটা ছোট নোটপ্যাডে কিছু লিখতে শুরু করলেন, তারপর বললেন, “আমি কিছু হোম থেরাপি দিচ্ছি। অন্বেষাকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে এগুলো সাহায্য করবে।”
তিনি নোটপ্যাডটি ঈশানের হাতে দিয়ে বললেন, “প্রথমত, অন্বেষাকে আগের রুটিনে ফিরিয়ে আনতে হবে। ঘুমের সময় ঠিক রাখতে হবে, খাবার নিয়মিত খেতে হবে, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—ও যেন একা বেশি সময় না কাটায়।”
ঈশান মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।
“দ্বিতীয়ত, ওর মন শান্ত রাখার জন্য মেডিটেশন, গান শোনা বা বই পড়ার মতো কিছুতে মনোযোগ দিতে বলবে। আর কোনোভাবে যদি তানিশার স্মৃতি ওর মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টা খেয়াল করবে, ওকে বাস্তবতার দিকে ফিরিয়ে আনবে।”
ঈশান নোটপ্যাডের দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বলল, “আমি অন্বেষার খেয়াল রাখবো, ডাক্তার ম্যাম।”
অপরাজিতা একটা আশ্বাসের হাসি দিলেন, “ভালো। মনে রাখবে, এটা সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। তুমি যদি সত্যিই ওর পাশে থাকতে চাও, তাহলে ধৈর্য্য ধরতে হবে।”
শেষ কয়েক মাস ধরে অন্বেষার থেরাপি নিয়মিত চলছিল। অপরাজিতা মজুমদারের নির্দেশ মতো প্রতিদিন নির্দিষ্ট কিছু হোম থেরাপি, মেডিটেশন, আর মানসিক শক্তি বাড়ানোর নানা কৌশল অনুসরণ করছিল ও। তানিশার মৃত্যু আর নিজের মানসিক দ্বন্দ্বের কারণে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল, তা কিছুটা হলেও কমেছিল। তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হওয়া থেকে ও তখনো অনেক দূরে। ঈশান বুঝতে পারত, অন্বেষা চেষ্টার কমতি রাখছে না, কিন্তু ভেতরে কোথাও একটা অজানা ভয় ওকে আটকে রেখেছে।
এমনই একদিন সকালবেলা ঈশানের ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল “সমরেশ বিশ্বাস (শ্যামবাজার থানা)”।
“হ্যালো, ঈশানবাবু?”
“বলুন স্যার!” ঈশান কৌতূহলী হয়ে বলল।
“অন্বেষার বাবার মোবাইল থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। আপনি যত দ্রুত সম্ভব ওকে নিয়ে থানায় আসুন।”
ঈশান মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে গেল। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সমরেশ বিশ্বাস এরই মধ্যে ফোন কেটে দিয়েছেন। ঈশান ফোনটা নামিয়ে অন্বেষার দিকে তাকাল। অন্বেষা তখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল।
“অন্বেষা, আমাদের থানায় যেতে হবে। তোর বাবার মোবাইল থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে,” ঈশান ধীর গলায় বলল।
অন্বেষা ধীরে ধীরে ফিরে তাকাল। “বাবার মোবাইল? এতদিন পর? কী ধরনের তথ্য?”
“ঠিক জানি না। কিন্তু অফিসার সমরেশ বললেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
অন্বেষা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “তুমি একবার বিজয় দাকে ফোন করে দাও। আমি চাই ও আমাদের সঙ্গে থাকুক।”
ঈশান মাথা নাড়ল। বিজয় মজুমদার, যিনি ওদের পারিবারিক বন্ধু এবং আইনজীবী, তার উপস্থিতি সত্যিই দরকার হতে পারে।
“ঠিক আছে, আমি ওকে ফোন করছি,” বলে ঈশান ফোন বের করল।
“বিজয় দা, আমাদের থানায় যেতে হবে। অন্বেষার বাবার মোবাইল থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তুমি কি আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে?”
বিজয় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “নিশ্চয়ই, আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে থানায় পৌঁছে যাচ্ছি। তোমরা রওনা হয়ে যাও।”
অন্বেষার চোখে অস্থিরতা স্পষ্ট। বিজয়ও গম্ভীর মুখে ওদের সঙ্গে থানার ভেতরে ঢুকলেন। সমরেশ বিশ্বাস তাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন। “বসুন। কিছু তথ্য দেখানোর আছে।”
ঈশান, অন্বেষা আর বিজয় চুপচাপ বসে পড়ল। সমরেশ অন্বেষার বাবার মোবাইলটা সামনে রাখলেন। “বেশ কিছু মেসেজ, কল রেকর্ড আর নোট উদ্ধার করেছি আমরা।”
তিনি মোবাইলের স্ক্রিন অন করে বললেন, “প্রথমে এটা শুনুন।”
একটা অডিও ক্লিপ চালানো হলো। ফোন থেকে একটা নারীকণ্ঠ ভেসে এলো—
“বাবা, আমি জানি তুমি আমাকে বাঁচাতে পারবে না। কিন্তু অন্বেষাকে রক্ষা করো। ও যেন আমার মতো শেষ না হয়…”
অন্বেষার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল।
“এটা… এটা দিদির গলা!”
অন্বেষার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো। “দিদি কার কথা বলছিল? ওকে হুমকি দিচ্ছিল কারা?”
বিজয় গম্ভীর স্বরে বলল, “এটা স্পষ্ট যে তানিশার মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। ও হয়তো কিছু জানত, যা ওর প্রাণসংহার করেছিল।”
সমরেশ বিশ্বাস ফাইলের পাতা ওলটালেন। “আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। তানিশার শেষের দিকে কিছু সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছিল। কিছু টাকার অদলবদল, কিছু অননুমোদিত কল।”
ঈশান জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কি তানিশার মৃত্যুর সঙ্গে অন্বেষার পরিবারের আরও কিছু গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে?”
সমরেশ বিশ্বাস বললেন, “আমরা এখনো নিশ্চিত নই। তবে এটা নিশ্চিত, তানিশার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না! তোমার বাবার মৃত্যুর কিছু দিন আগে অরিত্র তোমার বাবাকে প্রায় ফোন করতো। এবং কিছু ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছিল। যেটা শুধু আপনাকে দেখাতে চাই।”
অন্বেষা, ঈশান আর বিজয় তিনজনই হতবাক হয়ে গিয়েছিল। ঈশান ধীরে ধীরে অন্বেষার দিকে তাকাল, অন্বেষা বুঝতে পেরে চুপচাপ মাথা নাড়ল। যে সত্যগুলো এতদিন অন্ধকারে ঢাকা ছিল, আজ সেগুলো এক এক করে বেরিয়ে আসছে। তানিশার মৃত্যুর পেছনে সত্যিই কিছু গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে—এটা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
একজন লেডি কনস্টেবল এসে অন্বেষার পাশে দাঁড়ালেন। “আসুন আমার সঙ্গে,” কনস্টেবল নরম গলায় বললেন।
অন্বেষা এক মুহূর্ত দ্বিধায় থাকল, তারপর ধীরে ধীরে থানার ভেতরে একটা ছোট কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল। ভিতরে ঢুকে দরজাটা আস্তে করে লাগিয়ে দিল লেডি কনস্টেবল।
ঈশান আর বিজয় বাইরে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। দু’জনেই চুপচাপ। ঈশান এক গভীর শ্বাস নিল। এই মুহূর্তে ওর মাথার ভেতরে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরছে। অন্বেষা কি তানিশার মৃত্যুর সঙ্গে নতুন কোনো তথ্য মনে করতে পারবে? না কি নতুন কোনো ভয়ঙ্কর সত্য বেরিয়ে আসবে?
অধ্যায় ১২: নতুন সকাল
বাংলা রহস্য রোমাঞ্চ ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
অন্বেষা চোখের জল সামলাতে পারছিল না। ওর দেহটা যেন কাঁপছিল, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। ঈশান এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল, তারপর ওর কাঁধে আলতো করে হাত রাখল।
“অন্বেষা, কী হয়েছে? কিছু তো বলো!” ঈশানের গলা উদ্বেগে কেঁপে উঠল।
বিজয়ও চিন্তিত মুখে অন্বেষার দিকে তাকাল। কিন্তু ও কিছু বলতে পারছিল না, শুধু ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছিল।
সমরেশ বিশ্বাস জানতেন এই মুহূর্তে থানার ভেতরে অন্বেষার পক্ষে সবকিছু বলা সম্ভব নয়। তাই ঈশানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা বরং বাইরে গিয়ে কথা বলো। একটু একা থাকলে অন্বেষা নিজের মনের কথা খুলে বলতে পারবে।”
ঈশান মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। ও অন্বেষার হাত ধরে আস্তে করে থানার বাইরে বেরিয়ে এলো। থানার সামনের একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে ও অন্বেষাকে একটা বেঞ্চে বসতে বলল। অন্বেষা ধীরে ধীরে বসল, মাথা নিচু করে চোখ মুছতে লাগল।
ঈশান একটু অপেক্ষা করল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “এখন যদি বলো, আমি শুনতে পারি। প্লিজ, অন্বেষা। আমি তোমার পাশে আছি।”
অন্বেষা গভীর শ্বাস নিল, তারপর কম্পমান কণ্ঠে বলতে শুরু করল—
“অরিত্র… ও দিদির সাথে কাটানো কিছু ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি আর ভিডিও গোপনে রেকর্ড করেছিল।”
ঈশানের দেহ মুহূর্তেই শক্ত হয়ে গেল।
“কী বলছো তুমি?” ও ফিসফিস করে বলল।
অন্বেষা কষ্টে মাথা ঝাঁকালো, “হ্যাঁ, ও দিদিকে ব্ল্যাকমেইল করত। দিদির মৃত্যুর পরও থেমে থাকেনি। বরং বাবাকে সেই ভিডিও পাঠিয়ে টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল। কারণ আমরা ছিলাম জমজ বোন। হয়তো দিদি বুঝতে পেরেছিল যে আমি পরবর্তী শিকার হতে পারি। তাই মৃত্যুর আগে বাবাকে শেষবারের মতো বলেছিল— ‘বাবা, আমি জানি তুমি আমাকে বাঁচাতে পারবে না। কিন্তু অন্বেষাকে রক্ষা করো। ও যেন আমার মতো শেষ না হয়…'”
অন্বেষা ভেঙে পড়ল, দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল।
ঈশান ওর পাশে বসে শক্ত করে হাত ধরে রাখল। মনে হচ্ছিল, ওর মাথার ভেতর সবকিছু বিস্ফোরিত হচ্ছে। এতদিন ধরে ওর মনে যে সন্দেহ ছিল, সেটাই সত্যি হলো!
“কেউ-ই জানত না ঈশান! কেউ-ই জানত না! বাবাও হয়তো বুঝতে পারেননি। তাই দিদি একা একা এই যন্ত্রণা সহ্য করছিল…”
ঈশান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এবার ওর ভেতরে একটা প্রবল আগুন জ্বলে উঠল।
“এই নরপিশাচকে তো ছাড়লে চলবে না!” ও দাঁতে দাঁত চেপে বলল।
অন্বেষা চোখ মুছতে মুছতে মাথা নাড়ল, “ওর বিচার হোক।”
ওরা দু’জন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। বাতাসটা থমথমে হয়ে গিয়েছিল।
তারপর ঈশান বলল, “চলো, এবার থানায় ফিরে যাই।”
ওরা আবার থানার ভেতরে ফিরে এলো। সমরেশ বিশ্বাস তখন নিজের ডেস্কে কিছু কাগজপত্র ঘাঁটছিলেন। ওদের দেখে চোখ তুলে তাকালেন।
“সবকিছু শুনলেনতো?”
ঈশান শক্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ, আপনারা ওর কোনো খোঁজ পেয়েছেন?”
সমরেশ বিশ্বাস একটু হালকা শ্বাস ফেললেন, তারপর বললেন, “হুমম! ওর মোবাইল নম্বর ট্র্যাক করে আমরা ওর লোকেশন শিলিগুড়ির কাছে পেয়েছি। ওখানে এক বন্ধুর বাড়িতে লুকিয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে। আমাদের টীম আশাকরি আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে ওকে গ্রেপ্তার করতে পারবে।”
অন্বেষা এবার দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমি চাই, ওর উপযুক্ত শাস্তি হোক।”
সমরেশ বিশ্বাস মাথা নাড়লেন, “সেটা হবেই। এই কেসটা আমরা খুব সিরিয়াসলি নিচ্ছি। কিন্তু তোমারও সাবধানে থাকতে হবে। কারণ এমন লোকেরা কখন কী করে বলা যায় না।”
ঈশান এবার বলল, “আমরা সাবধানে থাকব। আর কোনো আপডেট পেলে আমাদের জানাবেন, প্লিজ।”
সমরেশ বিশ্বাস মাথা নেড়ে বললেন, “অবশ্যই। এখন তোমরা বাড়ি ফিরে যাও। এই ক’টা দিন একটু সতর্ক থেকো। আর হ্যাঁ, অন্বেষা, তুমি শক্ত থাকো। ওকে আমরা ধরবই।”
অন্বেষা চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্ত শান্ত হলো, তারপর বলল, “ধন্যবাদ, অফিসার।”
সেদিনকার মতো ওরা থানা ছেড়ে বেরিয়ে এলো। বাইরের আকাশ ধীরে ধীরে সন্ধ্যার রঙ নিতে শুরু করছিল।
বিজয় গাড়ির দিকে এগিয়ে এসে বলল, “চলো, আমি তোমাদের পৌঁছে দিচ্ছি।”
ঈশান অন্বেষার দিকে তাকাল। ও ক্লান্ত মনে মাথা নাড়ল, তারপর গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ির ভিতর এক অদ্ভুত নীরবতা। কিন্তু সেই নীরবতার মাঝেও ঈশান বুঝতে পারছিল, আজ অন্বেষার মনে একরকম শান্তি এসেছে। হয়তো এবার দিদির প্রতি ওর শেষ দায়িত্বটা পালন করতে পারবে। গাড়ির জানলার বাইরে রাত নামতে শুরু করেছে, কিন্তু ঈশান জানে, এই অন্ধকার বেশিদিন থাকবে না। অরিত্র ধরা পড়বে, ন্যায়বিচার হবেই!
পাঁচ দিন পর এক ভোরবেলা ঈশানের ফোন বেজে উঠল। ঘুম ঘুম চোখে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল—সমরেশ বিশ্বাস। মুহূর্তের মধ্যে তার ঘুম উড়ে গেল। ফোন ধরতেই ওপার থেকে গুরুগম্ভীর গলায় সমরেশ বললেন,
“ঈশান, অরিত্র ধরা পড়েছে। ওকে শ্যামবাজার থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। তুমি আর অন্বেষা এক্ষুনি চলে আসো।”
ঈশান কোনো উত্তর না দিয়ে তাড়াতাড়ি ফোনটা কেটে দিল। এরপর দ্রুত উঠে অন্বেষাকে ডাকল, “অন্বেষা, উঠে পড়ো! অরিত্র ধরা পড়েছে!”
অন্বেষা কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, তারপর তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। ঈশান ওর হাত ধরে বলল, “চলো, আমাদের এখনই থানায় যেতে হবে।”
তারা দ্রুত বেরিয়ে পড়ল। পথে ঈশান বিজয়কে ফোন করল, “বিজয় দা, অরিত্র ধরা পড়েছে! আমরা শ্যামবাজার থানায় যাচ্ছি, আপনিও চলে আসুন!”
বিজয় নিঃসংকোচে বলল, “আমি রওনা দিচ্ছি।”
শ্যামবাজার থানায় পৌঁছে ঈশান দেখল, থানার এক কোণে একটা বেঞ্চে বসে আছে একটা লোক—বয়সে ঈশানের সমান, কিন্তু মুখে ভয় আর অস্থিরতা। দু’হাতে হাতকড়া পরানো। দেখে মনে হচ্ছিল, এবার ওর পালাবার কোনো পথ নেই।
অন্বেষা আঙুল তুলে বলল, “এই হচ্ছে অরিত্র!”
ঈশানের রাগ মুহূর্তেই তুঙ্গে উঠল। সে তেড়ে গিয়ে গর্জে উঠল, “খানকির ছেলে!”
বলেই ওর কলার চেপে ধরল, একটা ঘুষি বসানোর জন্য হাত তুলতেই গেল, কিন্তু ঠিক তখনই সমরেশ বিশ্বাস শক্ত করে ওকে ধরে ফেলল।
“ঈশান! থামো! তুমি আইন নিজের হাতে নিতে পারো না!” সমরেশ কড়া গলায় বললেন।
কিন্তু ঈশান তখন অগ্নিশর্মা। “এই হারামিটা তানিশাকে খুন করেছে, অন্বেষার জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে!”
সমরেশ বিশ্বাস এবার কঠোর গলায় বললেন, “আমি বুঝি, ঈশান! কিন্তু এখন আমাদের কাজ বিচার নিশ্চিত করা।”
ঠিক তখনই থানায় ঢুকল বিজয় আর অন্বেষার পাড়ার দুজন। সমরেশ তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বিজয় বাবু, ঈশানকে বাইরে নিয়ে যান। দোষী ধরা পড়েছে, তার উপযুক্ত শাস্তি হবে। কিন্তু আইন হাতে তুলে নিলে পরিস্থিতি খারাপ হবে।”
বিজয় ঈশানের কাঁধে হাত রাখল। “চলো ঈশান, বাইরে চল। এটা পুলিশের কাজ।”
অন্বেষাও ঈশানের হাত ধরে বলল, “ঈশান, আমরা যা চেয়েছিলাম, সেটা হয়েছে। এবার আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।”
পুলিশি জেরায় বেশিক্ষণ চাপ দিতে হলো না। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অরিত্র সবকিছু স্বীকার করল।
“আমি প্রথমে তানিশাকে ভালোবাসতাম, কিন্তু পরে বুঝলাম, ওর বাবার অনেক টাকা। তখন লোভ সামলাতে পারলাম না। তাই ওর সাথে কাটানো কিছু বিশেষ মুহূর্তের ছবি আর ভিডিও গোপনে রেকর্ড করলাম। প্রথমদিকে ওকে ব্ল্যাকমেইল করতাম, টাকা আদায় করতাম। কিন্তু তানিশা একসময় সাহস করে সব ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দিল।”
সমরেশ বিশ্বাস চোখ সরু করে তাকালেন, “তাই তুমি ওকে মেরে ফেললে?”
অরিত্র এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মাথা নিচু করল, “হ্যাঁ, আমি ঠিক করেছিলাম ওকে সরিয়ে দেব। ও যখন বাড়িতে জানিয়ে দেওয়ার ভয় দেখাল, তখনই আমি একটা ভুয়ো এক্সিডেন্ট প্ল্যান করি।”
থানার সবাই শিউরে উঠল। সমরেশ ধমক দিয়ে বললেন, “আর তারপর? তানিশাকে মারার পরেও থামোনি কেন?”
অরিত্র একবার চোখ তুলে তাকাল, তারপর বলল, “কারণ তখন বুঝলাম, অন্বেষা আর তানিশা দেখতে একরকম। তানিশার বাবার ওপর চাপ বাড়ানোর জন্য আমি অন্বেষাকে টার্গেট করি। আমি ওই ছবি আর ভিডিও অন্বেষার নামে চালিয়ে দিয়ে ওর বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকি। চেয়েছিলাম, ওদের মান-সম্মান ধ্বংস করে দেব, যাতে ওরা বাধ্য হয় আমাকে টাকা দেয়ার জন্য।”
অরিত্রকে আদালতে তোলা হলো। জজের সামনে দাঁড়িয়ে সে কোনো কিছু অস্বীকার করার চেষ্টা করল না। শান্ত মুখে সবকিছু স্বীকার করল।
জজের চোখে কড়া দৃষ্টি ফুটে উঠল। তিনি স্পষ্ট গলায় রায় ঘোষণা করলেন—
“অভিযুক্ত অরিত্র সেনগুপ্ত নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে। আদালত তাকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ (খুন), ৩৮৫ (ব্ল্যাকমেইল), এবং ৫০৬ (ভয় দেখানোর অপরাধ) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করছে। অভিযুক্তকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো।”
আদালত চত্বরে একটা চাপা গুঞ্জন উঠল। অন্বেষা শক্তভাবে ঈশানের হাত ধরে রেখেছিল। জেল পুলিশ এসে অরিত্রর হাতে নতুন করে হাতকড়া পরিয়ে দিল। এবার সত্যিকারের কারাগারের দিকে যাত্রা। আদালতের বাইরে বেরিয়ে অন্বেষা গভীরভাবে শ্বাস নিল। যেন বুকের ওপর থেকে অনেক বড় একটা ভার নেমে গেছে। আদালতের করিডোরে ঈশান, অন্বেষা ও বিজয় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। চারপাশে কোলাহল, উকিলদের ব্যস্ততা, পুলিশের আনাগোনা। আজ বহুদিনের এক লড়াই শেষ হলো। অরিত্র তার অপরাধ স্বীকার করেছে, আদালত তার যথাযথ শাস্তির রায় দিয়েছে।
বাইরে বেরিয়েই বিজয় টেক্সিটা স্টার্ট করে ওদের উদ্দেশ্য করে হাসি মুখে বললো, “এবার তো তোমরা বিয়েটা করেই নাও!”
অন্বেষা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। ঈশান একবার তাকিয়ে হাসল, আর অন্বেষা লজ্জায় মাথা গুঁজে দিল ঈশানের বুকের কাছে। ঈশান তার চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল।
বিজয় হেসে বলল, “অন্বেষা দিদি, তুমি আর ওই বাড়িতে যেও না। বাড়িটা বিক্রি করে দাও।”
ঈশান মাথা নেড়ে সায় দিল। অন্বেষা একটু ভেবে বলল, “বিক্রি তো করব, কিন্তু ক্রেতা কে? আর এত ঝামেলা কে সামলাবে?”
বিজয় ভরসার সুরে বলল, “ওটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমি সব দেখে নেব।”
অন্বেষা তার দিকে তাকিয়ে ধীরে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ, বিজয় দা!”
বিজয় ঈশানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ফ্ল্যাটে যাবে তো?”
ঈশান মাথা নাড়ল, “না, আমাদের প্রিন্সেপ ঘাটে ছেড়ে দাও।”
সন্ধ্যা নামছে, গঙ্গার জলে শেষ আলোয় প্রতিফলিত হচ্ছে এক মোহময় আভা। শীতল বাতাস বইছে, নৌকার ভেসে চলার শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে নদীর ঢেউয়ের মাঝে। ঈশান আর অন্বেষা হাত ধরে ধীরে ধীরে গঙ্গার পাড়ে হাঁটতে লাগল।
অন্বেষা ঈশানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা! সেদিনের রাতের ঘটনার পরেও তুমি কীভাবে আমার ওপর বিশ্বাস রাখলে?”
ঈশান থেমে গেল। এক মুহূর্ত অন্বেষার গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে অন্বেষাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “যাকে মন থেকে ভালোবাসি, তার শুধু ভালোটাই নেব, সেটা তো হয় না। তার সবকিছু নিয়েই আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পায়।”
অন্বেষা আর কিছু বলল না। সে শুধু শক্ত করে ঈশানকে জড়িয়ে ধরে থাকল।
দূরে এক বাউল নৌকায় বসে গান গাইছিল—
“তোমার ঘরে বাস করে কারা ও মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।
তোমার ঘরে বাস করে কারা ও মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।
এক জনে ছবি আঁকে এক মনে ও মন,
আরেক জনে বসে বসে রঙ মাখে ও মন।
এক জনে ছবি আঁকে এক মনে ও মন
আরেক জনে বসে বসে রঙ মাখে
হ আবার সেই ছবিখান নষ্ট করে
কোন-জনা, কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।
তোমার ঘরে বাস করে কারা ও মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।
এক জনে সুর তোলে এক তারে ও মন
আরেক জনে মন্দিরাতে তাল তোলে ও মন
এক জনে সুর তোলে এক তারে ও মন
আরেক জনে মন্দিরাতে তাল তোলে
হ আবার বেসুরা সুর ধরে দেখো
কোন জনা, কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।
তোমার ঘরে বাস করে কারা ও মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।
রস খাইয়া হইয়া মাতাল
অই দেখ হাত ফসকে যায় হোড়ার লাগাম
রস খাইয়া হইয়া মাতাল
অই দেখ হাত ফসকে যায় হোড়ার লাগাম
সে লাগাম খান আধরে দেখ কোন জনা কোন জনা
সে লাগাম খান আধরে দেখ কোন জনা কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।
তোমার ঘরে বাস করে কারা ও মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,মন জানোনা
তোমার ঘরে বাস করে কারা ওমন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,মন জানোনা
তোমার ঘরে বাস করে কারা ওমন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা মন জানোনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।”
……and they happily lived ever after…..