কলকাতার বুকে, ব্যস্ত রাস্তার কোলাহলের ঠিক উল্টো দিকে, দাঁড়িয়ে আছে গ্র্যান্ড হোটেল। একসময়ের বিলাসবহুল আবাস, এখন নিঃসঙ্গ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত। জানালার কাচগুলি ভাঙা, দেওয়ালগুলিতে ফাটল, আর বারান্দায় ঝুলছে শ্যাওলা জড়ানো লতাপাতা। কেউ জানে না কবে শেষবার কেউ এখানে পা রেখেছিল।
আজ রাত্রে, এই ভুতুড়ে হোটেলের নিঃসাড়ে হলঘরে এক অদ্ভুত মিলনমেলা। সাত জন বন্ধু, বছরের পর বছর পেরিয়ে আবার একত্র হয়েছে। তাদের একজন, নীল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাচ্ছে। বিদায় জানাতেই এই আড্ডা, এই গ্র্যান্ড হোটেলে। কিন্তু, তাদের অজান্তেই, এই পরিত্যক্ত হোটেলের অন্ধকার গহ্বরে লুকিয়ে আছে একটি ভয়ঙ্কর রহস্য।
রাত যত গहराতে থাকে, তত অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। টিভি সেট বিনা বিদ্যুতে ঝলসে উঠে নিভে যায়। দেওয়ালে হঠাৎ করে লেখা দেখা যায় – “আপনাদের স্বাগত জানাই, মৃত্যুর দিকে”। একটি ঠান্ডা, কর্কশ গলা শোনা যায় – “এখান থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই”।
দরজা বন্ধ হয়ে যায়। জানালা দিয়ে আর বাঁচার কোন আশা নেই। তাদের বুঝতে বাকি থাকে, ফাঁদে পড়েছে তারা। গ্র্যান্ড হোটেল এখন তাদের কারাগার। ভয়, মৃত্যু, আর এক অদম্য আত্মার সঙ্গে তাদের লড়াই শুরু হয়।
হোটেলের অতীত উন্মোচিত হতে থাকে। একসময়ের মায়া নামের একটি মেয়ে, যে তার পরিবারকে হত্যা করেছিল, সেই আত্মা এখন এই হোটেলে আটকা পড়েছে। সেই আত্মা এখন তাদের ভয় ও গোপন কথাগুলিকে হাতিয়ার করে তাদের শেষ করে দেওয়ার জন্য মরিয়া।
রাত্রি যত গভীর হয়, বন্ধুদের মধ্যেও ফাটল দেখা দেয়। সন্দে, ভীতি আর অবিশ্বাস তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। এক এক করে তারা মায়ার শিকার হতে থাকে। কেউ হঠাৎ অগ্নিঝড়ের মধ্যে পড়ে, কেউ আবার নিজের অতীতের ভুলের ফল ভোগ করে।
অবশেষে, শুধু সোনা আর আকাশ বাকি থাকে। তারা বুঝতে পারে, মায়াকে শান্ত করতে হবে তাদের অতীতের পাপের স্বীকারোক্তি দিয়ে। সোনা স্বীকার করে তার প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য যে মিথ্যে বলেছিল, আর আকাশ স্বীকার করে সেই গাড়ি দুর্ঘটনায় তার ভুলের কথা।
মায়ার ক্রুদ্ধ গর্জন থামে। একটা শীতল বাতাস বয়ে যায়। হঠাৎ করে, জানালাগুলি খুলে যায়। সকালের আলো এসে পড়ে হোটেলে। সকালের আলোয় চোখ খুলতেই, সোনা আর আকাশের চোখ আটকে যায়। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চিন্ত মুখে হাসতে থাকা নীল। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে, সাদা শাড়ি পরা, চোখ দুটি নিথর।
“কী হলো বন্ধুরা?” হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে নীল। “এত রাতে ঘুমিয়ে পড়েছো?”
সোনা আর আকাশ একেবারেই কথা বলতে পারে না। মেয়েটির চোখে এক অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য, যেন মায়া নিজেই এখন নীলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নীল তাদের হাত ধরে তোলে এবং বলে, “চলো, তোমাদের আমার নতুন বাড়ি দেখাই।”
সোনা আর আকাশ উঠতে পারে না। তাদের শরীর জড়িয়ে ধরেছে এক অস্বাভাবিক শীতলতা। নীল তাদের দু’জনের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে, “আমি জানি তোমরা কী স্বীকার করেছো। তবে, মনে রেখো, গোপন কথা কখনোই গোপন থাকে না।”
মেয়েটির হাসি আরও জোরে উঠে। সোনা আর আকাশ চিৎকার করতে চায়, কিন্তু চিৎকার আটকে যায় তাদের গলায়। তারা শুধু নিজেদের চোখ বন্ধ করে নিতে পারে, এই আশায় যে, হয়তো এ সবই একটা খারাপ স্বপ্ন। কিন্তু, সকালের সূর্যের আলোয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, গ্র্যান্ড হোটেলের এই রাত্রি তাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। তাদের বন্ধুত্ব, তাদের অতীতের গোপন কথা, সবই এখন মায়ার অধীনে বন্দী।
সূর্যের আলো চোখে লাগতেই সোনা চমকে উঠে বসে. চারপাশটা অপরিচিত. সে কোন নিস্তব্ধ কামরায়, দেওয়ালে ফ্রেম করা পুরনো ছবি আর ভাঙা আসবাবপত্র. আকাশ নেই. সে একা. গতরাতের ঘটনাগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে. নীলের হাসি, মেয়েটির শীতল চোখ, সবকিছুই যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে. কিন্তু, হাত পা কাঁপছে ভয় আর শীতে.
হঠাৎ, দরজা খোলা হয়. সোনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই মেয়েটি, সাদা শাড়ি আর নিথর চোখ নিয়ে. মেয়েটির হাতে একটা পুরনো খাতা. সে সোনার দিকে এগিয়ে এসে বলে, “আপনি স্বীকার করেছেন, তাই আপনাকে বাঁচিয়েছি. কিন্তু, আপনার বন্ধু…” সে থামে, তারপর খাতাটা খুলে দেখায়.
খাতায় লেখা, “যে সত্যি লুকিয়ে রাখবে, সেই মৃত্যুবরণ করবে.” সোনা বুঝতে পারে, আকাশ হয়তো সত্যি স্বীকার করতে পারেনি. মেয়েটি হাসে, এক ভয়ঙ্কর শব্দ. “এখন আপনার পালা. আপনি যদি আমার কথা মতো চলেন, তাহলে আপনাকে বাঁচাব. কিন্তু, যদি না মানেন…” সে আবার থামে, তার চোখ দুটি জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে.
সোনার মনে পড়ে যায় নীলের কথা – গোপন কথা গোপন থাকে না. সে জানে, এই মেয়েটি, মায়া, হয়তো সোনাকে ব্যবহার করবে তার নিজের উদ্দেশ্যে. কিন্তু, বাঁচার লালসায় সোনার কাছে আর কোন উপায় নেই. সে মাথায় সম্মতিসূচকভাবে সায় দেয়.
মেয়েটি হাসে, এবার একটু স্বাভাবিক লাগে. সে বলে, “আমি জানি আপনি লেখক. আপনাকে লিখতে হবে. আমার গল্প, আমার দুঃখ, সব লিখতে হবে. যাতে সবাই জানতে পারে আমার কথা. যাতে আর কেউ আমার ভুল না করে.”
সোনা লিখতে শুরু করে. সে লিখে গেলেই মনে হয় যেন মায়ার আত্মা তার মধ্যে ঢুকে পড়ছে. সে লিখে মায়ার অতীত, পরিবারের প্রতি তার ভালোবাসা, আর সেই ক্রোধ যা তাকে খুনোখুনি করতে দ্রব করেছিল.
দিন যত যায়, সোনা বুঝতে পারে, লেখার মাধ্যমে মায়ার আত্মা শান্ত হচ্ছে. কিন্তু, সোনার নিজের জীবন? সে বন্দী এই পরিত্যক্ত হোটেলে, মায়ার কাহিনীর কাহিনিকার. সে জানে না, লেখা শেষ হলে তার কি হবে. মুক্তি পাবে সে, নাকি মায়ার সাথেই আটকে থাকবে এই ভুতুড়ে আবাসে?
সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যায়. সোনা নিরলসভাবে লিখে চলেছে. মায়ার গল্প যত এগিয়েছে, ততই বুঝতে পেরেছে মেয়েটির অসহায় দুঃখ. পরিবারের প্রতি তার ভালোবাসা, ক্রোধের ঝোঁকে করা ভুল – সবকিছুই লিখতে লিখতে সোনার নিজের চোখে জল চলে আসে. সে মায়ার জন্য অনুভূতি জন্মে, একটা অদ্ভুত সহানুভূতি।
এক রাতে, লেখা শেষ করে সোনা ক্লান্ত চোখে ঘুমিয়ে পড়ে. স্বপ্নে সে দেখে একটি মেয়েকে, সাদা শাড়িতে, কিন্তু আর আগের মতো নিথর চোখ নেই. চোখে একটা শান্তির আভা. মেয়েটি সোনার কাছে এসে বলে, “ধন্যবাদ, তুমি আমার গল্প লিখেছো. এখন আমি শান্তিতে থাকতে পারব.”
সোনা চোখ খুলতেই দেখে, সামনের টেবিলে খাতাটি খোলা. শেষ পাতায় লেখা, “মায়া, মুক্তি পেয়েছে.” ঘরের জানালায় ঝলমলে সকালের আলো ঢুকে পড়েছে. সোনা দরজার দিকে ছুটে যায়. দরজা খোলা.
বাইরে লেখা দেখে সোনা বুঝতে পারে, সে মুক্ত. কিন্তু, মুক্তির সঙ্গে এসেছে এক অসহ্য বোঝা. সে জানে, মায়ার গল্প বলা দরকার সবাইকে. কিন্তু, কে বিশ্বাস করবে এই ভুতের গল্প?
সোনা লিখতে থাকে. সে লিখে গেলেই মনে হয় যেন মায়া তার পাশেই আছে. লেখা শেষ হলে, বইটি প্রকাশিত হয়. বইটি ঝড়ের মতো বিক্রি হয়. লোকেরা মায়ার গল্প পড়ে কাঁদে, ভাবে. সোনা সাক্ষাৎকার দেয়, কিন্তু কাউকে বলে না গ্র্যান্ড হোটেলে তার অভিজ্ঞতা. সে জানে, কিছু গল্প শুধু মনেই থাকা ভালো.
কয়েক বছর পর, সোনা আবার ফিরে আসে গ্র্যান্ড হোটেলে. এবার সে একা নয়. তার সঙ্গে আছে ছেলেমেয়ে. হোটেলটি এখন জীর্ণ, তবে, আর ভুতু নেই. সোনা ছেলেমেয়েকে বলে, “এই হোটেলে একসময় একটা মেয়ে থাকত. তার নাম ছিল মায়া.” ছেলেমেয়ে অবাক হয়ে তাকায়. সোনা হাসে, একটা মিষ্টি হাসি. “কখনো কখনো ভুলের জন্য শাস্তি ভোগ করতে হয়. কিন্তু, সত্যি কথা বলা গেলে, শান্তি পাওয়া যায়.” সে আকাশের দিকে চায়, যেন তাকে দেখতে পাচ্ছে. “মনে আছে আকাশ? তুমি সত্যি বলতে পারনি…” কথাটা শেষ না করেই সোনা চলে যায়, ছেলেমেয়েদের হাত ধরে. গ্র্যান্ড হোটেলের নিঃসাড়ে হলঘরে একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে যায়, যেন কেউ মুক্তি পেয়েছে এই পৃথিবীর বন্ধন থেকে.